আহসান রাজীব বুলবুল, কানাডা :: সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব মানুষ। শৈশব থেকে কৈশোর, কৈশোর থেকে যৌবন, যৌবন থেকে বার্ধক্য। তারপর একসময়ে পৃথিবী থেকে বিদায়। আর এই দীর্ঘ সময়ে রঙ্গমঞ্চে কি সুন্দর অভিনয়। প্রতিটি চরিত্রই যেন তার নিজস্ব স্বকীয়তায় বয়ে চলছে।
নির্দেশকের অনুমতি থাকা সত্বেও ভুল পদক্ষেপ রঙ্গমঞ্চের চরিত্রগুলো এলোমেলো করে দেয়। শুরু হয় নিজের সঙ্গে নিজের অন্তদ্বন্দ্ব। সবকিছু থেকে রেহাই পেলেও ভিতরের মানুষ থেকে রেহাই নেই। এক সময় জেগে ওঠে ভিতরের মানুষ অনুভব করে তাঁর সারা জীবনের কৃতকর্ম। নিজেকে ফাঁকি দেওয়ার কৌশল মানুষ আদৌ কি আয়ত্ত করতে পেরেছে?
প্রিয় পাঠক, বলছিলাম বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া সম্প্রতি একটি হাইকোর্টের যুগান্তকারী রায় ঘোষণার কথা। পত্রপত্রিকার খবরে বলা হয়েছে “মায়ের সেবার শর্তে আসামির গৃহবাস”। খবরে প্রকাশ – মাদক মামলায় পাঁচ বছরের দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি মতি মাতবরকে শর্তসাপেক্ষে প্রবেশনে (পরীক্ষাকাল) পরিবারের সঙ্গে থাকার সুযোগ দিয়ে রায় দিয়েছেন হাইকোর্ট।
রায় অনুযায়ী, তাকে আগামী দেড় বছর প্রবেশন অফিসারের (আদালত নির্ধারিত সমাজসেবা কার্যালয়ের কর্মকর্তা) অধীনে থাকতে হবে। এ সময় মতি মাতবর তার ৭৫ বছর বয়সী মায়ের যত্ন নেবেন। দশম শ্রেণির ছাত্রী মেয়ে ও দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্র ছেলের লেখাপড়ার খরচ চালাবেন এবং তত্ত্বাবধান করবেন। আইন অনুসারে নির্ধারিত বয়সের আগে তিনি তার মেয়েকে বিয়ে দিতে পারবেন না। এসব শর্ত না মানলে আবারও জেলে যেতে হবে তাকে।
বিচারপতি জাফর আহমেদের একক হাইকোর্ট বেঞ্চ রোববার আসামির রিভিশন আবেদন খারিজ করে এবং প্রবেশনের সুযোগ চেয়ে করা আবেদন নিষ্পত্তি করে এই যুগান্তকারী রায় দেন। আসামির পাঁচ বছরের কারাদন্ড ও অর্থনৈতিক দন্ড স্থগিত করে এ রায় দেওয়া হয়েছে।
১৯৬০ সালের প্রবেশন অধ্যাদেশ অনুযায়ী দেশের অধস্তন আদালতে এর আগে একাধিক রায় হলেও হাইকোর্টে এটিই প্রথম রায়। প্রবেশন হলো একটি অপ্রাতিষ্ঠানিক ও সামাজিক সংশোধনী কার্যক্রম। এ প্রক্রিয়ায় দণ্ডিত ব্যক্তির শাস্তি স্থগিত করে তাকে কারাগারে অন্তরীণ না রেখে সমাজে খাপ খাইয়ে চলার সুযোগ দেওয়া হয়। তাকে আইন মান্যকারী নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার জন্য সহায়তা করা হয়।
মামলার বিবরণে জানা যায়, ইয়াবা রাখার অভিযোগে মতি মাতবরের বিরুদ্ধে ২০১৫ সালের ২৩ নভেম্বর ঢাকার কোতোয়ালি থানায় মামলা করা হয়। মামলায় ২০১৭ সালের ৮ জানুয়ারি আদালত তাকে পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদ ও ২০ হাজার টাকা জরিমানা করেন।
এ রায়ের বিরুদ্ধে আবেদনের পর আপিল খারিজ করে দেন মহানগর দায়রা জজ আদালত। এরপর মতি ২০১৭ সালের ১ জুলাই হাইকোর্ট বিভাগে রিভিশন আবেদন করেন। তিনি ২০১৫ সালের ২৩ নভেম্বর গ্রেপ্তারের পর ২০ মাস কারাভোগ করেন। ২০১৭ সালের ৯ জুলাই হাইকোর্ট তাকে জামিন দেন।
প্রবেশন আবেদন প্রসঙ্গে আইনজীবী শিশির মনির বলেন, মতি মাতবরের এটিই প্রথম অপরাধ এবং আর কোনো অপরাধে জড়িত থাকার কোনো রেকর্ড নেই। এ জন্য তিনি রিভিশনের শুনানিতে প্রবেশন অধ্যাদেশ, ১৯৬০-এর ধারা ৫ অনুযায়ী প্রবেশন চেয়ে আবেদন করেন। আদালত চলতি বছরের ৭ অক্টোবর ১০ দিনের মধ্যে আসামির নামে ব্যাংক হিসাব এবং টিন নম্বর খুলে দিতে ঢাকার অপরাধী সংশোধন ও পুনর্বাসন সমিতিকে নির্দেশ দেন।
পাশাপাশি ২১ অক্টোবর ঢাকা জেলার প্রবেশন কর্মকর্তাকে মতি মাতবরের বিষয়ে খোঁজখবর নিয়ে হাইকোর্টে প্রতিবেদন দেওয়ারও নির্দেশ দেওয়া হয়। এরপর প্রবেশন কর্মকর্তা মতি মাতবরের বিষয়ে খোঁজখবর নিয়ে ২ নভেম্বর আসামি সম্পর্কে ইতিবাচক প্রতিবেদন দেন। রোববার প্রতিবেদন পর্যালোচনার পর আদেশ দেওয়া হয়।
ফিরে আসি মূল কথায় – অপরাধ যেই করুক না কেন শাস্তি অনিবার্য। তা হোক প্রকাশ্যে অথবা অর্ন্তজালে। কেউ অপরাধ করে অভাবের তাড়নায়, কেউ প্ররোরচিত হয়ে, আবার কেউ দানব মনের সাময়িক পরিতৃপ্তির জন্য। অপরাধের পরেই শুরু হয় মানসিক যন্ত্রণা যেখানে অনেক ক্ষেত্রে অপরাধী কে ঠেলে দেয় মৃত্যুর দাঁড়গোড়ায়। জীবনের সর্বক্ষেত্রে প্রকাশ্যে নিজেকে নির্দোষ মনে হলেও আদৌ কি নির্দোষ?
রাজনৈতিক প্রভাব আর অর্থ প্রতিপত্তি দিয়ে আইন কিনে নিলেও ভিতরের যমদূত কে কেনা যায় না। অন্তরালের যমদূত তাকে তাড়া করে বেড়ায়। অন্তরালের বহুমূখী অশান্তি আর যন্ত্রণা কে শুধুমাত্র আইন প্রয়োগ করে বুঝানো সম্ভব নয়, যতক্ষণ না অপরাধী ব্যক্তির আত্মিক উন্নয়নের চেতনায় নাড়া না পড়ে।
হাইকোর্টের এই যুগান্তকারী রায় নাড়া দিয়েছে বিশ্ববাসীকে। ৭৫ বছর বয়সী বৃদ্ধা মা আর দুই সন্তানের লালন-পালনের দায়িত্বের মধ্যে দিয়ে মতি মাতবর তার অন্তরালের যমদূত তাড়ানোর যে সুযোগ পেয়েছেন- তা ক’জনই বা পায়?
সামাজিক অপবাদ নিয়ে বেঁচে থাকার কোন সার্থকতা নেই। শ্বাশ্বত মানব কল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত করে আত্মিক উন্নয়নই জীবনের পরম সার্থকতা।বিজ্ঞ আদালত ৭৫ বছর বয়সী বৃদ্ধা মাকে যত্ন নিতে দণ্ডিত সন্তানকে যে নির্দেশ দিলেন এতে পৃথিবীতে আরেকবার জয় হলো মানবতার- মায়ের।সাধুবাদ জানাই হাইকোর্টের নন্দিত এই রায়কে।
পরিশেষে বিচারের পূর্বেই অন্তরালের যমদূতের যে বিচার তাতেই রায় হয়ে যায়। ক্ষণস্থায়ী এই রঙ্গমঞ্চে আলো-আঁধারের মিশ্রণ থাকবেই। “এই বুঝি ভোর হয়ে এলো” এই অপেক্ষায় না থেকে নৈতিক শিক্ষায় আত্মসচেতন হয়ে কৈশোর থেকে বার্ধক্য পর্যন্ত রঙ্গমঞ্চে শ্রেষ্ঠত্বের পরিচয় দিলেই কেবল অন্ধকার দূর হবে। ফিরে আসবে শান্তি।
লেখক: আহসান রাজীব বুলবুল
প্রবাসী সাংবাদিক ও
প্রধান সম্পাদক, প্রবাস বাংলা ভয়েস, কানাডা।
প্রবাস বাংলা ভয়েস/ঢাকা/ ১০ নভেম্বের ২০২০/এমএম





