Menu

মো. মাহমুদ হাসান :: ‘বই হোক নিত্যসঙ্গী ‘ এর চেয়ে শুভ প্রত্যাশা আর কি হতে পারে? বই পাঠ করে, এর বিষয়বস্তু কে হ্রদয়ে ধারণ করে, আহরিত জ্ঞান ব্যক্তির জীবন কে নিঃসন্দেহে বদলে দিতে পারে, তবে এর জন্য চাই নিয়মিত পাঠের অভ্যাস, বয়স, পাত্র, কাল বিবেচনায় সঠিক বইয়ের নির্বাচন।

শিশু কাল থেকে বই পাঠ কে শিশু মনে আনন্দের খোরাক হিসেবে তুলে দিতে পারলে, কৈশোরে বই পড়া কে জীবনের অংশ করে নিতে পারলে, বই ই জীবন কে বদলে দেবে। তাই তো প্রখ্যাত মার্কিন লেখক মার্ক টোয়েন বলেছিলেন, ” যার বই পড়ার অভ্যাস নেই, আর যে পড়তে জানে না তার মধ্যে কোন তফাৎ নেই।”

আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে এগিয়ে যাচ্ছে দ্রুত গতিতে, উন্নয়ন এর সুফল নিয়ে নানাবিধ মতান্তর থাকলেও অগ্রগতির প্রশ্নে মতদ্বৈততার সুযোগ খুবই সীমিত, কিন্তু সামাজিক অবক্ষয় যেন বেড়েই চলেছে জ্যামিতিক গতিতে। এ অবক্ষয় কে রোধ করতে না পারলে, মিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের উন্নয়ন কোন সুফল ই বয়ে আনবে না, একটি সুখী, সুন্দর সমাজ ব্যবস্থা বাস্তবায়নে তা হবে বিরাট অন্তরায়।

যে তরুণ, যুব সমাজ ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের দায়িত্ব নেবে, তারা যদি নৈতিক মূল্যবোধে গড়ে উঠতে না পারে, নানা সামাজিক অবক্ষয়ের শিকার হয়ে পথভ্রষ্ট হয়, এর পরিণতি শুধু ব্যক্তির জীবন ও পরিবার নয় পুরো সমাজ ব্যবস্থা কেই অস্থির করে তুলবে। তাই কৈশোর আর তারুণ্যে সঠিক দিক নির্দেশনায় গড়ে উঠলে একটি প্রজন্ম তার সমাজ, রাষ্ট্র কে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যেতে সক্ষম। শুধুমাত্র আইনের বাধ্যবাধকতা , অর্থনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা, আর সরকারি উদ্যোগ এমন সামাজিক সমস্যা সমাধানের জন্য কোনভাবেই যথেষ্ট নয়,এর জন্য প্রয়োজন একটি সফল সামাজিক আন্দোলন।

পাঠাভ্যাস শুধু জ্ঞান কে ই বিকশিত করে না,আত্মার পরিশোধনের মাধ্যমে মানবিক মূল্যবোধ তৈরীতে ও এর বিকল্প নেই। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মতে, ” বই পড়াকে যথার্থ হিসেবে যে সংগি করে নিতে পারে, তার জীবনে দুঃখ কষ্টের বোঝা অনেক কমে যায়।”

সমাজকে বদলে দেয়ার ভাবনা যে অতি কঠিন, যাত্রাপথ নিতান্তই বন্ধুর, ঘুনে ধরা সমাজব্যবস্থায় বিত্ত, বৈভব ই যখন মুখ্য, মুখোশধারী দানবেরা যখন সমাজের খবরদারী করে, তরুন প্রজন্ম যখন অনৈতিক পথে উদ্দেশ্য অর্জন নিয়ে ব্যতিব্যস্ত, শিক্ষা যখন পন্য, সমাজপতিরা আদর্শহীন মোহাচ্ছন্ন, রাজনীতিকরা পদ আর ক্ষমতার লোভে অন্ধভাবে ব্যতিব্যস্ত, এমনই দু:সময়ে মেধা- মননে, মানবিক মূল্যবোধ সম্পন্ন এক সুন্দর ভবিষ্যত প্রজন্ম গড়ার সুদৃঢ় প্রত্যয়ে এগিয়ে যাওয়া, নিঃসন্দেহে একটি মহান প্রশংসনীয় উদ্যোগ।

আর এমন লক্ষ্য আর প্রত্যয় নিয়েই খুলনা জেলার পাইকগাছা উপজেলার মাহমুদকাটি গ্রামে ১৯৯০ সালে তরুণ জয়দেব ভদ্র, উনার সমাজ উন্নয়ন ভাবনার সমমনা সাথীদের নিয়ে গড়ে তোলেছিলেন “অনির্বাণ লাইব্রেরী”।

দেশে নানা অঞ্চলে বিভিন্ন রকম পাঠাগার আছে, সরকারি ব্যবস্থাপনায় ও অনেক পাঠাগার পরিচালিত হয়, কিছু ব্যক্তি ও সামাজিক উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত পাঠাগারও আছে, তবু ও পাঠাভ্যাস এখন ও একটি সামাজিক আন্দোলনের অংশ হয়ে উঠেনি। কিছু সংখ্যক সরকারি পাবলিক লাইব্রেরী আর বিশ্ববিদ্যালয় সমুহের গন গ্রন্থাগার ব্যতীত বড় পরিসরের লাইব্রেরী ও গড়ে উঠেনি, আবার দেশের জনগোষ্ঠীর বৃহত্তম অংশ গ্রামে বাস করলেও শহরাঞ্চল ব্যতিত সুযোগ সুবিধায় সমন্বিত কোন পাঠাগারের অস্তিত্ব ও খুঁজে পাওয়া ভার।

এ হেন পরিস্থিতিতে প্রান্তিক মানুষের বসবাসে সমৃদ্ধ একটি প্রত্যন্ত গ্রামে গড়ে উঠা অনির্বাণ লাইব্রেরীর সদস্য সংখ্যা আজ প্রায় ১৫০০০, সদস্য সংখ্যার বিচারে দেশের সেচ্ছাসেবীদের অনুদানে পরিচালিত দেশের বৃহত্তম গণগ্রন্থাগার ” অনির্বাণ লাইব্রেরী “।

পাঠাগারের মতো একটি সামাজিক উদ্যোগ কিভাবে একটা সম্প্রদায় বা জনগোষ্ঠীর জীবন যাত্রা কে বদলে দিতে মাহমুদকাঠি আজ তার জলন্ত উদাহরণ। কিশোর থেকে বয়োজ্যেষ্ঠ, নারী থেকে পুরুষ, নিরন্ন গৃহহীন থেকে সম্পদে সমৃদ্ধ উঁচুতলার মানুষ সবার ই সমন্বিত অংশগ্রহণে মাহমুদকাঠি ও তার নিকটবর্তী অঞ্চলে “অনির্বাণ লাইব্রেরী” যে আলো ছড়াচ্ছে, সেটি আজ আমাদের সমাজ ব্যবস্থার এক অনুকরণীয় মডেল।

ছাত্র-ছাত্রী, তরুণ যুবকেরা নিয়মিত পাঠ চক্রে অংশ নিচ্ছে, বই পড়ে তা রিভিউ করছে, একদল বিজ্ঞ বিশেষজ্ঞ সমগ্র কার্যক্রম কে তত্ত্বাবধান করছে, ছাত্র ছাত্রী পড়ালেখার প্রয়োজনে যেমন পাঠাগারমূখী হচ্ছেন আবার অবসরের বিনোদনে ও লাইব্রেরী কে ই বেঁচে নিচ্ছেন, তার পাশাপাশি মানবতার প্রয়োজনে কর্মসংস্থান, দারিদ্র্য দূরীকরণ, শিক্ষা, চিকিৎসা সহায়তা সহ নানাবিধ সমাজসেবা মূলক কর্মকান্ডের সমন্বয়ে সকল শ্রেনীর মানুষের অংশ গ্রহণে এ যেন সমাজ পরিবর্তনের এক সুবিশাল মিলনমেলা, হতাশায় আচ্ছন্ন তরুণ সমাজ কে নৈতিক সামাজিক মূল্যবোধে গড়ে তোলার প্রানান্তকর প্রচেষ্টা, ভবিষ্যত প্রজন্মের দক্ষতা পেশাদারিত্ব, আর নৈতিকতায় নিজেকে সমৃদ্ধ করার এক অতি আকর্ষণীয় প্রতিযোগীতা।

সবুজ বৃক্ষরাজি থেকে নির্গত অক্সিজেন যেমন প্রাণীকূলকে বাঁচিয়ে রাখে, তেমনি সবুজাভ বৃক্ষরাজির জীবন সঞ্চারে প্রাণীকূলের নিঃসরিত কার্বন ডাই অক্সাইড ও অপরিহার্য। জীবনের সাথে গাছের যেমন সম্পর্ক, বইয়ের সাথে মেধা,মননশীলতা,নৈতিকতা আর মানবিক মূল্যবোধের সম্পর্ক টা ও ঠিক তেমনি। তাই তো চীন দেশের প্রবাদে আছে, “একটি বই পড়া হলো, একটি সবুজ বাগান কে পকেটে নিয়ে ঘুরা”।

অনির্বাণ এর ব্যপ্তি আজ তার ভৌগোলিক সীমাবদ্ধতাকে ও ছাড়িয়ে গেছে, কতিপয় তরুণের ভাবনার সাথে আজ হাজার হাজার দেশে বিদেশে বসবাসকারী মূল্যবোধসম্পন্ন মানবিক মানুষের একাগ্রতা, এ যে এক বিরাট প্রাপ্তি। প্রত্যন্ত অঞ্চলের গড়ে উঠা একটি লাইব্রেরী, আজ পনেরো হাজার সদস্যের এক বিশাল পরিবার, ক্রমবর্ধমান সদস্য বৃদ্ধির সাথে সাথে নিঃসন্দেহে এর সক্ষমতা ও বেড়েছে অনেক।

আটষট্টি হাজার গ্রামের ছোট একটি দেশে প্রতিটি অঞ্চলেই কিছু বিদ্যুৎসাহী, উঁচু নৈতিক মূল্যবোধ সম্পন্ন মানুষ আছেন যারা একটি সুখী সুন্দর ভবিষ্যত প্রজন্মের স্বপ্ন দেখেন, একটি আলোকিত সমাজ ব্যবস্থা কে হ্রদয়ে লালন করেন। সারা দেশ থেকে এমন মহতী মানুষ গুলো যদি এগিয়ে আসেন, ‘অনির্বাণ’ কে সংগে নিয়ে এর আদর্শিক মডেল কে দেশব্যাপী ছড়িয়ে দিতে পারেন, নিঃসন্দেহে লক্ষ প্রানের বিনিময়ে অর্জিত আমার প্রিয় বাংলাদেশে “অনির্বাণ লাইব্রেরী” হতে পারে একটি শুদ্ধাচার আন্দোলন।

লেখক: উন্নয়ন গবেষক ও সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষক, ক্যালগেরি, আলবার্টা কানাডা।

প্রবাস বাংলা ভয়েস/ঢাকা/ ০৮  নভেম্বের ২০২০/এমএম