Menu

মোঃ মাহমুদ হাসান,ক্যালগেরি, আলবার্টা, কানাডা :: কয়েকদিন যাবত, ভাবনাটা খুব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। কোন লিখায়ই আর নিজেকে আটকাতে পারছি না। একটা দিয়ে শুরু করলে আর একটি ইস্যু এসে, আগের টি কে তাড়িয়ে দেয়, এমন দোলাচালের মধ্যে ই ব্যারিস্টার নওফেল কে ধন্যবাদ দেয়াটা ই প্রাধিকার পায়। সম্মানিত পাঠক নিশ্চয় ভাবছেন, কি এমন মহান কর্ম জনাব নওফেল সেরে ফেলেছেন যার জন্য ধন্যবাদ টা বড় ই জরুরী হয়ে পড়েছে?

পূর্ব পশ্চিমের সমন্বিত শিক্ষায় শিক্ষিত তরুণ প্রজন্মের প্রতিনিধি নওফেল। বাক্য বিন্যাস, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, গঠনমূলক চিন্তা চেতনায় সমৃদ্ধ নওফেল চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক পরিবারে বেড়ে উঠা মানুষ, তার চেয়েও বড় পরিচয় তিনি চট্টগ্রামের আবেগ ভালোবাসার প্রতীক, জাতির জনকের আদর্শের অত্যন্ত ত্যাগি ও বিশ্বস্ত অনুসারী, দুর্দিনের বটবৃক্ষ, অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির আপোষহীন নেতা বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রয়াত মহিউদ্দিন চৌধুরীর সন্তান।

মহিউদ্দিন চৌধুরী যেভাবে চট্টগ্রামের মাটি কে ভালোবাসতেন , বোধ করি তার চেয়ে বেশী চট্টগ্রামপ্রেমী সমসাময়িক কালে নেই, তার ই সন্তান হিসেবে ব্যারিস্টার নওফেলের কাছে চট্টগ্রামের মানুষ তথা দেশবাসীর কিছু ব্যতিক্রমী প্রত্যাশা তো থাকতেই পারে।

মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে মহিউদ্দিন চৌধুরীর যেমন কিংবদন্তি ইতিহাস আছে, ৭৫ পরবর্তী সময়ের ইতিহাস আরও গৌরবোজ্জ্বল, ছদ্মনামে হোটেলের বাবুর্চি সেজে জীবিকা নির্বাহ করেও কোন অপশক্তি, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পরিপন্থী সাম্প্রদায়িক দানবীয় গোষ্ঠীর কাছে তো আত্নসমর্পণ করেন ই নি, বিপরীতে ১৯৮৬ সালের ২৬ শে নভেম্বর গোয়েবলসীয় কায়দায়, সামরিক নমুনায়, হুইসেল বাজিয়ে, ককটেল ফাটিয়ে, ব্যাপক রক্তপাতের মাধ্যমে, একই সময়ে সমগ্র চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কে দখল করে ৭১ এর পরাজিত শক্তির দুসর জামাত শিবির যে তান্ডব শুরু করেছিল, এই কঠিন সময়ে হাজার হাজার প্রগতিশীল ছাত্র ছাত্রী ও শিক্ষকের সবচেয়ে বড় ছায়াদানকারী বটবৃক্ষ ছিলেন বীর চট্টলার কৃতি সন্তান মহিউদ্দিন চৌধুরী।

১৯৮৬ থেকে ১৯৯৬, এই দশ বছরে তথাকথিত ইসলামী ছাত্র শিবিরের হাতে শুধুমাত্র বাংলাদেশ ও মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধ কে ধারন করার অপরাধে কত প্রগতিশীল ছাত্র শিক্ষকের রক্তে বিশ্ববিদ্যালয়ের সবুজ ক্যাম্পাস রঞ্জিত হয়েছিল তা আজকের নব্য-বাস্তবতায় অনেক এমপি, মন্ত্রী অনুধাবন না করলেও প্রয়াত মহিউদ্দিন চৌধুরীর পরিবারের পক্ষে তা কোন ভাবেই অজানা থাকার কথা নয়।

ক’দিন থেকেই ভাবছি, আওয়ামী লীগ কি বিএনপির পথে হাঁটছে? এ কি করে সম্ভব? ৭১ বছরের পুরনো ঐতিহ্যবাহী একটি দল, জনগণকে সঙ্গে নিয়ে, জনগনের দাবিকে সামনে রেখে বহু আন্দোলন আর ত্যাগ তিতিক্ষার বিনিময়ে যে দল টি আজকের এই অবস্থানে, তার সঙ্গে উর্দি পরা শাসকের নেতৃত্বে ক্যানটনমেনটে জন্ম নেয়া, সংখ্যাগরিষ্ঠ সুবিধাবাদী, দলছুট, মুক্তি যুদ্ধের চেতনা পরিপন্থী, সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর সমন্বয়ে গড়া একটি দলকে তুলনা করা কতটাই বা যৌক্তিক?

৯১ সাল থেকেই জামাতিদের নিয়ে বিএনপির মধ্যে একটি মৃদু গুঞ্জন ছিল যে, একদিন এই জামাত শিবির ই তাদের কাল হতে পারে, ৯৬ এ আওয়ামী লীগ সরকারে আসলে এই ধারণা আরও ঘনীভূত হয়, আর ২০০৮ সালের পর থেকে বিএনপিতে থাকা মুক্তিযোদ্ধা ও অপেক্ষাকৃত গ্রহণযোগ্য ও উদারপন্থী সহ সকলে ই এখন দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন, জামাতি অনুসংগ ই বিএনপির আজকের অবস্থানের সবচেয়ে বড় কারন।

৮০ র দশকের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অত্যন্ত দাপুটে এক ছাত্রশিবির নেতা হাসান মাহমুদ চৌধুরী গত ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২০ করোনা আক্রান্ত হয়ে ইহলোক ত্যাগ করেন। অনেক বিত্ত বৈভবের মালিক এই নেতা নাকি দানশীল ও ছিলেন, তাই তার মৃত্যুতে অনেকেই শোক জানাবেন এটাই তো বাস্তব কিন্তু বাঁধ সেধেছে ক্ষমতাশীন দলের কিছু এমপি, মন্ত্রীর শোক প্রকাশ আর বুদ্ধিজীবি কবরস্থানে দাফন নিয়ে।

সেই সময়ে যারা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রগতিশীল ছাত্র রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন, এমনকি সক্রিয় ছাত্র রাজনীতি না করলেও যারা প্রগতিশীল ধারার সমর্থক ছিলেন এমন অনেকেই এই দাপুটে নেতার নেতৃত্বে খুন, জখম সহ নানারকম চরম নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, অনেকেই বিকলাঙ্গ হয়ে দুঃসহ জীবন যাপন করছেন, আর এসব ত্যাগ তিতিক্ষার বিনিময়ে ই বাংলাদেশে ২১ বছর পর ক্ষমতায় আসে মুক্তি যুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ।

মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকে পূনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে যাদের জীবন প্রতিক্রিয়াশীলদের কারণে চরমভাবে ভাবে দুর্বিসহ হয়ে উঠেছিল, সেই আদর্শের সরকারের মন্ত্রী এমপি যখন বাংলাদেশ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পরিপন্থী নেতার মৃত্যুতে শোকাভিভূত হয়ে পড়েন, বুদ্ধিজীবি কবরস্থানে শেষ শয্যার সুযোগ পায়, তখন অভিজিৎ ধর বাপ্পি দের মতো বিকলাঙ্গ মানুষদের বুকফাটা আর্তনাদ করা ছাড়া কি ই বা করার আছে?

মাহমুদ চৌধুরীর মৃত্যুতে ব্যারিস্টার নওফেল শোক জানিয়ে ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিবৃতি দিয়ে তা প্রত্যাহার করে নিয়েছেন, ৭১ টিভির আলোচনায় অংশ নিয়ে তার উদ্ধেগের কথা জানিয়েছেন, আর কেউ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই সময়কার নির্যাতিত মানুষগুলোর কথা মনে না রাখলেও মহিউদ্দিন চৌধুরীর সন্তান হিসেবে ব্যারিস্টার নওফেল তা অনুধাবন করতে পেরেছেন তাই তার প্রতি কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানানো সৌজন্যতামূলক শিষ্টাচারের একটি ন্যুনতম প্রচেষ্টা। নানা অনাচার, আকন্ঠ নিমজ্জিত নৈতিক স্খলনের এই সমাজ ব্যবস্থায় তরুণ প্রজন্মের প্রতিনিধি নওফেলদের অগ্রযাত্রা ই হোক প্রত্যাশিত প্রত্যয়।

লেখক: উন্নয়ন গবেষক ও সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষক
ক্যালগেরি আলবার্টা
কানাডা

প্রবাস বাংলা ভয়েস/ঢাকা/ ০৬ অক্টোবর ২০২০/এমএম


Array