Menu

প্রবাস বাংলা ভয়েস ডেস্ক :: বৈশ্বিক মহামারী করোনাভাইরাসের প্রভাবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশেই অর্থনীতি, সংস্কৃতি, শিক্ষা ব্যবস্থা, স্বাস্থ্য খাতসহ প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রের অবস্থা শোচনীয়। উন্নত দেশে করোনার যে ধরনের প্রভাব পড়েছে সেখানে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর জন্য এ পরিস্থিতি মোকাবেলা করা আরও কঠিন। সংশ্লিষ্টরা শিক্ষা খাতে চলমান সংকট মোকাবেলায় দিন-রাত কাজ করে যাচ্ছেন।

বাংলাদেশেও প্রতিবছরের মতো ২০২০ সালের প্রথম দিনে বই বিতরণ, ফেব্রুয়ারিতে এসএসসি, দাখিল ও সমমানের পরীক্ষা, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি, নির্ধারিত সময়ে ক্লাস, পরীক্ষা ও ডিগ্রি প্রদান সবই নিয়ম মেনে চলছিল।

কিন্তু মহামারী করোনাভাইরাস যেন নিমিষেই চলমান শিক্ষা খাতের গতিটাকে অনেকটা থামিয়ে দিয়েছে। তবে সরকার, শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনসহ সংশ্লিষ্ট সবার প্রচেষ্টায় মহামারীর শুরুতে স্থবির হয়ে যাওয়া শিক্ষা ব্যবস্থার গতি কিছুটা সচল রাখা গেছে।

প্রাথমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ হওয়ার পর গত ৭ এপ্রিল থেকে সংসদ টেলিভিশনে প্রাথমিক ক্লাস সম্প্রচারিত হচ্ছে। তবে এটি শতভাগ শিক্ষার্থীর কাছে পৌঁছানো যাচ্ছে না। মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, সংসদ টেলিভিশনে ক্লাস প্রচার করে ৫৯ থেকে ৫২ শতাংশ শিক্ষার্থীর কাছে পাঠ পৌঁছানো সম্ভব হচ্ছে।

মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের অনলাইনে ক্লাস শুরু হয় ২৯ মার্চ থেকে। তবে ইন্টারনেটে সমস্যা, ডিভাইসের অপর্যাপ্ততা এই ক্লাসের জন্য বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে অল্প কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া বাকিরা এখনও অনলাইনে ক্লাস শুরু করতে পারেনি।

গত মাসে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সঙ্গে বৈঠকের পর কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় অনলাইনে ক্লাস করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। তবে এখানেও শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ, শিক্ষার্থীদের ইন্টারনেট ও ডিভাইসের সংকটের কথাই বলা হচ্ছে। যদিও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সঙ্গে দেশের সরকারি মোবাইল কোম্পানি টেলিটকের আলোচনাসাপেক্ষে ইতোমধ্যে স্বল্পমূল্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ইন্টারনেট দেয়ার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।

অর্থাৎ দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা বৈশ্বিক মহামারী করোনার মধ্যে একদম থেমে না থাকলেও পুরোপুরি চালু করা সম্ভব হয়নি। তবে যেহেতু শিক্ষাই একটি জাতির মেরুদণ্ড এবং শিক্ষা ব্যবস্থার অগ্রগতি ও সাফল্যের ওপরেই দেশের সামগ্রিক উন্নতি নির্ভরশীল; তাই শিক্ষা ব্যবস্থার গতিকে আরও চলমান রাখা বেশ গুরুত্বপূর্ণ।

কিছু কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা গেলে আশা করি মহামারীকালীন ও পরবর্তী শিক্ষা ব্যবস্থার গতিকে আরও ত্বরান্বিত করা যাবে।প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের ব্যবহারের জন্য ‘হ্যালো টিচার’ নামে নতুন মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন (অ্যাপস) তৈরি করা হচ্ছে; যা অতিদ্রুত তৈরি করে শিক্ষার্থীদের ব্যবহার উপযোগী করে তুলতে হবে।

এই অ্যাপস ব্যবহার করে শিক্ষার্থীরা পছন্দের শিক্ষক বাছাই করে তার কাছ থেকে শিক্ষার বিষয়ে পরামর্শ নিতে পারবে। গণিত, ইংরেজি, বাংলা, বিজ্ঞানসহ নির্দিষ্ট বিষয়ের শিক্ষক বাছাই করে পাঠ সম্পর্কে বুঝতে ও জানতে পারবে। মন্ত্রণালয় বলছে, বেতারে পাঠ প্রচার শুরু হলে আরও ২০ থেকে ২৫ শতাংশ শিক্ষার্থীর কাছে পৌঁছানো যাবে।

তাই বেতারে পাঠ প্রচারের ব্যবস্থাও অতিদ্রুত শুরু করতে হবে, যাতে দেশের দুর্গম এলাকার শিক্ষার্থীরা মহামারীকালীন ও মহামারী পরবর্তী শিক্ষা ব্যবস্থার সাথে অতিদ্রুত যুক্ত হতে পারে। পাশাপাশি মুঠোফোন ব্যবহার করে হটলাইন সেবা চালু করতে হবে; যেখানে বেশ কিছু নম্বরে ফোন করে শিক্ষার্থীরা তাদের প্রয়োজনীয় বিষয়ে শিক্ষকসহ সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে জানতে পারবে।

মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের জন্য অতিদ্রুত বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি) বা কোনো পৃথক চ্যানেলের মাধ্যমে রুটিন মোতাবেক প্রতিদিন প্রতি শ্রেণির কমপক্ষে ১টি বিষয়ের ওপর ক্লাস টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচার করা প্রয়োজন।

যেমন- শনিবার সকাল ৯.০০-৯.৫০ পর্যন্ত ষষ্ঠ শ্রেণির ইংরেজি ক্লাস এবং ১০.০০-১০.৫০ পর্যন্ত সপ্তম শ্রেণির গণিত ক্লাস সরাসরি সম্প্রচার করা হবে। যেখানে ক্লাস শেষে কিছু হোমওয়ার্ক/টেস্ট দেয়া যেতে পারে; যা শিক্ষার্থী বাসায় বসে সমাধান করে রাখবে, সেটা পরের ক্লাসে শিক্ষক আলোচনা করবে এবং শিক্ষার্থী মিলিয়ে নিবে।

তাহলে শিক্ষার্থীর পড়াশোনার মনোভাব বাসায় বসেই করোনাকালীন বিরাজমান থাকবে এবং সেটা পরিবারের অভিভাবকরা ও নিকটস্থ শিক্ষক মনিটরিং এবং সহযোগিতা করতে পারবেন। পাশাপাশি উক্ত ক্লাসের অডিও রেডিও বেতারের মাধ্যমে প্রচার করে দুর্গম এলাকা যেখানে টেলিভিশনের সুবিধাও নেই সেখানেও শিক্ষার্থীদের মহামারীকালীন পড়াশোনার আওতায় আনা যাবে।

অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয় অনলাইন ক্লাস চালু করলেও স্বল্পমূল্যে দ্রুতগতিসম্পন্ন ইন্টারনেট সুবিধা ও ডিভাইস সমস্যার কারণে সেটা ফলপ্রসূ হচ্ছে না। তাই অতিদ্রুত সব মোবাইল কোম্পানির সঙ্গে আলোচনা করে প্রয়োজনে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষার্থীদের মোবাইল ফোন নাম্বার মোবাইল কোম্পানিগুলোতে এন্ট্রি করে দিনের একটি নির্দিষ্ট সময়ে বিনামূল্যে শিক্ষার্থীদের দ্রুতগতির ইন্টারনেট সুবিধা দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অনলাইন ক্লাস ফলপ্রসূ করা যেতে পারে।

অথবা বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সঙ্গে টেলিটক মোবাইল কোম্পানির মতো অন্য মোবাইল কোম্পানিগুলো আলোচনার ভিত্তিতে স্বল্পমূল্যে শিক্ষার্থীদের জন্য দ্রুতগতির ইন্টারনেট সুবিধা প্রদানের ব্যবস্থা করতে পারে। অন্যদিকে ডিভাইস ক্রয়ের জন্য সরকার প্রদত্ত শিক্ষাঋণ অতিদ্রুত যেন শিক্ষার্থীরা পেতে পারে সেই ব্যবস্থা করতে পারলে অনলাইন ক্লাসে শিক্ষার্থীদের অনেকেই অংশগ্রহণ করতে পারবে।

পাশাপাশি অনলাইনে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষিকাদের অনলাইন ক্লাসের ওপর ট্রেনিং প্রদান করা গেলে বিশ্ববিদ্যালয় লেভেলে মহামারীকালীন ও মহামারী পরবর্তী শিক্ষা ব্যবস্থা সচল রাখা সম্ভব হবে।

পাশাপাশি করোনাপরবর্তী শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়েও আমাদের এখনই ভাবা উচিত। করোনা মহামারীর এ সময়টা নিশ্চয়ই কেটে যাবে একদিন। আমাদের বন্ধ থাকা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আবার প্রাণচঞ্চল হয়ে উঠবে। শিক্ষক-শিক্ষার্থীমুখর হয়ে উঠবে প্রতিটি ক্যাম্পাস। কিন্তু করোনা পরবর্তী আগামীর শিক্ষা ব্যবস্থা কেমন হবে?

এক্ষেত্রে প্রথমেই খেয়াল করতে হবে কারিকুলাম পুনঃসংস্করণের দিকে। অর্থাৎ কমিউনিটি বেইজড বা ক্রাউড সোর্স কারিকুলাম তৈরি করতে হবে। কারণ জীবনমুখী, বাস্তবসম্মত ও প্রাকৃতিক শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দিতে হবে অনেক।

দক্ষতাভিত্তিক কারিকুলামের পাশাপাশি বাস্তবমুখী নানা কার্যক্রমও কারিকুলামে অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন; যার মাধ্যমে আগামী দিনে মহামারী এলে শিক্ষার্থীরাই প্রতিরোধে বেশ বড় ভূমিকা পালন করতে পারবে। অন্যদিকে শিক্ষার্থীদের পাঠ্যবইগুলো আরও যুগোপযোগী এবং বিস্তৃত করে তৈরি করতে হবে।

পাশাপাশি সময়ের সঙ্গে যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্য শিক্ষার্থীদের একুশ শতকের দক্ষতায় দক্ষ করে তুলতে হবে। একই সঙ্গে শিক্ষার্থীদের মানসিকভাবে আরও সুদৃঢ় ও আত্মপ্রত্যয়ী হওয়ার জন্য মনস্তাত্ত্বিক শিক্ষা খুব গুরুত্বপূর্ণ।

যেকোনো মহামারী রাষ্ট্রকে যেমন সমস্যায় ফেলে দেয়; তেমনই সমস্যা উত্তরণের জন্য অনেক সুযোগও তৈরি করে দেয়। তাই মহামারীকালীন ও মহামারী পরবর্তী শিক্ষা ব্যবস্থাকে পুনঃসংস্করণ করার মাধ্যমে বর্তমান সমস্যাগুলো সমাধান করে সম্ভাবনাগুলো কাজে লাগাতে হবে। সেজন্য সবার সমন্বিত উদ্যোগ ও প্রচেষ্টা খুবই জরুরি।

সরকারের পাশাপাশি ব্যক্তি উদ্যোগে শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও শিক্ষা সংশ্লিষ্ট সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। তবেই এ সময় কেটে যাবে এবং শিক্ষা ব্যবস্থার অগ্রগতির মাধ্যমে দেশের চলমান উন্নয়ন কর্মকাণ্ডকে আরও ত্বরান্বিত করা যাবে।

লেখক: শাহ জালাল মিশুক, সহকারী অধ্যাপক, নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগ, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।

প্রবাস বাংলা ভয়েস/ঢাকা/ ০৩ অক্টোবর ২০২০/এমএম

 


Array