Menu

প্রবাস বাংলা ভয়েস ডেস্ক ::  আজ আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস। প্রবীণদের অধিকার সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি করতে ১৯৯০ সালে জাতিসংঘ প্রতি বছর ১ অক্টোবর আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।

প্রবীণদের সুরক্ষা ও মৌলিক অধিকার নিশ্চিতের পাশাপাশি বার্ধক্যের বিষয়ে বিশ্বব্যাপী গণসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে ১৯৯১ সাল থেকে এ দিবসটি সারা বিশ্বে পালন করা হয়। জীবনের গল্পটাই এমন যে, এর শেষাংশে বার্ধক্যবরণ করতেই হয়।

আর জীবন সায়াহ্নে এসে সারা জীবন নিজের সামর্থ্যে দাপিয়ে বেড়ানো মানুষটাই শারীরিক দুর্বলতার সঙ্গে সঙ্গে সমাজে-সংসারে বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হয়। সমস্যার ধরন হতে পারে নানা রকম যেমন- শারীরিক, পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও মনস্তাত্ত্বিক।

আজ যারা উদ্যমী তরুণ প্রাণ, আগামী দিনে তারাই প্রবীণ হবেন। তাই সমাজের গুরুত্বপূর্ণ অংশ প্রবীণদের কথা গুরুত্ব দিয়ে ভাবা প্রয়োজন। প্রবীণদের শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিত না হলে একটি রাষ্ট্র কখনোই কল্যাণ রাষ্ট্র হতে পারে না।

জীবনের শেষদিকে এসে নানান কারণে প্রবীণদের গুরুত্ব কমে যায় পরিবার তথা সমাজ জীবনে। উপার্জন করার সামর্থ্য থাকে না বলে, বিশেষ করে পরিবারে বয়োঃবৃদ্ধ মানুষের গুরুত্ব কমে যায়। এর ফলে শুরু হয় অবহেলা, অযত্ন ও তাচ্ছিল্য।

ব্যক্তিগতভাবে আয়ের সুযোগ থাকে না বলে অভাব দেখা দেয় তাদের জীবনে এবং তখন তাদের জীবনধারণ করা, নিজের আশ্রয় ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করা দুরূহ হয়ে যায়। এজন্য তাদেরকে অন্যের ওপর নির্ভর করতে হয়।

যে মানুষটি সারা জীবন সবার জন্য অকাতরে দিয়ে যায়, তাকেই যখন জীবন সায়াহ্নে এসে নিজের প্রয়োজনের জন্য পরিবারের অন্য সদস্যদের দিকে হাত বাড়াতে হয়; তখন সে পরিস্থিতি প্রবীণদের মধ্যে হীনমন্যতার জন্ম দেয় বৈকি।

বিশ্বের উন্নত রাষ্ট্রগুলোয় সরকার প্রবীণদের গুরুত্ব দিয়ে তাদের কল্যাণার্থে নানা রকম সুযোগ-সুবিধা প্রদান করে থাকে। পাশাপাশি জাতিসংঘও প্রবীণ জনগোষ্ঠীর অধিকার সুরক্ষায় কতিপয় নীতিমালা প্রণয়ন করেছে। সেই ধারাবাহিকতার সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমাদের দেশের সরকারও বর্তমানে প্রবীণদের সমস্যা ও অধিকারের বিষয়গুলো গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করছে।

বিশ্বের উন্নত রাষ্ট্রগুলোয় ৬০ বা ৬৫ বছর বয়সের পর একজন মানুষকে প্রবীণ বা ‘সিনিয়র সিটিজেন’ হিসেবে গণ্য করা হয়। রাষ্ট্র তাদের বিশেষ সম্মান ও সুযোগ-সুবিধা প্রদানে সচেষ্ট থাকে। ২০১৩ সাল থেকে আমাদের দেশে প্রবীণ নীতিমালা চালু রয়েছে। সাধারণত ষাটোর্ধ্ব বয়সের মানুষকে প্রবীণ বলে গণ্য করা হয়।

কারণ ওই বয়সের পর মানুষ দৈনন্দিন জীবিকা উপার্জনের কাজ থেকে অবসর নেয়। তবে প্রবীণদের জীবনযাপনের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে এবং তাদের অধিকার, মর্যাদা সমুন্নত রাখতে নীতিমালা কোনো কাজে আসবে না; যদি না সমাজ তথা পরিবার জীবনে প্রবীণদের জন্য প্রজন্মের মধ্যে মূল্যবোধ জাগ্রত না হয়।

প্রজন্মকে অনুধাবন করতে হবে, আমরাও একদিন বৃদ্ধ হব। প্রজন্মকে মনে রাখতে হবে, বয়স বা অসুস্থতার কারণে কাজ করার সামর্থ্য হারিয়ে ফেলা প্রবীণরা তাদের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা দিয়ে আমাদের সাহায্য করতে পারেন। জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও অভিজ্ঞতার দিক থেকে প্রবীণরা আমাদের জন্য শুধু সম্পদ নয়, মূল্যবান মানবসম্পদ।

আর সেজন্যই প্রচলিত নাগরিক অধিকারের পাশাপাশি সমাজে প্রবীণদের জন্য কিছু বিশেষ অধিকার নিশ্চিত করা প্রয়োজন। প্রবীণদের প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটাতে হবে। অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ, প্রজ্ঞাবান এ প্রবীণ জনগোষ্ঠীকে কোনোভাবেই অপ্রয়োজনীয় বা বোঝা হিসেবে গণ্য করা উচিত হবে না।

বাংলাদেশের সমাজে একসময় যৌথ পরিবার কাঠামো ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিল। সে সময় পরিবার পরিচালনায় প্রবীণদের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম এবং পরিবারগুলোর শৃঙ্খলা ধরে রাখতে প্রবীণরা দারুণ ভূমিকা পালন করতেন। শিল্পায়ন, নগরায়ণ ও মানুষের অর্থনৈতিক জীবনধারার পরিবর্তনের ফলে যৌথ পরিবারের চর্চা ভেঙে একক পরিবারে অভ্যস্ততা বেড়ে যাচ্ছে।

একক পরিবারে তাই পরিবারের বৃদ্ধ মানুষগুলো আশ্রয় পাচ্ছে না; ফলে তাদের দেখাশুনা বা অসুখ-বিসুখে সেবাযত্নের লোকের অভাব ঘটছে। প্রবীণরা তাই নিঃসঙ্গতার শিকার হচ্ছেন এবং মানসিক অবসাদগ্রস্ততার শিকার হচ্ছেন। অনেক ক্ষেত্রে পরিবারে বৃদ্ধ মানুষটির আশ্রয় হলেও স্বামী-স্ত্রী উভয়েই কর্মজীবী হওয়ায় বাজার করা, গৃহস্থালি কাজ, শিশুদের দেখাশুনা; এমন কী শিশুদের স্কুলে পৌঁছানোর দায়িত্বও বর্তায় বয়োবৃদ্ধ মানুষটির ওপর।

এ বয়সে যদিওবা এ ধরনের কাজ করা তাদের জন্য কঠিন হয়; তথাপি প্রয়োজনের তাগিদে বাধ্য হয়ে প্রবীণরা এগুলো করে থাকেন। নিজস্ব রোজগারের সুযোগ না থাকায় এবং জীবনের সঞ্চয় উত্তরাধিকারীদের মধ্যে বণ্টিত হয়ে যাওয়ায় বেশিরভাগ প্রবীণই অর্থনৈতিকভাবে অসহায় হয়ে পড়েন। তাদেরকে সন্তান বা প্রজন্মের ওপর নির্ভরশীল হয়ে বাঁচতে হয়। নিজের ইচ্ছামতো তারা বিচরণ করার সুযোগ হারিয়ে ফেলেন। বিশেষ করে মধ্যবিত্ত বা দরিদ্র পরিবারের প্রবীণদের দুর্দশা এ ক্ষেত্রে বেশি হয়।

আমাদের দেশে প্রবীণরা নানা সমস্যার ভেতর দিয়ে বেঁচে থাকেন। সমাজে মূল্যবোধের বিপর্যয়, নৈতিক শিক্ষার অভাব ও স্বার্থান্বেষী চিন্তা-চেতনার কারণে প্রবীণদের মূল্যায়ন করা হয় না, দেয়া হয় না তাদের প্রাপ্য মর্যাদা। প্রবীণরা তাতে অস্তিত্ব সংকটে পড়ে যান।

বার্ধক্যজনিত কারণে আয়-রোজগার করতে না পারলে রাষ্ট্র থেকে সরাসরি সরকারি সাহায্য নিশ্চিত করা প্রয়োজন। সমাজে প্রবীণ ব্যক্তিদের অবদানের স্বীকৃতি দিতে সরকারকে সচেষ্ট থাকতে হবে। পাঠ্যপুস্তক, গণমাধ্যম, সভা, সেমিনার, আলোচনা সভা ইত্যাদির মাধ্যমে প্রবীণ ও নতুন প্রজন্মের মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরি করতে হবে এবং সঠিক মূল্যায়নের সুযোগ তৈরি করতে হবে।

পারস্পরিক সম্পর্কের উন্নয়ন ও বিকাশ ঘটানো, প্রত্যেক প্রজন্মকে তাদের বাবা-মা এবং প্রবীণ স্বজনদের সেবা প্রদানে উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিতকরণ কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে। জাতি, ধর্ম, বর্ণ, ভাষা, সম্পদ, মর্যাদা, লিঙ্গ, বয়স নির্বিশেষে রাষ্ট্রে প্রবীণ ব্যক্তিদের মৌলিক মানবাধিকার নিশ্চিত করা প্রয়োজন।

সমাজে প্রবীণ ব্যক্তিদের শিক্ষা, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয়, নৈতিক ও চিত্তবিনোদনমূলক কর্মকাণ্ডে প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করা প্রয়োজন। সামাজিক বিচ্ছিন্নতা কমানোর জন্য সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ বৃদ্ধির সুযোগ সৃষ্টি ও প্রবীণদের ক্ষমতায়নে সহায়তা প্রদান করা দরকার।

সব সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানে প্রবীণদের চলাচলের উপযোগী রাস্তা, নিরাপদে ও আরামে বসার মতো আসন ব্যবস্থা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। প্রবীণদের কষ্ট কমানোর জন্য পৃথক কাউন্টার স্থাপন করা প্রয়োজন। প্রবীণদের জন্য গ্রাম থেকে শহরে এলাকাভিত্তিক প্রবীণ ক্লাব স্থাপন করা যেতে পারে।

প্রবীণদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা প্রদান করতে পাড়ায় পাড়ায় প্রবীণ হেলথ ক্যাম্প করা যেতে পারে। প্রবীণ ব্যক্তিদের স্বাস্থ্য পরিচর্যা ও পুষ্টি নিশ্চিত করতে সরকারি-বেসরকারি সমন্বিত উদ্যোগের প্রয়োজন আছে। সমাজ ও পরিবারে প্রবীণ ব্যক্তিরা যাতে অবহেলা, অবজ্ঞা, বৈষম্য ও নিপীড়নের শিকার না হন- এর প্রতি গুরুত্বারোপ করা দরকার।

আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. এএসএম আতিকুর রহমানের একটি উক্তি প্রবীণদের জন্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ- ‘মানুষের জীবনের সঙ্গে আমরা অতিরিক্ত বছর যোগ করতে পেরেছি; কিন্তু বাড়তি বছরগুলোতে আমরা জীবন যোগ করতে পারিনি।’

বৃদ্ধ অবস্থায় পরিবারে প্রবীণদের অস্তিত্ব বোঝার মতো, আর তার বেঁচে থাকাটা অপ্রয়োজনীয় হয়ে যায়। সন্তানসন্ততি ও আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে আত্মিক সম্পর্ক ক্রমেই হ্রাস পেতে থাকে। অবহেলা-অযত্নের মধ্যেই প্রবীণদের মৃত্যুর প্রহর গুনতে হয়।

এ অবস্থাটা বড়ই মর্মান্তিক। জীবনের ক্রান্তিলগ্নে তাই মর্মান্তিক সময় যেন কাউকে ভোগ করতে না হয় সেজন্য ব্যক্তি, সমাজ ও সরকারকে একত্রে উদ্যোগী হতে হবে। তবেই একটি রাষ্ট্র হয়ে উঠবে কল্যাণ রাষ্ট্র এবং জীবনগুলো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে।

প্রবাস বাংলা ভয়েস/ঢাকা/ ০১ অক্টোবর ২০২০/এমএম


Array