Menu

জয়দীপ সান্যাল, ক্যালগেরি, কানাডা :: “প্রতিটি ক্রিয়ার একটি সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে” । মহাগুরু নিউটন কী ভেবেছিলেন তাঁর তৃতীয় সূত্রের ব্যাপ্তি হবে বিজ্ঞান ছাড়িয়ে রাজনীতি ও অর্থনীতিতে? এক দেশের নেতিবাচক আচরণে পাশের দেশে হবে ইতিবাচক ফলাফল?

বছর পাঁচেক আগেও ভারত রপ্তানি বন্ধ করলে কিংবা কমিয়ে দিলে বাংলাদেশে কোরবানির হাটে গবাদি পশুর দাম সাধারণের নাগালের বাইরে চলে যেত । সরকারী পরিকল্পনায়, পশুবিদদের গবেষণায় আর সর্বোপরি বাংলার দামাল খামারিদের অক্লান্ত প্রচেষ্টায় দেশ আজ মাংসে স্বয়ং সম্পূর্ণ । সাশ্রয় হচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রার । পশু আমদানি বন্ধের সুফল যেমন পাচ্ছে এখন বাংলাদেশ, ঠিক ততটা দুর্ভোগ পোয়াচ্ছে ভারত। রপ্তানি আয় কমার পাশাপাশি তাদের ব্যয় করতে হচ্ছে বিশাল অঙ্কের রুপিয়া, মৃত গবাদি পশুর পরিবেশ বান্ধব শব-ব্যবস্থাপনায়। ফরমালীনযুক্ত অন্ধ্র প্রদেশের সুবিশাল রুই আমদানি বন্ধ হওয়ায় আজ দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে মাছ রপ্তানির পর্যায়ে বাংলাদেশ । এমনকি স্নাতকোত্তর অসংখ্য যুবকের প্রধান জীবিকা এখন মাছের বাণিজ্যিক চাষ আর ব্যবসা ।

আমার জন্ম ও বেড়ে উঠা ছোট শহর নাটোরে । স্কুল জীবনে একুশের প্রভাত ফেরীতে শিক্ষালয়, সংগঠন আর পাড়া-মহল্লার সুস্থ প্রতিযোগিতা কতই না উপভোগ করেছি । কাদের মালা কত বড়, কত সুন্দর এই আর কি ! ! ফুলের যোগাড় ছিল তখন এক বিশাল ব্যাপার। সম্পর্ক রাখতে হত বাগানবাড়ীর ছেলে-মেয়েদের সাথে। নয়তো ফুল চুরি। নজরুলের “লিচু চোর” ছিল আমাদের আদর্শ। বসন্ত বাতাসে তখন খুব কম ললনাদের খোপায় দেখতাম বেলী, জুঁই আর গাঁদা ফুলের মালা । ভ্যালেন্টাইনস ডে, মা-দিবস, বাবা দিবসের কোন ধারণাই ছিলনা ভাগ্যিস। গোলাপ গাছের খবর হয়ে যেত তাহলে।

প্রথমে শুরু ধান গাছের ফাঁকে ফাঁকে আইল ধরে রজনীগন্ধার এক অভিনব আবাদ। যশোর থেকে শুরু করে প্রায় সব জেলায়, গ্রামে, গঞ্জে কয়েক দশক ধরে বাণিজ্যিক ভাবে চলছে রকমারি ফুলের চাষ। এর সাথে বিপণন ব্যবস্থাপনায় এসেছে উন্নতি আর ফুল ব্যবসায়ীদের মাঝে নান্দনিকতার ছাপ । শহীদ মিনার থেকে শুরু করে বর্ষবরণ, বসন্ত উৎসব, ভালবাসা দিবস, বিয়ে, গায়েহলুদ, জন্মদিন, ধর্মীয় অনুষ্ঠান, অফিস, সমিতি, রাজনৈতিক সভা, মিছিল, শব-যাত্রা, সর্বত্র আজ বাহারি ফুলের মনোহর ব্যবহার। সৌখিনতার এত সব আয়োজনের চাহিদা মেটাচ্ছে কী আমদানি করা ফুল?

আশির দশকে ভারতে বেড়াতে গেলে আপেল, কমলা, আঙুর, বেদানা খেয়েছি অনেক । পাড়ার অনেকেই ভারত ভ্রমণ শেষে কাস্টমসকে ম্যানেজ করে সস্তায় বাক্স ভরা ফল আনতেন । মাঝে মাঝে ভাগ পেতাম স্নেহধন্য হয়ে। ধর্মঘটসহ নানা বাধা-বিপত্তির মাঝে আমদানি করা ফলের অনেকটাই পচে যেত কখনও সীমান্তে, নাহলে বন্দরে । সময় মত ছাড় পেতে দিতে হত উপরি-মালকড়ি। বিদেশি ফলের দাম হয়ে যেত আকাশ চুম্বী । মেধাবী উদ্যোক্তা আর সাহসী কৃষকের উপর ভর করে ফল চাষেও বাংলাদেশে চলছে নীরব বিপ্লব, বেশ কিছু বছর ধরে । দেশে উৎপাদিত স্ট্রবেরি আর ড্রাগন ফল খেলাম ঢাকায় ২০১৮ সালে । জেনে খুশি হলাম ক্যাপ্সিকাম, ব্রোকলী, মাস্রুম আর এভোকেড আসছে বাজারে, সৌখিন চাষের বদৌলতে।

তবুও আমরা পিছিয়ে থাকব পেঁয়াজ ফলনে? আমাদের কেন অপেক্ষা করতে হবে ভারতের পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করা পর্যন্ত? সরকারের উচিত বছর বছর শুল্ক বাড়িয়ে ক্রমান্বয়ে পেঁয়াজ আমদানি বন্ধ করা । “কম খাব, তবু কিনবো দেশী পেঁয়াজ“ এই হোক আজকের আহ্বান। চাহিদা যেখানে থাকবে বাড়ন্ত, দেশি চাষ সেখানেই হবে পয়মন্ত । সেই সাথে সংরক্ষণের বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থা নিলে আগামী পাঁচ থেকে সাত বছরের মধ্যেই কোন সময় আর পেঁয়াজ আমদানির প্রয়োজন হবেনা। সারা বছর দাম থাকবে সহনীয় মাত্রার মধ্যে। এর পাশাপাশি রসুন ও মসলা চাষ বৃদ্ধি ও গবেষণার কার্যকরী ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন ।

কথায় ও লেখায় সস্তা ভারত বিরোধিতা বাদ দিয়ে আজ সময় এসেছে এসব প্রচারের, জনমত গঠনের। অর্থনীতিকে রাজনীতির সাথে যুক্ত করতে পারলে বাণিজ্যিক বৈষম্য আর দাদাগিরির জুজুর ভয় পালানোর পথ পাবেনা । আমার মা’র মত গিন্নিও বলেন, আমি নাকি অতি আশাবাদী মানুষ। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, এখানেও জয় হবে বীর বাঙালীর। সাম্প্রতিক ইতিহাস-ও কিন্তু তাই বলে ।

প্রবাস বাংলা ভয়েস/ঢাকা/ ২০ সেপ্টেম্বর ২০২০/এমএম


Array