প্রবাস বাংলা ভয়েস ডেস্ক :: টিকটক হালের ট্রেন্ড, আমরা অনেকেই জানতাম না এটার কথা, কিংবা জানলেও ধারণা করতে পারিনি এ অ্যাপটা কতটা জনপ্রিয় এবং কতটা প্রভাবশালী। চীন-ভারত বৈরিতার কারণে ভারত-চীনের বেশকিছু অ্যাপের সঙ্গে টিকটক অ্যাপটি নিষিদ্ধ করার পর অনেকেই এটার কথা জানতে পারি। পরে অবশ্য আমেরিকাতেও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এ অ্যাপের বিরুদ্ধে অনেক কিছু করেছেন।
‘টিকটক তারকা’ অপু মারামারি করে পুলিশের হাতে ধরা পড়ায়, আদালতে যাওয়ায় এবং মুক্তি পাওয়ায় আমরা অনেকেই জানতে পারলাম বাংলাদেশেও অনেকে ‘টিকটক করে’ এবং আমাদের দেশেও ‘টিকটক তারকা’ আছে। ফেসবুকে একটা পর্যায়ে অপুর অপরাধ নয়, টিকটক করা মানুষদের তারকা হওয়া এবং তাদের কর্মকাণ্ড নিয়ে নানারকম আলোচনা তর্ক-বিতর্ক শুরু হয়ে যায়। টিকটক তারকাদের নিয়ে কথা বলার আগে একটু পেছন ফিরে যাই। ওই সময় একই রকম পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল আরেকজন ব্যক্তিকে নিয়ে।
২০১৭ সালের ২৬ এপ্রিল এএফপির বরাত দিয়ে যুক্তরাজ্যের বিখ্যাত আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম ডেইলি মেইল সাহিত্যিক কাসেম বিন আবু বাকারকে নিয়ে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে। রিপোর্টের শিরোনাম ছিল ‘Islamic romance novels set hearts aflutter in Bangladesh’।
এরপর এ রিপোর্টকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্রের ইয়াহু নিউজ, মধ্যপ্রাচ্যের আরব নিউজ, মালয়েশিয়ার দ্য স্টার ওমালয় মেইল, পাকিস্তানের দ্য ডন, ফ্রান্সের ফ্রান্স টুয়েন্টি ফোর ও রেডিও ফ্রান্স ইন্টারন্যাশনাল, হাঙ্গেরির হাঙ্গেরি টুডে ইত্যাদি সংবাদমাধ্যম তাকে নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে।
লেখালেখি নিয়ে কয়েক দশক থাকলেও বাংলাদেশের মূল ধারার মিডিয়া তাকে নিয়ে রিপোর্ট করেনি; কিন্তু এতগুলো আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় খবর হওয়ার পর বাংলাদেশের মূল ধারার সব মিডিয়া তাকে নিয়ে রিপোর্ট করে।
বিক্রির পরিমাণ দিয়ে যদি বেস্ট সেলার বই এবং বেস্ট সেলার লেখক নির্ধারণ করা হয়, তাহলে সেখানে সবার আগে নাম থাকবে কাসেম বিন আবু বাকারের। হুমায়ূন আহমেদের বই যে পরিমাণ বিক্রি হয়েছে তার চেয়ে বহু গুণ বেশি পরিমাণ বিক্রি হয়েছে তার বই। তার লেখা সবচেয়ে বিখ্যাত বই ‘ফুটন্ত গোলাপ’ বিক্রি হয়েছে দশ লক্ষাধিক কপি, যা বাংলাদেশের অন্য কোনো জনপ্রিয় লেখকের সর্বাধিক বিক্রীত বইয়ের চেয়ে বহুগুণ বেশি।
কাশেমের পরিচয় দেয়ার সময় আমি যে ‘সাহিত্যিক’ শব্দটি লিখেছি, সেই সময় এ শব্দটি নিয়ে তুমুল তর্ক-বিতর্ক হয়েছিল সোশ্যাল মিডিয়ায়। শিল্প-সাহিত্য খোঁজখবর রাখেন, তেমন মানুষদের প্রায় সবাই এ ভদ্রলোককে সাহিত্যিক বলে স্বীকার করতেই নারাজ ছিলেন।
সেই সময়? তার লেখার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার জন্য তার সর্বাধিক পঠিত বই ‘ফুটন্ত গোলাপ’ আমি নিজেও পড়েছিলাম। বইটি আমার ভালো লাগেনি, বইটি আসলে আমার মতো মানুষকে মাথায় রেখে লেখাও হয়নি।
টিকটক বাংলাদেশে, বিশেষ করে কিশোর-তরুণদের মধ্যে কতটা ছড়িয়েছে আমার জানা ছিল না। আমার টিকটক অ্যাকাউন্ট নেই। টিকটক অপুকে নিয়ে সংবাদ প্রকাশিত হওয়ার পর ভিডিও চ্যানেল ইউটিউবে গিয়েছিলাম তার ভিডিও দেখার জন্য। গিয়ে দেখলাম সেখানে আরও টিকটক তারকা আছে।
তাদের বানানো ভিডিওর অনেক দেখলাম। ভালো লাগেনি আমার। কিন্তু ইউটিউবে দেখেছি তাদের এসব ভিডিওর অনেক ভিউ। অর্থাৎ আমি দেখি বা না-ই দেখি, তাদের ভিডিও দেখার মতো লক্ষ লক্ষ কিশোর-তরুণ আছে এ দেশে। সেই অর্থে তারা নিশ্চয়ই তারকা।
সমস্যা হচ্ছে, এ তারকাদেরও আমরা মেনে নিতে পারছি না। তারা কী বলছে থেকে শুরু করে তাদের চুলের দৈর্ঘ্য এবং রং আমাদের প্রচণ্ড উৎপাত করছে। আমরা তাদের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছি। মনে করছি এ সমাজকে উচ্ছন্নে নিয়ে যাবে এ কিশোর-তরুণরা।
এ প্রবণতা শুধু ফেসবুকীয় আমজনতার নয়, রীতিমতো ‘বিজ্ঞ’ কলাম লেখকরাও কলম ধরেছেন তাদের বিরুদ্ধে। বিদ্বেষ শেষ পর্যন্ত তারকাকে ছাপিয়ে গেল, রীতিমতো আচ্ছন্ন করে ফেলল অ্যাপটিকেই। এ দেশের খুব স্বনামধন্য একজন গায়িকা ফেসবুকে স্ট্যাটাসে হুমকি দিয়ে রেখেছেন- তার বন্ধু তালিকায় কেউ টিকটক ভিডিও তৈরি করা মাত্রই তাকে আনফ্রেন্ড করে দেবেন।
কাশেম বিন আবু বাকারকে সাহিত্যিক হিসেবে মেনে নিতে আমাদের আপত্তি ছিল কেন? কেনই বা জনপ্রিয় ধারার উপন্যাস লেখা হুমায়ূন আহমেদের কিছু সমালোচনা থাকলেও তাকে সাহিত্যিক হিসেবে স্বীকৃতি দিতে আমাদের আপত্তি ছিল না?
আসলে হুমায়ূন আহমেদকে আমরা সাহিত্যিক হিসেবে পছন্দ করি বা না করি এটি আমরা জানি, তিনি লিখেছেন এ দেশের শিক্ষিত-মধ্যবিত্ত শ্রেণির জন্য, আর কাশেমের লেখা ছিল ভিন্ন একটি শ্রেণির জন্য। সুতরাং সেই শ্রেণির জন্য লেখা বই ১০ লক্ষ বিক্রি হোক কিংবা কটি তাতে সাহিত্যিক তকমা কেন পেতে হবে?
যে শ্রেণিটির জন্য কাসেম বিন আবু বাকার লিখেছিলেন, সম্ভবত সেই শ্রেণিটির জন্যই ভিডিও বানায় টিকটক অপু কিংবা টিকটক মামুন। টিকটক অপু গ্রেফতার হওয়ার পর তার জীবন সম্পর্কে আমরা জানতে পেরেছি।
নোয়াখালীর প্রত্যন্ত গ্রামের মাদ্রাসায় কিছুদিন পড়া ছেলেটি ঢাকায় এসে একটা চুল কাটার দোকানে কর্মচারী হিসেবে কাজ করত কিছুদিন। তারপর সে টিকটক ভিডিও বানাতে শুরু করে। তার শরীরে ক্রনিক অপুষ্টির ছাপ আছে, তার ভাষা আমাদের মতো মার্জিত নয়। এমন একজন তরুণের বিখ্যাত হওয়া কিংবা তারকা হওয়া আমরা কেন মেনে নেব?
পৃথিবীর কোন পণ্য, সেটি সাহিত্য হোক কিংবা পোশাক, সব মানুষের জন্য তৈরি হয় না। প্রতিটি পণ্যের একটা নির্দিষ্ট টার্গেট গ্রুপ থাকে। সেই টার্গেট গ্রুপের জন্যই তার রুচিমতো পণ্য তৈরি হয়। তাহলে রুচি যখন কোনো কিছুর বাজার পাওয়ার মানদণ্ড, তখন রুচির মধ্যে ভেদাভেদ তৈরি করা কি যৌক্তিক?
রুচির কি মানদণ্ড হতে পারে? মানদণ্ড থাকলে সেটি ঠিক করার কর্তৃপক্ষ কে? আর কেউ যদি রুচির মানদণ্ডটিই না মানে? কাসেম বিন আবু বাকারের উপন্যাস কিংবা টিকটক তারকাদের ভিডিও আমার ভালো না লাগা প্রমাণ করে আমি অবশ্যই সেই শ্রেণিটির অংশ নই যাদের জন্য এগুলো সৃষ্টি করা হয়েছে।
এসব লেখা কিংবা ভিডিওর নানা দিক নিয়ে আমার সমালোচনা আছে; সেটি করবও হয়তো কোনোদিন। কিন্তু আমি কোনোভাবেই এদের নাকচ করি না। সেটি করার আমি কে? কিংবা আপনি?
ফরাসি দার্শনিক পিয়েরে বর্দিউ সোশ্যাল সায়েন্সে অনেক গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। সোশ্যাল এবং কালচারাল ক্যাপিটাল নিয়ে তার তত্ত্ব খুব গুরুত্ব দিয়ে পাঠ করা হয় সমাজবিজ্ঞানে।
তবে তার একটি বই ‘ডিস্টিংসন: আ সোশ্যাল ক্রিটিক অব দ্য জাজমেন্ট অব টেইস্ট’ সম্পর্কে জানাশোনা খুব বেশি না; কিন্তু এ বইটি তার অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ। আমরা জেনে রাখি ইন্টারন্যাশনাল সোসিওলজিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের বিচারে এ বইটি বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ ১০টি সোসিওলজি বইয়ের একটি হিসেবে বিবেচিত হয়েছে।
আলোচ্য বইয়ে বর্দিউ আমাদের জানান, রুচি কোনো বিচারই ইনোসেন্ট নয়, কারণ এক শব্দে আমরা সবাই উন্নাসিক। আর এ উন্নাসিকতা সবচেয়ে বেশি মধ্যবিত্তদের মধ্যে। কারণ তার ‘সাংস্কৃতিক পুঁজি’ বেশি। সাংস্কৃতিক পুঁজি (শিক্ষা, মননশীলতা, ভাষার দখল, বাচনভঙ্গি, পোশাক ইত্যাদি) যাদের বেশি, রুচি সম্পর্কে তাদের সিদ্ধান্তই সমাজে ডমিনেইট করার প্রবণতা দেখায়। এ প্রবণতাকে তিনি রীতিমতো ‘সিম্বলিক ভায়োলেন্স’ বলেছেন।
বর্দিউ এ প্রবণতার কারণও ব্যাখ্যা করেছেন। পৃথিবীব্যাপী মধ্যবিত্তের মননে সবসময় কাজ করে, তারা কীভাবে তাদের শ্রেণিটিকে অন্যদের চেয়ে আলাদা করে তুলতে পারে। এজন্যই এ রকম পরিবারে জন্ম নেয়া প্রতিটি শিশুকে ছোটবেলা থেকে শিক্ষা দেয়া হয়, কোনটা রুচিশীল, আর কোনটা সেটি নয়।
একদিন এ শিশুটি বড় হতে থাকে, তাকে তার শ্রেণির অনেকেই একই ধরনের শিক্ষা ক্রমাগত দিতে থাকে, আর এভাবেই সে আর সব শ্রেণির রুচিকে স্রেফ নাকচ করে দিতে শিখে যায়। রুচি মাপার জন্য তার মানদণ্ডকেই সে সার্বজনীনতা দিয়ে দেয়, সেই মাপে অন্য রুচি ‘নিচু’ কিংবা ‘কোনো রুচিই নয়’।
আর সবচেয়ে বড় সমস্যা থেকে যায় নিজেদের এ গণ্ডির বাইরে অন্যরা হয়ে পড়ে ‘অপর’; তাদের কণ্ঠস্বর আমাদের কান পর্যন্ত পৌঁছানোর ক্ষমতা তাদের আর হয় না। কেউ শেষ চেষ্টা করলেও আধিপত্যবাদের মাধ্যমে আমরা তাদের নাকচ করে দেই।
ফেসবুকে কাসেম বিন আবু বাকার কিংবা টিকটক তারকাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়া ‘বিশিষ্ট’ কলাম লেখক বা ফেসবুকে ট্রল করা ‘শিক্ষিত’ মধ্যবিত্ত সবাই এ আধিপত্যবাদের ব্যাধিতে আক্রান্ত। হ্যাঁ, আমি এটাকে ব্যাধিই মনে করি।
কাসেম বিন আবু বাকারের লেখার কিংবা টিকটক তারকাদের ভিডিওর প্রভাব কী, যারা পড়ছেন-দেখছেন তাদের মনস্তত্ত্ব কী, তাদের এসব সৃষ্টির কী প্রভাব ব্যক্তি এবং সমাজের ওপর পড়বে, সেটি নিয়ে আলোচনা চলাই উচিত। সত্যিই এগুলো একাডেমিক ডিসকোর্স দাবি করে। আর সেটি হওয়া উচিত বর্দিউ বর্ণিত ‘মধ্যবিত্তীয় উন্নাসিকতা’ থেকে মুক্ত হয়ে।
ডা. জাহেদ উর রহমান : শিক্ষক, অ্যাক্টিভিস্ট
প্রবাস বাংলা ভয়েস/ঢাকা/ ১২ সেপ্টেম্বর ২০২০/এমএম





