Menu

প্রবাস বাংলা ভয়েস ডেস্ক :: একজন মানুষ কতক্ষণ পানিতে ডুবে থাকতে পারে, তা নিয়ে বিশেষজ্ঞদের বিভিন্ন মত রয়েছে। কারও মতে, একজন সুস্বাস্থ্যের অধিকারী মানুষ সর্বোচ্চ দুই মিনিট বেঁচে থাকতে পারে। তবে কেউ যদি অনুশীলনের মাধ্যমে ফুসফুসের ধারণক্ষমতা বাড়াতে পারেন, তাহলে তিনি ৯ মিনিট পর্যন্ত দম বন্ধ করে থাকতে পারবেন। অবশ্য ডুবুরিরা স্কুবা পদ্ধতিতে অক্সিজেন সিলিন্ডার পিঠে করে পানির নিচে ৩-৪ ঘণ্টা পর্যন্ত থাকতে পারেন।

এ বিষয়ে আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা রয়েছে। ২০১৮ সালের ৩১ আগস্ট আমরা সপরিবারে ২৪-২৫ জন চলনবিলে নৌভ্রমণে যাই। নৌকাটি স্রোতের পাকে পড়ে হঠাৎ তলিয়ে গেলে আমার স্ত্রীসহ পাঁচজনের অকাল মৃত্যু ঘটে (দুঃখজনক এ ঘটনাটিকে এলাকার মানুষ নাম দিয়েছেন ‘চলনবিল ট্র্যাজেডি’)।

আমি আমার ৭ম শ্রেণি পড়ুয়া কন্যাকে উদ্ধার করতে গেলে সে আমার গলা জাপটে ধরে। ফলে তাকে নিয়ে তলিয়ে যেতে থাকি। একপর্যায়ে বুঝতে পারি আমার নাক-মুখ দিয়ে পানি ঢুকছে এবং নাসারন্ধ্র বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। আমি নির্মমভাবে দ্রুত তার জড়িয়ে থাকা হাত থেকে নিজেকে মুক্ত করি।

সাঁতার জানা থাকার কারণে দ্রুত পা চালিয়ে পানির উপরে মাথা ভাসিয়ে প্রথমে মুখ দিয়ে শ্বাস নেই এবং কিছুটা স্বস্তিবোধ করলে মেয়েকে ভাসিয়ে রাখার চেষ্টা করি (উদ্ধারকারী নৌকা না এলে সেদিন অন্তত ১০ জনের সলিল সমাধি ঘটত)। আমি সেদিন কতক্ষণ পানির নিচে ছিলাম, তা সঠিক মনে করতে না পারলেও ধারণা করতে পারি প্রায় ৩০-৩৫ সেকেন্ড ছিলাম। পরে ঠাণ্ডা মাথায় পরীক্ষা করে দেখেছি, প্রায় ৫০ সেকেন্ড পানির নিচে দম বন্ধ করে থাকা যায়।

তবে সেদিন ভেসে থাকা যাত্রীদের আর্তনাদ কানে আসায় একটি স্নায়বিক চাপ সৃষ্টি হয়েছিল। তখনকার অস্বাভাবিক পরিস্থিতি কিছুটা সামলে নিতে পেরেছিলাম বলেই প্রায় ২-৩ মিনিট ভেসে থাকতে সক্ষম হয়েছিলাম। সেদিন আমার স্ত্রী ছাড়াও মারা যান আরও চারজন। আমার বিশ্বাস, ঘটনার আকস্মিকতায় তারা যদি আতঙ্কগ্রস্ত না হতেন, তাহলে কেউ কেউ বেঁচে যেতেন, যেহেতু তাদের মধ্যে চারজনই সাঁতার জানতেন।

এদেশে প্রতি বছর পানিতে ডুবে কতজনের মৃত্যু হয় তার সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া যায় না। তবে গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চের এক গবেষণায় জানা যায়, দেশে প্রতি বছর পানিতে ডুবে প্রায় ১৯ হাজার শিশু মারা যায়। পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যুর কারণ মূলত- প্রচুর জলাশয়, পুকুর, নদী, ডোবা-খাল-বিল থাকা; শিশুদের যথাযথ দেখভাল না করা; শিশুদের সাঁতার না জানা এবং তাৎক্ষণিক প্রাথমিক চিকিৎসাজ্ঞান না থাকা।

বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। এদেশের স্থানীয় কারিগররা দীর্ঘকাল থেকে নদীর গতিপথ, স্রোতের গতিবেগ ইত্যাদি বিবেচনায় নিয়ে উপযুক্ত টেকসই কাঠ দিয়ে নৌকা তৈরি করে আসছেন। এসব নৌকা ডুবে গেলেও ভেসে থাকে। ডুবন্ত মানুষ তখন নৌকা ধরে কিছুক্ষণ বেঁচে থাকতে পারে।

বর্তমানে নৌকার মাঝিরা স্থানীয় ওয়ার্কশপ থেকে স্টিলের সিট দিয়ে নৌকা তৈরি করে থাকেন। ফলে কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে নৌকাটি দ্রুত তলিয়ে যায় (আমাদের ক্ষেত্রেও এমনটি ঘটেছিল)। জাতীয় পর্যায়ে চলাচলকারী লঞ্চ-স্টিমারগুলো তত্ত্বাবধান করার জন্য বিআইডব্লিউটিএ রয়েছে; কিন্তু খাল-বিল-হাওরে চলাচলকারী নৌযান দেখাশোনার জন্য কোনো নির্দিষ্ট কর্তৃপক্ষ নেই। গত বছর নাটোর হালতি বিলে পর্যটকবাহী একটি নৌকা ডুবে গেলে একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক মারা যান।

এ ঘটনার পর পর্যটকবাহী নৌকায় নিরাপত্তা সামগ্রী নিশ্চিত করার জন্য আমি প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে আবেদন করি। এরপর নাটোরের জেলা প্রশাসক নৌকার মাঝিদের মাঝে লাইফ জ্যাকেটসহ বিভিন্ন নিরাপত্তা সামগ্রী বিতরণ করেন। দেশের অন্যান্য জেলা প্রশাসকরাও যদি এমন উদ্যোগ নেন, তাহলে নৌকার মাঝি ও যাত্রীদের মধ্যে এ ব্যাপারে সচেতনতা সৃষ্টি হবে।

মোশাররফ হোসেন মুসা : গবেষক

প্রবাস বাংলা ভয়েস/ঢাকা/ ০১ সেপ্টেম্বর ২০২০/এমএম


Array