Menu

মো মাহমুদ হাসান, ক্যালগেরি, আলবার্টা, কানাডা :: মাঝে মাঝে সবকিছুই কেমন যেন এলোমেলো হয়ে যায়। কোন পরিকল্পনাই গতি পায় না। পেছনের কারনগুলো শারিরীক না মানসিক তাও বুঝতে পারি না। ভাবনার জগতে সাহিত্য যেমন আসে না পারিপার্শ্বিক সামাজিক, অর্থনৈতিক কোন সমস্যা ই আমাকে আলোড়িত করে না। এমনতর সময়ে একাকিত্ব কে ই বড় বেশী নিরাপদ মনে হয়।

শুনেছি অসামাজিক মানুষগুলো একা থাকতে ভালোবাসে। নিরাপদ একাকিত্ব কোন ব্যক্তিকেন্দ্রিক মানসিকতার লক্ষন নয়তো? আমি কোন সফল মানুষ নই, তবে ত্যাগ আমায় দারুণ প্রশান্তি দেয়। নিন্দুকেরা নিশ্চয় জানতে চাইবেন ‘কোন তাজমহল’ বানিয়েছো? বিনয়ের সাথে বলবো-জীবনে আমার বহু কর্মঘন্টা পর-কল্যাণে বিনিয়োগ কি ত্যাগ নয়। নিজের উল্লেখযোগ্য কোন পরিচয়, পদবি না থাকলেও অন্যের পরিচয়ে পরিচিতি পাওয়া, আমার দারুণ অপছন্দ, যদিও শিক্ষক পিতার সন্তান হিসেবে ব্যতিক্রমী গর্ববোধ আছে। “পরিচয় বিড়ম্বনা” নিয়ে আমার ভিন্ন একটি লিখায় জীবনের বিড়ম্বনাকেও খুঁজে পাবেন।

জীবন চলার পথে বহু সুখস্মৃতি আছে, অনেক অনেক ভালো মানুষের সান্নিধ্যে বহু হতাশা জয়ের গল্প আছে, তবুও মাঝে মাঝে হাহাকার সম এক শূন্যতা কেন আমায় গ্রাস করে? গুনিজনরা বলেন, সুস্পষ্ট লক্ষ্য নিয়ে দৃঢ় সংকল্পে এগিয়ে গেলে সফলতা আসে – বিশ্বাসে সন্ধি মেলে তর্কে বহুদূর। ক্ষমতার বাহাদুরি নেই, অর্থের আধিপত্য নেই, পদস্ত কর্তার গাম্ভীর্য নেই, নেই কোন মাসলম্যানের লম্পজম্প-এমন সমাজে বাস করে ও কেন আমি আজ বিষন্ন!

অনেক সফল মানুষের ও সব প্রত্যাশা পূরন হয় না, তবে কিছু অপূর্ণতা চিরস্থায়ী বেদনার কারণ হয়ে থাকে। জীবনের প্রতিটি অধ্যায়কে উপভোগ করাই আনন্দ। আবার সত্য বিবর্জিত আনন্দে কোন স্তায়ী সুখ নেই। সত্য এক ভয়ানক মারণাস্র, যদি সেটি সর্বসাথী হয়, অন্ধকার আপনাকে দেখে পালিয়ে যাবে, সাময়িক বিপদগ্রস্ত হলেও, চুড়ান্ত বিচারে প্রচন্ড আত্মবিশ্বাসই আপনাকে বিজয়ী করবে।

কর্মে সূখের সন্ধান-এটিই আমার ভিত্তি। আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থায় তেরো বছরের কর্ম জীবনে গবেষণার কাজে বৈশিষ্ট্যগত কারণেই অফুরন্ত অবসরের সুযোগ থাকলেও আমার সকাল সন্ধ্যা ব্যস্ততাই আমাকে আনন্দ দিয়েছে, নিয়মিত কাজের পাশাপাশি গবেষণা সহযোগীদের প্রশিক্ষকের অতি ব্যস্ত ভূমিকা, আমার কাছে দারুণ উপভোগ্য ছিলো। প্রতি দুমাস অন্তর প্রত্যন্ত অঞ্চলে কাজ করা শত শত গবেষণা সংশ্লিষ্ট অনুসন্ধানী প্রিয়জনদের সামনে দাঁড়িয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা, দিনের পর দিন মত বিনিময়ের এমন বিরল সুযোগ ক’জনেরই সৌভাগ্য হয় বলুন! আর সেই সাথে বৈষয়িক প্রাপ্তিযোগ তেমন না থাকলেও অনেক দেশী-বিদেশী কাগুজে স্বীকৃতি তো এখনও সযত্নে ফাইলবন্দী।

বাংলা অভিধানের “তদবির” শব্দটি আমার বড়ই ঘৃনা ও অপছন্দের, তবুও আমি তদবিরবাজ! পেশা নয়, তদবির আমার নেশা। এ আবার কোন বৈপরীত্য!! ঘৃনা আর অপছন্দ! আবার নেশা হয় কেন? হ্যাঁ, সত্যি বলছি, এ নেশায় যাদু আছে, সফল হলে তা বড়ই উপভোগ্য ও প্রশান্তির। যে মাটিতে সাম্যের কবি বিদ্রোহী হয়, সেখানে আমার বৈপরীত্য বেমানান কোথায়? তাই সুযোগ পেলেই, আমি তদবির করে বেড়াই। একান্ত নিকটজনের ন্যায্য অধিকার এর কোন তদবিরও আমার কাছে বিদঘুটে লাগে, তাই বর্জন করি। নিজের জন্য তদবির, গত তিন দশকের ইতিহাসে মাত্র একটি, তা নিয়ে কোন দৈন্যতা নেই, তবে নিয়ত কৃতজ্ঞতা আছে। আমার লেখাপড়া না জানা কৃষক ভাই যাতে বিনা ঘুষে ঋন পায়, সেজন্য আমি তদবির করি, বয়োবৃদ্ধ শিক্ষক যেন বিনা হয়রানিতে পেনশনের সুবিধা ভোগের সুযোগ পায় সেজন্য আমি তদবির করি। রডের বদলে বাঁশ না দিতে প্রকোশলীর কাছে, নিগৃহীত বোনটি যেন সুবিচার পায় সেজন্য সমাজপতির কাছে তদবির করি। স্কুলের পাশে খাল, শিশুদের আজীবনের দুঃখ দূর করতে একটি কালভার্টের দাবিতে চেয়ারম্যান, এমপির কাছে তদবির করি। ইয়াবায় সয়লাব হয়ে যাওয়া সমাজে আইনের শাসন নিশ্চিত করতে পুলিশ কর্তার কাছে তদবির করি। রকমফেরের এই তদবিরে কখনো সফল, কখনও বা ব্যর্থ হই তবে ক্লান্ত হই না। প্রত্যন্ত অঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধা সন্তান, এক টেলিভিশন সংবাদ কর্মির ন্যায্য পারিশ্রমিকের তদবির, ছয় মাসের ও বেশি আজ ও সফল হইনি, তবে থেমে যাইনি। গত ত্রিশ বছর যাবত কত নেতা, এমপি-মন্ত্রীর কাছে একটি সুনির্দিষ্ট উন্নয়নের তদবির করেছি, আজও তাতে সফল হইনি, এমন করুণ ব্যর্থতার ইতিহাস ও আমার ঝুলিতে আছে। একবার এক এমপি মহোদয় শপথ নেয়ার আগে মুঠো ফোনে বলেছিলেন, “কৃতজ্ঞ, আপনাদের কাছে, আপনাদের পরিবারের কাছে আজীবনের জন্য কৃতজ্ঞ। শপথ নিয়ে সাংবিধানিক এলাকায় প্রথম উন্নয়ন প্রকল্পে আপনাদের দাবীটি অন্তর্ভুক্ত করবো। “নেতা, এমপি হলেন সাত বছর, ক্ষমতার পরিধি আরও সম্প্রসারিত হলো, ত্রিশ বছরের দুঃখ, দুঃখই রয়ে গেল, এমন সমাজে বাস করে তদবির ছাড়া বাঁচার উপায় ই বা কি বলুন!! কবে পাবো কাংখিত সেই সমাজব্যবস্থা, যেখানে নীতি হবে আদিষ্ট, দূর্নীতি হবে পরাভুত? ন্যায়ভিত্তিক সাম্যের কাছে অবৈধ বিত্তের ক্ষমতা হবে নতশির, মূল্যবোধের ঝান্ডাই হবে প্রগতির বাতিঘর।

লেখক : সাবেক উন্নয়ন গবেষক ও সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষক
আগস্ট ২৫, ২০২০

প্রবাস বাংলা ভয়েস/ঢাকা/২৬ আগস্ট ২০২০/এমএম


Array