Menu

প্রবাস বাংলা ভয়েস ডেস্ক :: মানুষের মন অত্যন্ত বিচিত্র! পৃথিবীর বিভিন্ন ধর্ম-বর্ণের মানুষের মধ্যেই এ বৈচিত্র্য লক্ষ করা যায়। বিভিন্ন দেশ ও জাতিভেদে তাদের মনে বিভিন্ন ধরনের আশা-আকাঙ্ক্ষা, লোভ-লালসা, প্রেম-ভালোবাসা, সাহসিকতা, নিষ্ঠুরতা ইত্যাদি দেখতে পাওয়া যায়। আর এসব বৈচিত্র্য সে ধারণ করে জীবনে চলার ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধাপে, বিভিন্ন ঘটনা থেকে।

জীবনে চলার পথে কেউ দুঃখ-কষ্ট-বেদনার মাঝেও নিজেকে সামলে নিয়ে পথ চলে, কেউ তাতে মুষড়ে পড়ে হা-হুতাশ করে, আবার কেউ প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে এক ধরনের নেতিবাচক মনোভাবাপন্ন হয়ে ওঠে। আবার কেউ বা মানুষের প্রতি ভালোবাসায় নিজেকে উজাড় করে দেন, মানবতার সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করেন। অনেকেই আবার স্বার্থ উদ্ধারের জন্য দিনরাত ধান্দাবাজি করে বেড়ায়।

আর এভাবে সারা পৃথিবীর মানুষের মনেই সব সময় বিভিন্ন ধরনের চিন্তাভাবনা বিরাজমান থাকায় হিংসা-বিদ্বেষ, প্রেম-ভালোবাসা, মানবতা সবকিছু মিলেই জগৎ-সংসারে মানবসমাজের জীবন আবর্তিত হয়। কেউ সেখানে ভালো কাজ করে সুনামের অধিকারী হচ্ছেন, আবার কেউ বা অপকর্ম করে দুর্নাম কুড়াচ্ছেন।

আবার এক ধরনের মানুষ সব সময় অর্থের পেছনে ছুটেই জীবন পার করে দেন। তাদের অনেকে আয়-রোজগারের বিষয়ে অনেক ফন্দি-ফিকির কাজে লাগান। আর এভাবে সারা পৃথিবীতেই সৎ ও অসৎ-এ দুভাবেই মানুষ জীবন-জীবিকা নির্বাহ করে থাকায় তাদের মনের গতি-প্রকৃতিও ভিন্নতর হয়।

একশ্রেণির মানুষ শত অভাব-অনটন সত্ত্বেও অসৎ পন্থায় অর্থ উপার্জনের পথে পা বাড়ান না। কিন্তু অন্য একশ্রেণির মানুষ অভাবের কারণে যেমন অসৎ পথে পা বাড়ায়, তেমনি অনেকের অভাব না থাকলেও স্বভাব দোষে তারা অসৎ পথে আয়-রোজগারে নেমে পড়ে।

এ ক্ষেত্রে শেষোক্ত শ্রেণিটি যে অত্যন্ত লোভাতুর মনোভাবাপন্ন, তা বলা বাহুল্য। আর এ লোভাতুর মনোবৃত্তিসম্পন্ন মানুষ অসৎ পথে জীবন-জীবিকার পেছনে ছুটতে ছুটতে নিজেদের মনমানসিকতাকে কলুষিত করে অনেকে নিজেদের নর্দমায় নিক্ষেপ করতেও দ্বিধা করে না, যাদের মধ্যে আবার রাজনীতি করে খাওয়া মানুষেরও অভাব নেই।

তবে আশার কথা, বর্তমানে সারা পৃথিবীতেই এ শ্রেণির কলুষিত ব্যক্তি বা এই শ্রেণির বিরুদ্ধে জনমত গড়ে উঠছে। বছর খানেক আগে নেপাল ভ্রমণের সময় দেখতে-শুনতে পেয়েছিলাম, সাধারণ মানুষ এই শ্রেণির মানুষের বিরুদ্ধে ভীষণভাবে ক্ষিপ্ত হয়ে তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াচ্ছেন। এক ট্যাক্সিচালককে বলতে শুনলাম, তার এলাকার এমপি পুত্রকে বিদেশে লেখাপড়া করাতে পাঠিয়ে সেখানে বাড়িঘর-ধনসম্পদ গড়ে তুলেছেন এবং ঘটনাটি আমজনতা পর্যন্ত জেনে ফেলায় তারা ওই এমপির বিরুদ্ধে রাস্তায় মিছিল করেছেন।

উল্লেখ্য, নেপালের চারদিকে এখনও দরিদ্রতার ছাপ। সেখানে চালের মূল্যও তুলনামূলকভাবে বেশি বিধায় অধিকাংশ মানুষেরই ‘নুন আনতে পান্তা ফুরায়’ অবস্থা। অথচ সে দেশটি থেকেও অর্থ পাচার হচ্ছে! সেখানকার অনেক রাজনীতিকও মানুষের রক্ত চুষে খাচ্ছে। তাদের মন-মানসিকতাও অত্যন্ত নিন্দনীয়।

শুধু নেপালে নয়, সারা পৃথিবীতেই এখন দেশে দেশে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন অব্যাহত আছে। অনেক দেশের সরকারপ্রধান, রাষ্ট্রপ্রধান পর্যন্ত এ দোষে দুষ্ট! তারাও নিজ নিজ দেশের সম্পদ লুণ্ঠনে শামিল হয়ে সুইস ব্যাংকসহ বিভিন্ন স্থানে অর্থ জমা করে রেখেছেন।

আমাদের দেশেরও একশ্রেণির রাজনীতিক ও ব্যবসায়ী অনেক ধনসম্পদ বিদেশে পাচার করেছেন। ইংল্যান্ড, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকা প্রভৃতি দেশে আমাদের দেশের অনেক নেতা ও ব্যবসায়ী অর্থ পাচার করেছেন।

আজ থেকে প্রায় বিশ বছর আগে অস্ট্রেলিয়ার একজন অর্থ লেনদেনকারী ব্যবসায়ী আমাকে বলেছিলেন, বাংলাদেশ থেকে সে দেশে গিয়ে প্রচুর লোক জুয়া খেলে অঢেল অর্থ নষ্ট করে থাকেন, যাদের অধিকাংশই রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব! অথচ এসব অর্থ দ্বারা এ দেশে দরিদ্র মানুষের জন্যও তারা কিছু করতে পারতেন। কিন্তু তা না করে বিদেশের মাটিতে সেসব টাকা উড়িয়ে ওইসব ব্যক্তি বিকৃত মানসিকতার পরিচয় দিয়েছেন। কারণ, এ শ্রেণির মানুষের মনমানসিকতা আদৌ মানবিক নয়। তাদের মুখে এক কথা, মনে আরেক কথা।

আমাদের দেশের রাজনৈতিক নেতাদের সবচেয়ে বড় ভুল বা দোষ হল, তারা নিজেদের সব ধরনের ভুল বা দোষ-ত্রুটির ঊর্ধ্বে মনে করেন। তাদের মানসিকতা এমন যে, তাদের মনের ভ্রান্তি দূর করা কারও পক্ষে সম্ভব নয়। একেকটি দল ও গোষ্ঠীতে বিভক্ত হয়ে তারা নিজেদের স্বকল্পিত চিন্তা-চেতনা দ্বারা পরিচালিত হয়ে থাকেন। এ বিষয়ে তারা দেশের সাধারণ মানুষের চিন্তা-চেতনাকে গুরুত্ব না দিয়েই নিজেদের মনগড়া ফর্মুলায় কাজ করেন।

কেউ কোনো বড়সড়ো দায়িত্ব পেলেই বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই স্বেচ্ছাচারী আচরণের মাধ্যমে তারা ক্ষমতার অপব্যবহার করেন। ফলে জনসাধারণও মাঝেমধ্যেই তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। সময়-সুযোগ বুঝে অনেক সময় গণেশ উল্টে দেন। কারণ, দিনের পর দিন আমজনতা ওই শ্রেণির রাজনীতিকদের দ্বারা অবহেলিত-বঞ্চিত হতে থাকলেও ক্ষমতায় থাকাকালীন তাদের মনে হয় না, তারা কোনো ভুল কাজ করে চলেছেন। দায়িত্বপ্রাপ্ত একেকজন এমপি-মন্ত্রী সবাই মনে করেন, তারা যা করেন বা ভাবেন সেটাই সঠিক। আর এ অবস্থায় কেউ তাদের ভুল ধরিয়ে দিতে গেলেও হিতে বিপরীত হয়।

দেশের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে ঘটে যাওয়া সাম্প্রতিক ঘটনায়ও সেসবের প্রমাণ পাওয়া যায়। দিনের পর দিন সেখানে অপকর্ম চলে এলেও মন্ত্রীসহ সবাই এ বিষয়ে নির্বিকার ছিলেন! অবশেষে চোখে আঙুল দিয়ে কেউ একজন কাউকে দেখিয়ে দিলে বা ধরিয়ে দিলে তারপর একে একে থলের বিড়াল বেরিয়ে আসে। মেডিকেল ব্যবসায়ী, হাসপাতাল ব্যবসায়ীদের কেচ্ছাকাহিনী ফাঁস হতে থাকলে দেখা যায় ডিজি, সচিব, মন্ত্রী সবার সঙ্গেই এসব ব্যবসায়ীর গলায় গলায় ভাব।

সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়া একটি ছবিতে দেখা যাচ্ছে, রিজেন্ট মেডিকেলের মালিক সাহেদ নামের ব্যক্তিটি একজন মন্ত্রীকে কীভাবে প্রমাণ সাইজের একটি কেক মুখে গুঁজে দিচ্ছেন! আর মন্ত্রীও তাতে ভক্তিতে গদগদ ভাব দেখাচ্ছেন। অথচ একজন ভালো মানুষ, শিক্ষিত-জ্ঞানী মানুষ ওইসব মন্ত্রীর কাছে ভিড়তে পারেন না, কথা বলতে পারেন না।

কারণ, সে ক্ষেত্রে তাদের সময় থাকে না। সময় নেই বলে এসব মানুষকে তারা তাড়িয়ে দেন। আর যুগে যুগে এই শ্রেণির মানুষই সরকারের বড় বড় পদে আসীন হওয়ায় বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সরকারের ভরাডুবিও হয়েছে, ক্ষমতায় থাকার সময় যা তারা জানতে বা বুঝতে পারেননি।

সাধারণ মানুষের জন্য আমাদের দেশে আরও একটি বড় সমস্যা হল একশ্রেণির সরকারি আমলা-কর্মচারী। সরকারি অফিস-আদালতে ঘুষ আদায়ের জন্য তারা ওতপেতে বসে থাকে। আদালতের একটি রায়ের কপি তোলাসহ অন্যান্য অফিস-আদালতেও কাজ পেতে জনসাধারণকে হয়রানি পোহাতে হয়। ছোটখাটো ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে বড় বড় ব্যবসায়ীকে পর্যন্ত ঘুষ দিয়ে ফাইল ছাড়াতে হয়।

এ বিষয়ে আজ পর্যন্ত কোনো সরকারই নিয়ম-শৃঙ্খলা ফেরাতে পারেননি! উদাহরণস্বরূপ, পুরনো আয়করদাতাদের হয়রানি না করে নতুন আয়করদাতা খুঁজে বের করার সরকারি নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও পুরনো করদাতা, যারা মোটা অঙ্কের কর প্রদান করেন, তাদের নথি নাড়াচাড়া করে বা বারবার অডিটে পাঠিয়ে হয়রানির অভিযোগ পাওয়া গেছে। এসব সরকারি আমলা-কর্মচারীকে নিয়ম-শৃঙ্খলায় ফেরানো জরুরি হয়ে পড়েছে। কারণ, এ ধরনের অপকর্ম করে তারা সরকারের ক্ষতি করে চলেছেন। তাদের মনমানসিকতায় পরিবর্তন না ঘটলে তারা সরকারের ভাবমূর্তি বিনষ্ট করতে থাকবেন।

মনমানসিকতার পরিবর্তনের কথা বলা হল। কারণ, মানুষের মনই মানুষকে পরিচালিত করে। মনটাকে সুন্দর রাখলে অসুন্দর কাজের প্রতি আকৃষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না। আমরা যারা জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে কাজ করি, চলাফেরা-উঠাবসা করি, তাদের প্রত্যেকেরই একটি মন আছে, বিবেকও আছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও আমরা লোভ-লালসা, হিংসা-বিদ্বেষে নিজেদের মনকে কলুষিত করে তুলি, বিবেক ধ্বংস করে ফেলি!

এ দেশে আমরা নিজেরাই কেউ এমপি, মন্ত্রী, আমলা, কর্মচারী, ব্যবসায়ী। অথচ আমরা একে অপরের পরিপূরক, সহায়ক হয়ে উঠতে পারছি না। একে অন্যের প্রতি বিরূপ মনোভাবাপন্ন হয়ে হিংসা-বিদ্বেষের জন্ম দিয়ে চলেছি! এক দেশ, এক জাতি হিসেবে আমরা আমাদের জাতীয় জীবনে ঐক্য গড়ে তুলতে পারছি না। ফলে মিলেমিশে একত্রে পথচলাও সম্ভব হচ্ছে না।

স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পার হতে চলেছে, অথচ এখনও আমরা একে অপরের সঙ্গে উপনিবেশবাদী আচরণ করে চলেছি! জনসাধারণের সঙ্গে সরকারি আমলা, কর্মচারী এবং নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের আচার-আচরণ অতীতের সামন্ত প্রভুদের মতোই, অনেক ক্ষেত্রে তা এখনও উপনিবেশবাদী ভাবধারার মতো! আর এসব বিষয় জনগণের সঙ্গে সরকারের দূরত্ব বেড়ে যাওয়ার প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

এ অবস্থায় আমরা যারা দেশের মানুষের সেবার জন্য নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি হিসেবে এমপি-মন্ত্রী নির্বাচিত হই, আমলা-কর্মচারী হিসেবে সরকারি চেয়ারে বসি, তারা যেন প্রকৃতপক্ষেই জনগণের সেবক হিসেবে কাজ করি তজ্জন্য আমাদের মনমানসিকতায় পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। কারণ, দেশে ও সারা বিশ্বে এ দুর্যোগকালেও কিন্তু আমরা আমাদের লোভ-লালসা, আচার-আচরণ সংযত করতে পারিনি।

এখনও আমরা সাহেদ-সাবরিনা সৃষ্টি করে চলেছি। আর এসব ঘটনায় আমলা-মন্ত্রী কেউই দায় এড়াতে পারেন না। কারণ, তাদের পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া সাহেদের মতো হাসপাতাল ব্যবসায়ী কেন, কোনো ধরনের অসৎ ব্যবসায়ীর পক্ষেই এ দেশে টিকে থাকা সম্ভব নয়।

পরিশেষে বলতে চাই, পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আমাদের দেশের মানুষের মনমানসিকতা ভিন্নতর। আশা-আকাঙ্ক্ষা, লোভ-লালসা ইত্যাদি বিষয়েও আমাদের দেশের মানুষের চিন্তাধারা বেশি বিচিত্র। উন্নত ও অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের মানুষের তুলনায় আমরা এখনও আমাদের মনে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারিনি। একটি স্বাধীন দেশ ও জাতি হিসেবে নিজেদের এখনও যথার্থভাবে গড়ে তুলতে পারিনি।

আমরা যারা আমলা, মন্ত্রী, এমপি হয়েছি, তাদের অনেকেই যথাযথ দায়িত্ব পালন না করে আত্মতৃপ্তিতে ভুগে থাকি বা দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলেও তা স্বীকার না করে পদ-পদবি আঁকড়ে থাকি। এ অবস্থায় এই করোনা দুর্যোগকালে যেসব আমলা-মন্ত্রী অযোগ্যতার পরিচয় দিয়ে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অসৎ ব্যবসায়ীদের সহযোগিতা করেছেন, তাদের হাতের কেক গিলেছেন, সেসব ব্যক্তিকে এখন অবসরে পাঠানোই হবে সময়ের কাজ।

আর কাজটি করার আগে এ কথাটিও মনে রাখা প্রয়োজন যে, সঠিক ব্যক্তি নির্বাচন দুরূহ একটি কাজ। অত্যন্ত বিচিত্র মনমানসিকতায় ভরপুর একদল মানুষ থেকে সঠিক স্থানে সঠিক ব্যক্তি মনোনয়ন কঠিন হলেও বিচার-বিশ্লেষণের মাধ্যমে সেই কাজটি করাই এখন জরুরি হয়ে পড়েছে। মন্ত্রিপরিষদে একটি পরিবর্তন এনে সে কাজটি করা যেতে পারে। আর করোনা-পরবর্তী মন্ত্রিপরিষদে একটি পরিবর্তন প্রয়োজন কি না, সে বিষয়টিও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ভেবে দেখতে পারেন। কারণ, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীই আমাদের শেষ ভরসা।

ড. মুহাম্মদ ইসমাইল হোসেন : কবি, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট

প্রবাস বাংলা ভয়েস/ঢাকা/ ২২ আগস্ট ২০২০/এমএম


Array