বায়াজিদ গালিব :: আমার জীবনে প্রথম বঙ্গবন্ধুকে দেখি ১৯৭০ সালের ২৩ ডিসেম্বর, পাবনায়। তখন আমার বয়স সম্ভবত ১০ বছর হবে। সে সময় রাজনীতি বুঝতাম না নেতা বুঝতাম না। কে দেশের প্রেসিডেন্ট কে সামরিক জনতা, আওয়ামী লীগ, কমিউনিস্ট পার্টি, জামাত কিংবা মুসলিম লীগ এসবের কিছুই বুঝতাম না। অনেক পরে আমি যখন নবম/দশম শ্রেণীর ছাত্র তখন অনেক ঘটনা শুনেছি তখন প্রায় সব রাজনৈতিক দলের নাম জানতাম। সে সময় পাবনার কিছু ইতিহাস জানতে পেরেছিলাম। পরবর্তীতে ইন্টারনেট ভিত্তিক তথ্যের ভিত্তিতে প্রেক্ষিতে কিছুটা ইতিহাস বলছি।
১৯৭০ সালে পাবনায় অল্প সময়ে কয়েকটি ঘটনা ঘটে। সে সময় পাবনায় ভাসানী ন্যাপের ছাত্র সংগঠন ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন), যার নেতৃত্বে ছিলো টিপু বিশ্বাস গং। যারা ৭০ এর মাঝামাঝি সময়ে ভারতের কমিউনিস্ট নেতা চারু মজুমদারের নক্সালবাড়ি আন্দোলনের আদলে শ্রেণী শত্রু খতমের নামে পাবনায় উগ্র রাজনীতি শুরু করে। এরাই আহমেদ রফিককে হত্যার চেষ্টা চালায়। তখন পাবনা টাউন হল ময়দানে আওয়ামী লীগের সভা চলছিলো। মাগরিবের বিরতির সময় তারা ওই সভায় আক্রমণ করে সভা ভঙ্গ করে দেয়। রফিক অন্নদা গোবিন্দ পাবলিক লাইব্রেরীর গলি দিয়ে পাবনা মহিলা কলেজের দিকে পালিয়ে যাবার সময় তাকে ছুরিকাঘাত করা হয়। গুরুতর অবস্থায় পাবনা সদর হাসপাতালে নিয়ে গেলে তিনি প্রাণে বেঁচে যান। ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে আওয়ামী লীগ পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। সেই নির্বাচনে সবার স্থানীয় প্রিয় নেতা আহমেদ রফিক পাবনার সাঁথিয়া-বেড়া (বেড়ার আংশিক) অঞ্চল থেকে প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য (এম পি এ) নির্বাচিত হয়েছিলেন মাত্র ২৬ বছর বয়সে। তিনি ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ সংসদ সদস্য। কিন্তু এই বিজয়ের আনন্দ রফিকের জীবনে মাত্র পাঁচদিন স্থায়ী ছিল। ২২ ডিসেম্বর রাতে শহর থেকে বাড়ি ফেরার সময়, তার বাড়ির সামনে ওৎ পেতে থাকা ঘাতকরা তাকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করে। সে সংবাদ ছড়িয়ে পড়লে ওই রাতেই তার বাড়িতে হাজারো জনতা সমবেত হন। পরের দিন ২৩ ডিসেম্বর পাবনা শহরে হাজার হাজার লোক খুনের বিচারের দাবিতে মিছিল বের করে। বিক্ষুব্ধ জনতা পাবনা ট্রাফিক মোড়ে ন্যাপ নেতা ড. অমলেন্দ দাক্ষীর চেম্বার ভাঙচুর করে এবং খুনি ও আশ্রয় নেতাদের হন্যে হয়ে খুঁজতে থাকে। ২৫ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধু পাবনায় এসে রফিকের বাড়িতে গিয়ে শোকসন্তপ্ত পরিবারকে সমবেদনা দেন। ওখান থেকে পাবনা পুলিশ লাইনের মাঠে রফিকের জন্য আয়োজিত শোক সভায় যোগ দেন। সেই প্রথম আমি বঙ্গবন্ধুকে সামনা সামনি দেখি। আবছা স্মৃতির পাতা উল্টিয়ে কিছু কিছু দৃশ্য এখনো মনে আছে। আমি দেখলাম একজন দীর্ঘদেহী সফেদ পাঞ্জাবী গায়ে কালো রঙের হাত কাটা কোট পড়ে মঞ্চে এসে দাঁড়ালেন। জনতার উদ্দেশ্যে হাত তুলে সবাইকে শুভেচ্ছা জানালেন। তারপর চোখের জল মুছলেন। তার এ কাঁন্না অকৃত্তিম। যেন তারই কোনো ভাই বা আত্মতীয় স্বজন মারা গেছেন। তারপর শুরু করলেন তার বলিষ্ঠ কণ্ঠের বক্তব্য। যার কিছুই আমি না বুঝলেও তার সুন্দর বলিষ্ঠ কণ্ঠে আমি আকৃষ্ট হয়েছিলাম এ কথা মনে পড়ে। মাঝে তিনি বারবার অশ্রুসিক্ত হচ্ছিলেন, রফিকের প্রতি তাঁর স্নেহের বর্ণনা করছিলেন। আজ সেই স্মৃতি মনে করতে গিয়ে দেখলাম বঙ্গবন্ধুর অশ্রু ছিল ভালোবাসার। তার দলের কনিষ্ঠতম সংসদের অকাল প্রয়ানের ব্যথা। তিনি মানুষকে অনেক ভালবাসতেন অন্তর দিয়ে।
আমরা বাংলার শেষ নবাবের ইতিহাসের সাথে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের অনেক মিল খুঁজে পাই। আমরা যদি নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা ইতিহাস আর মিরাফরের ভুমিকা পর্যালোচনা করি তাহলে বোঝা যাবে।
“…সব ধরনের গোলমাল মোটামুটি শান্ত হওয়ার পর সিরাজ-উদ-দৌলা সেনাপতিদের অপকর্মের বিচার শুরু করেন। মানিকচন্দ্রকে কারাবন্দি করা হয়। এটা দেখে রাজবল্লভ, জগৎশেঠ ও মীরজাফর সবাই ভীত হয়ে গেলেন। স্বার্থ রক্ষার জন্য জগৎশেঠের মন্ত্রণাভবনে মিলিত হয়ে তারা ইংরেজদের সাহায্যে নবাবকে সিংহাসনচ্যুত করে মীরজাফরকে সিংহাসনে বসাবার চক্রান্ত শুরু করলেন। ইয়ার লতিফ গোপনে ওয়াটসনের সঙ্গে মিলিত হয়ে কুমন্ত্রণা দিলেন যে, সিরাজদ্দৌলা খুব শীঘ্রই ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করবেন। আর এই কারণেই তিনি পলাশীতে শিবির স্থাপন করেছেন। ক্লাইভ এরপর তার সেনাবাহিনীর অর্ধেক লুকিয়ে রেখে বাকিদের নিয়ে কলকাতায় পৌঁছালেন। আর নবাবকে পত্র লিখলেনঃ “আমরা সেনাদল উঠিয়ে আনলাম আর আপনি পলাশীতে ছাউনি গেড়ে বসেছেন?”
সিরাজদ্দৌলা সরল বিশ্বাসেই মীরজাফরকে পলাশী থেকে ছাউনি উঠিয়ে মুর্শিদাবাদ চলে যাবার আদেশ দিলেন। মীরজাফর রাজধানীতে পৌঁছামাত্রই স্ক্রাফটন তার সঙ্গে মিলিত হয়ে গোপন সন্ধির খসড়া লিখে নিলেন। ১৭ মে কলকাতার ইংরেজ দরবারে এই গোপন সন্ধিপত্রের খসড়া নিয়ে আলোচনা হয়। মীরজাফরের স্বাক্ষরের জন্য এই গোপন সন্ধিপত্র ১০ জুন তার কাছে পাঠানো হয়। কিন্তু এই গুপ্ত বৈঠক গোপন থাকলো না। ক্লাইভ যুদ্ধের প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করলেন। এদিকে গোপন সন্ধিপত্রের সংবাদ জানতে পেরে সিরাজদ্দৌলা মীরজাফরকে বন্দি করার ব্যবস্থা নিলেন। ওয়াটসন রাজধানী থেকে পালিয়ে গেলেন।
সেনা বিদ্রোহের কথা ভেবে করে সিরাজ মীরজাফরকে বন্দি করার চিন্তা বাদ দিলেন। তিনি মীরজাফরকে ক্ষমা করে তাকে শপথ নিতে বললেন। মীরজাফর পবিত্র কুরআন স্পর্শ করে অঙ্গীকার করলেন যে, তিনি শরীরের একবিন্দু রক্ত থাকতেও বাংলার স্বাধীনতাকে ক্ষুণ্ন হতে দেবেন না। গৃহবিবাদের মীমাংসা করে তিনি রায়দুর্লভ, ইয়ার লতিফ,মীরজাফর, মিরমদন, মোহনলাল ও ফরাসি সেনাপতি সিনফ্রেঁকে সৈন্য চালানোর দায়িত্ব দিয়ে তাদের সঙ্গে যুদ্ধযাত্রা শুরু করলেন। কোরআন শুয়ে শপথ নিয়েও শেষ পর্যন্ত মীরজাফর নবাবের সাথে বিশ্বাসঘতকতা করেছিল”।
বঙ্গবন্ধুর কাছে জেনারালে জিয়া কোরআন শরিফ ছুঁয়ে শপথ করেও জাতিরজনক বঙ্গবন্ধুর সাথে বিশ্বাসঘাতকতাই করেছিলো। তাদের ঘৃণিত পরিকল্পনায় পুরা পরিবারকেই হত্যা করা হয় যাতে পরিবারের কনিষ্ঠতম নিস্পাপ শিশু শেখ রাসেল নিষ্কৃতি পায় নাই। মীরজাফর, মোস্তাক, জিয়ার জন্ম যুগে যুগে হবে। বিশ্বাস ঘাতকেরা যুগে যুগে আসবেই। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধুর জন্ম একবারই হয়। তথ্যঃ ইন্টারনেট
প্রবাস বাংলা ভয়েস/ঢাকা/১৭ আগস্ট ২০২০/এমএম





