Menu

প্রবাস বাংলা ভয়েস ডেস্ক :: শোকের এ মাসে বঙ্গবন্ধুর চিন্তা-চেতনায় নানা দিক নিয়ে লেখা হচ্ছে। বলা হচ্ছে। লিখছি। বলছি। তবে লেখক বঙ্গবন্ধু নিয়ে খুব বেশি লেখা দেখছি না। বঙ্গবন্ধুর লেখা যে তিনটি বই ইতোমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে তাতেই বোঝা যায় কী গভীর ছিল তার স্বদেশপ্রেম।

তার ভ্রমণ সাহিত্য রচনায়ও মুনশিয়ানা দেখে অবাক হতে হয়। মাটি-কাদায় বেড়ে ওঠা বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে এতটাই বিমোহিত ছিলেন যে বিদেশ সফরের সময় বাংলা মাকে কিছুতেই ভুলতে পারতেন না। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে’ বায়ান্ন সালে করাচি সফরের কথা বলতে গিয়ে লিখেছেন, ‘আমি এই প্রথম করাচি দেখলাম; ভাবলাম এই আমাদের রাজধানী! বাঙালিরা কয়জন তাদের রাজধানী দেখতে সুযোগ পাবে! আমরা জন্মগ্রহণ করেছি সবুজের দেশে, যেদিকে তাকানো যায় সবুজের মেলা। মরুভূমির এই পাষাণ বালুর দেশের মানুষের মনও বালুর মতো উড়ে বেড়ায়।

আর পলিমাটির বাংলার মানুষের মন ঐরকমই নরম, ঐরকমই সবুজ। প্রকৃতির অকৃপণ সৌন্দর্যে আমাদের জন্ম, সৌন্দর্যই আমরা ভালোবাসি’ (পৃ. ২১৪-২১৫)। যার জিপে করাচি থেকে হায়দরাবাদ যাচ্ছিলেন তাকে তিনি তাই বলেই ফেললেন, ‘তোমরা এই মরুভূমিতে থাক কী করে?’ মোহাজের হয়ে আসা বন্ধু শেখ মঞ্জুরুল হক উত্তর দিলেন, ‘বাধ্য হয়ে’।

এর কিছুদিন পরই বঙ্গবন্ধু চীন সফরে যান বিশ্ব শান্তি সম্মেলনে অংশ নিতে। তার সেই সফর নিয়ে লিখেছেন ‘আমার দেখা নয়া চীন’ (বাংলা একাডেমি, ২০২০) গ্রন্থে। তাছাড়া তার ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’-তেও গ্রামীণ চীনের সৌন্দর্যের প্রশংসা করেছেন। পূর্ব বাংলার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সঙ্গে মিল খুঁজে পেয়েছেন। তার নিজের ভাষায়- ‘হ্যাংচো ও ক্যান্টন দেখলে মনে হবে যেন পূর্ব বাংলা। সবুজের মেলা চারিদিকে। … নৌকা ছাড়া বর্ষাকালে এখানে চলাফেরার উপায় নেই। বড়-ছোট সব অবস্থার লোকেরই নিজস্ব নৌকা আছে। আমি নৌকা বাইতে জানি, পানির দেশের মানুষ। আমি লেকে নৌকা বাইতে শুরু করলাম’ (পৃ. ২৩৩)। শুধু প্রাকৃতিক সৌন্দর্য কেন, চীনের কৃষি, শিল্প, বাণিজ্যসহ সবকিছুতেই ছিল তার বিপুল আগ্রহ।

কী করে নতুন সরকার মানুষকে জনসম্পদে রূপান্তরিত করে নয়া চীন গড়ে তুলেছিল, সে আলাপের সময়ও তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের সীমাবদ্ধতার কথা বলতে ভোলেননি। তিনি লিখেছেন, ‘আমরা স্বাধীন হয়েছি ১৯৪৭ সালে আর চীন স্বাধীন হয়েছে ১৯৪৯ সালে। যে মনোভাব পাকিস্তানের জনগণের ছিল, স্বাধীনতা পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আজ যেন তা ঝিমিয়ে গেছে।

সরকার তা ব্যবহার না করে তাকে চেপে মারার চেষ্টা করছে। আর চীনের সরকার জনগণকে ব্যবহার করছে তাদের দেশের উন্নয়নমূলক কাজে। তাদের সঙ্গে আমাদের পার্থক্য হল, তাদের জনগণ জানতে পারল এই দেশ এবং এই দেশের সম্পদ তাদের। আর আমাদের জনগণ বুঝতে আরম্ভ করল জাতীয় সম্পদ বিশেষ গোষ্ঠীর আর তারা যেন কেউই নন। ফলে দেশের জনগণের মধ্যে ও রাজনৈতিক কর্মীদের মধ্যে হতাশা দেখা দিয়েছে।

একটি মাত্র পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছিল সাদা চামড়ার বদলে কালা চামড়ার আমদানি হয়েছে।’ এরপর তিনি চীনের সরকারের গণমুখী কর্মসূচির মাধ্যমে নিজের দেশকে গড়া ও জনগণের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক মুক্তির দিকে সর্বশক্তি নিয়োগ করার বিষয়টি প্রশংসার দৃষ্টিতেই দেখেছেন। একইসঙ্গে স্বীকার করেছেন, ‘আমি নিজে কমিউনিস্ট নই। তবে সমাজতন্ত্র বিশ্বাস করি’ (পৃ. ২৩৪)। তার সমাজতন্ত্র ছিল একান্তই তার ভাবনাজাত। দেশজ। পুঁজিবাদী অর্থনীতিকে শোষণের যন্ত্র আখ্যা দিয়েও তিনি গণতন্ত্র ও মানবাধিকারে বিশ্বাসী ছিলেন বলে চীন সরকারের পুরোটা গ্রহণ করতে পারেননি।

তবে তাদের জনকল্যাণের কর্মসূচিগুলোর প্রশংসা করেছেন। তাই চীন সফরকালে তিনি ওই দেশের কৃষক, শ্রমিক ও ছাত্র-শিক্ষকদের সঙ্গে গভীরভাবে মিশেছেন এবং তাদের জন্য কল্যাণধর্মী সংস্কারগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেছেন। যেহেতু তিনি গণতান্ত্রিক ছিলেন তাই পরখ করে দেখতে চেয়েছেন সত্যি সত্যি শ্রমজীবী মানুষ নতুন ব্যবস্থায় ভালো আছেন কি না।

ভিক্ষুক পুনর্বাসন কর্মসূচি, পুনর্বাসিত রিকশাচালকদের সততা, শ্রমিকদের জন্য আবাসন, শিল্প পরিচালনায় শ্রমিক ইউনিয়ন এবং ব্যক্তি ব্যবস্থাপনার সুসম্পর্ক, নারীর ক্ষমতায়ন, কৃষি খামারের শ্রমিকদের সন্তানদের জন্য শিক্ষার সুযোগ, স্বদেশি পণ্যের প্রতি গুরুত্বারোপ এবং মানুষের মর্যাদা সংরক্ষণে সরকারের অভিপ্রায়সহ নানা বিষয়ের ওপর তিনি তার গভীর পর্যবেক্ষণের ছাপ রেখেছেন তার ‘আমার দেখা নয়া চীন’ বইয়ে। চীন সরকারের স্বদেশি উন্নয়ন কৌশলের প্রশংসা করে তিনি জানিয়েছেন, তারা তাদের বিদেশি মুদ্রাকে জাপান থেকে যন্ত্র আমদানির কাজে ব্যবহার করছিলেন। আর কোরীয় যুদ্ধের সময় অর্জিত বিপুল পরিমাণ বিদেশি মুদ্রা পাকিস্তান সরকার বিদেশ থেকে বিলাসপণ্য আমদানির জন্য ব্যবহার করছিলেন।

আমি তার চীন ভ্রমণের বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরতে চাই না। একটি কথা বলার জন্য এতক্ষণ তার চীন সফরের এসব কথা তুলে ধরলাম। সে বিষয়টি হল তরুণ রাজনীতিক শেখ মুজিবের দূরদৃষ্টি। মাত্র ৩২ বছর বয়সে তিনি চীন সফর করছিলেন। তিনি ওই দেশের দালানকোঠা, পুরনো ঐতিহ্য দেখতে তেমন আগ্রহী ছিলেন না। বরং দেখতে চাইছিলেন ওই দেশের কৃষি খামার, শিল্পকারখানা, কারিগরি শিক্ষালয়, বিশ্ববিদ্যালয়। বিপ্লবের পর নয়া সরকার সাধারণ মানুষের জীবনমান উন্নত করার জন্য কী সংস্কার নীতি গ্রহণ করেছে, সেগুলোর বাস্তব প্রভাব কতটা তাদের জীবনে পড়েছে-সেসবই তিনি গভীর মনোযোগ দিয়ে দেখতে আগ্রহী ছিলেন।

মনে রাখা চাই, তখনও তিনি সংসদ সদস্য নন, মন্ত্রী নন, দলের সাধারণ সম্পাদকও নন। তবুও তার এই সুদূরপ্রসারী ভাবনা থেকে অনুমান করা যায় তিনি নিজেকে তৈরি করছিলেন তার আরাধ্য সোনার বাংলা গড়ার কৌশল আবিষ্কারের মাধ্যমে। পরবর্তী সময়ে তিনি যখন সত্যি সত্যি জাতীয় নেতার রূপান্তরিত হচ্ছিলেন, প্রাদেশিক সরকারের কৃষি, সমবায় এবং শিল্প ও বাণিজ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পেয়েছিলেন, তখন জনকল্যাণধর্মী নানা উদ্যোগ নিয়েছিলেন। বৈরী কেন্দ্রীয় পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে লড়াই করে করেই তিনি এগোচ্ছিলেন। একপর্যায়ে মন্ত্রিত্ব ছেড়ে দিয়ে সাংগঠনিক কাজে বেশি করে মনোযোগ দিতে শুরু করলেন।

উদ্দেশ্য একটাই- সাধারণ মানুষের বঞ্চনা ও বৈষম্য থেকে উত্তরণের জন্য তীব্র গণআন্দোলন গড়ে তোলা। মন্ত্রী থাকাকালে তিনি অনুভব করেছিলেন এতটা দূরত্বে থাকা পাকিস্তানের দুই অঞ্চলের জন্য ‘এক অর্থনীতি’ প্রাসঙ্গিক নয়। তাই দুই অর্থনীতির ধারণাকে সামনে আনতে শুরু করলেন। তার এ ভাবনার কারণেই তাকে বারবার জেলে যেতে হয়। জেলে বসেই তিনি তার ‘আমার দেখা নয়া চীন’, ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ এবং ‘কারাগারের রোজনামচা’র পাণ্ডুলিপি তৈরি করেছেন। এসব লেখাতেই তার আগামী দিনের ‘ভিশন’ ও ‘মিশন’ ফুটে ওঠে।

‘দুই অর্থনীতির’ তত্ত্বের ভিত্তিতেই তিনি তৈরি করেন ঐতিহাসিক ছয়-দফা কর্মসূচি। এই ছয়-দফাই শেষ পর্যন্ত এক দফায় রূপান্তরিত হয়। এর জন্য তাকে ভীষণ মূল্য দিতে হয়েছে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলার মুখোমুখি হতে হয়েছে। শেষ পর্যন্ত জনগণ তাকে পূর্ণ সমর্থন দিয়ে জেল থেকে মুক্ত করেছেন এবং বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত করেছেন। এর পরের কাহিনী আমরা সবাই জানি। নির্বাচন করে জিতেও ক্ষমতায় না যাওয়া, অসহযোগ আন্দোলন শেষে স্বাধীনতার ঘোষণা এবং রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ শেষে দেশে ফিরে নানা প্রতিকূলতা মোকাবেলা করে সোনার বাংলা গড়ায় তার যে সংগ্রাম আমরা প্রত্যক্ষ করেছি তা আসলেই অনন্য। তিনি এমন এক স্বদেশ গড়তে চেয়েছিলেন যেখানে কেউ অভুক্ত থাকবে না, শিশুরা খেলবে এবং মায়েরা হাসবে।

ছাত্রজীবন থেকেই তিনি এই সোনার বাংলার স্বপ্ন দেখতেন। পঞ্চাশের দুর্ভিক্ষের সময় তিনি কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে পড়ছিলেন। না খেয়ে মানুষ মারা যাচ্ছিল তার চোখের সামনে। ব্রিটিশ সরকারের অমানবিক যুদ্ধনীতির কারণেই যে এমনটি ঘটছিল সে কথা তিনি তার ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’-তে লিখেছেন। একইসঙ্গে লিখেছেন, সাম্রাজ্যবাদী শোষণ ও শাসনের কারণেই সোনার বাংলার এই দুরবস্থা হয়েছে। তার নিজের ভাষায়: ‘ইংরেজদের কথা হল, বাংলার মানুষ মরে তো মরুক, যুদ্ধের সাহায্য আগে। যুদ্ধের সরঞ্জাম প্রথম স্থান পাবে। ট্রেনে অস্ত্র যাবে, তারপর যদি জায়গা থাকে তবে রিলিফের খাবার যাবে।

যুদ্ধ করে ইংরেজ, আর না খেয়ে মরে বাঙালি; যে বাঙালির কোনো কিছুরই অভাব ছিল না। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি যখন বাংলাদেশ দখল করে মীরজাফরের বিশ্বাসঘাতকতায় তখন বাংলায় এত সম্পদ ছিল যে, একজন মুর্শিদাবাদের ব্যবসায়ী গোটা বিলাত শহর কিনতে পারত। সেই বাংলাদেশের এই দুরবস্থা চোখে দেখেছি যে, মা পড়ে আছে, ছোট বাচ্চা সেই মরা মার দুধ চাটতো, কুকুর ও মানুষ একসঙ্গে ডাস্টবিন থেকে কিছু খাবার জন্য কাড়াকাড়ি করছে’ (পৃ. ১৮)।

এই স্মৃতি সর্বদাই তার মনে ছিল। তাই তিনি ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলা গড়তে এতটা আগ্রহী ছিলেন। সেই স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়ার জন্য চমৎকার একটি সংবিধান, প্রথম পঞ্চবাষির্কী পরিকল্পনা ও শিক্ষা কমিশন উপহার দিয়েছিলেন জাতিকে। কৃষি ও শিল্পের যুগপৎ উন্নতির উদ্যোগও নিয়েছিলেন। চীন সরকারের অভিজ্ঞতায় তিনি দুই পায়েই হাঁটছিলেন। কিন্তু দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীদের হামলায়, মীরজাফরের প্রেতাত্মা মোশতাকের বিশ্বাসঘাতকতায় পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্ট আমাদের সোনার বাংলার স্বপ্নদ্রষ্টা খুন হয়ে যান।

আমাদের ওই স্বপ্নও খুন হয়ে যায়। এরপর দেশের কপালে কী জুটেছিল তা আর বলার প্রয়োজন নেই। অনেক ত্যাগ, অনেক রক্ত ও সংগ্রাম শেষে দেশ ফিরেছে মুক্তিযুদ্ধের পথে, তারই সুযোগ্য কন্যার হাত ধরে। যে দুর্নীতি বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলার স্বপ্নপূরণে বাধা সৃষ্টি করছিল তা এখনও বজায় রয়েছে। বঙ্গবন্ধুকন্যা এই শত্রুর বিরুদ্ধে লড়ছেন। তবে এ সংগ্রাম সহজ নয়। তদুপরি হানা দিয়েছে করোনা ও বন্যা।

নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। জনগণ এক থাকলে এবং কৃষির উন্নয়নের পাশাপাশি ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগকে মদদ দিয়ে যেতে পারলে নিশ্চয়ই বঙ্গবন্ধুর আরাধ্য সোনার বাংলার স্বপ্ন অর্জনে আমরা সফল হব।ড. আতিউর রহমান : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু চেয়ার অধ্যাপক; বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর

প্রবাস বাংলা ভয়েস/ঢাকা/ ১৫ আগস্ট ২০২০/এমএম


Array