মো. মাহমুদ হাসান, ক্যালগেরি, কানাডা :: হিসাব বিজ্ঞানের অংকগুলো ভালো লাগলেও প্রবৃদ্ধি, জিডিপি, মুদ্রাস্ফীতি অর্থনীতির এমন পরিভাষাগুলো আমায় টানে না, তবুও কোভিডকালে প্রিয় বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির খবর আমাকে পুলকিত করে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যমতে, ২০১৮/১৯ অর্থ বছরে যেখানে মাথাপিছু আয় ছিল ১৯০৯ ইউএস ডলার, ২০১৯/২০ অর্থ বছরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২০৬৪ ইউএস ডলার। গত একযুগে গড় প্রবৃদ্ধি হার ছিল প্রায় ৭% এরও বেশি। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩৫,৮৫২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড়িয়েছে। গড় আয়ু বৃদ্ধি, শিশু ও মাতৃমৃত্যুর হার কমিয়ে আনা এমন সব বিষয়ে সাফল্য তো আছেই।
পক্ষান্তরে পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গেল বছরের জিডিপির প্রবৃদ্ধি ২.৩% আর বৃহৎ কল্যাণ অর্থনীতির দেশ কানাডায় তা ১.৭% এবং গত দশ বছর গড়ে ২% এর ও কম। জেদের ফসল নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মাসেতু, এতো আমাদের অর্থনীতির সক্ষমতাই প্রমাণ। শতাব্দীর মহানায়ক জাতির জনক জুলিওকুরী বঙ্গবন্ধুর জন্মশত বার্ষিকীতে জাতি যখন উৎফুল্ল মনে এগিয়ে যাওয়ার কথা, সে সময়ে কেন আমাদের এতো হাহাকার?
চিত্ত-চেতনায় ইতিহাসের বিরল জাতীয়তাবাদী নেতা হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ছিল একটি সুখী, সমৃদ্ধ, বৈষম্যহীন, শোষনমুক্ত সমাজ ব্যবস্থা। আর এই মহান চেতনাকে ধারণ করেই, ২৪ বছরের পাকিস্তান শাসনামলে, বাঙ্গালী জাতির অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে ১৩ বছরই কাটিয়েছেন কারাগারে। সীমাহীন ত্যাগ আর অপরিসীম ভালোবাসা দিয়ে বাংলাদেশ নামক একটি দেশের অভ্যুদয় ঘটিয়ে পরিনত হন সাড়ে সাতকুটি মানুষের অবিসংবাদিত নেতা জাতির জনকে। ১৯৭২ এর ১০ জানুয়ারি পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে দেশে ফিরেই যুদ্ধ বিদ্ধস্ত দেশ গঠনে আত্তনিয়োগ করেছিলেন। স্বল্পতম সময়ে মিত্র বাহিনীর ভারতীয় সৈন্যদের নিজদেশে ফেরানোর মধ্য দিয়ে ঐতিহাসিক দূরদর্শী রাষ্ট্র নায়কের পরিচয় দিয়েছিলেন, কিছু ব্যতিক্রম বাদে পৃথিবীর প্রায় সব দেশের সঙ্গে গড়ে তুলেছিলেন কুটনৈতিক সম্পর্ক, বিশ্ব পরিসরে পরিচিতি পান শোষিত মানুষের একচ্ছত্র বলিষ্ঠ কন্ঠ হিসেবে। স্বদেশে ফিরে, পরিচয়হীন যুদ্ধ শিশুদের সংকট নিরসনে বলেছিলেন, ওদেরও বাবার নামের জায়গায় আমার নাম, আর ঠিকানা ধানমন্ডি ৩২ নম্বর লিখে দাও। এমন মহানুভব জাতিয়তাবাদী নেতাকে অল্প সময়ের ব্যবধানে ভারাক্রান্ত হ্রদয়ে বিক্ষুব্ধ কন্ঠে বলতে হলো, সারা পৃথিবী থেকে ভিক্ষা করে টাকা-পয়সা নিয়ে আসি আর চাটার দল সব খেয়ে ফেলে। সময়, গতি-প্রকৃতি ও প্রেক্ষাপট পাল্টালেও, এমন ভয়াবহ সামাজিক ব্যাধির, ব্যাপ্তি কি কমেছে?
চমৎকার অর্থনৈতিক সাফল্যের অব্যাহত ধারার ফলশ্রুতিতে বঙ্গবন্ধুর আমৃত্যু লালিত বাসনা একটি সুখী, বৈষম্যহীন সমাজ ব্যবস্থা বিনির্মানে তো আজ আমাদের অনেক এগিয়ে যাওয়ার কথা, তাহলে অন্তরায়টা কোথায়? ব্যাংক ব্যবস্থায় পাহাড়সম ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঋন, আন্তর্জাতিক কেনাকাটায় ওভার ইনভয়েসিং নামে বিদেশে অর্থপাচার, সরকারি কেনাকাটায় দরপত্রে অকল্পনীয় মূল্য দেখিয়ে অনৈতিক সুবিধা গ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি, কাগুজে প্রকল্পের মাধ্যমে ঋনের নামে জনগনের অর্থ লোপাটসহ যেকোনো পথে বিত্তশালী হওয়ার বিরামহীন অসুস্থ প্রতিযোগীতাই তো বঙ্গবন্ধুর ‘শোষনমুক্ত বৈষম্যহীন সমাজ ব্যবস্থা’র পথে প্রধান প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। যুগ যুগান্তরে সৃষ্ট এমন সামাজিক সমস্যার সমাধানে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা যত্নশীল বলেই প্রচন্ডভাবে বিশ্বাস করি কিন্তু শুধুমাত্র প্রশাসনিক পদক্ষেপ গ্রহণ আমার কাছে এলোপ্যাথিক এন্টিবায়োটিক দিয়ে ক্ষত সারানোর সাময়িক সমাধানের প্রচেষ্টা বলেই মনে হয়, এটি কোন প্রতিষেধক নয়। এর জন্য প্রয়োজন, সমাজবিজ্ঞানী, শিক্ষাবিদ সমন্বয়ে আদর্শ মানুষ সৃষ্টির দীর্ঘমেয়াদী শিক্ষা-সামাজিক মহাপরিকল্পনা।
গত একযুগে ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান আওয়ামী লীগের ব্যপ্তি ঘটেছে অনেক কিন্তু এর মাঝে অনেক আদর্শহীন আগাছা যে যুক্ত হয়েছে, তা মতান্তরের উপায় কোথায়? নানা রঙ-বেরংয়ের মুজিব কোট, বিদেশ থেকে লাখ টাকা খরচ করে মহান নেতার প্রতিকৃতি সম্বলিত কোটপিন বানিয়ে, তা বুকে লাগিয়ে, পকেটে দলীয় কেন্দ্রীয় উপ কমিটির ভিজিটিং কার্ড নিয়ে বিত্তের বাসনায় মত্ত, এই পাপিষ্ঠরা আদর্শবান ত্যাগীদের উপর খবরদারী করে। জননেত্রী শেখ হাসিনা যখন বলেন, ‘মগজে পচন ধরে নাই’ সেই কথার সাথে একমত হয়ে ও বলতে চাই, অংগ প্রত্যংগের পচন থেকে ক্যান্সার সৃষ্টির আগেই তা কেটে ফেলা শ্রেয়তর নয় কি? এই সুযোগ সন্ধানীরা তো সব সময়ই একটি সুখী, বৈষম্যহীন সমাজ ব্যবস্থা বিনির্মানে অন্তরায় হয়েই থাকবে।
চেতনার বাতিঘর খ্যাত জাতীয় অধ্যাপক ডঃ আনিসুজ্জামান স্যার প্রয়াত হয়েছেন, এ তো জাতির অপূরনীয় ক্ষতি। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক মো. আব্দুল মান্নান স্যারকে সামরিক শাসকের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে মৌলবাদ, সামপ্রদায়িকতার বিরুদ্ধে, মুক্তিযুদ্ধ ও প্রগতির পক্ষে লড়াই, সংগ্রাম করতে দেখেছি। কিছুদিন আগে ‘সরকার কে চালায়’ এ জাতীয় একটি লিখার পর থেকে উনার আর কোন লিখা আমার নজরে পড়েনি। জানিনা, এটি উনার হতাশাগ্রস্ত কোন অভিমান কি না, যদি তা হয়েই থাকে, এমন মানুষদের বিক্ষুদ্ধ অভিমানে জাতি হিসেবে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হবো।
মাথার ঘাম পায়ে ফেলে রোধে পুড়ে, বৃষ্টি তে ভিজে কঠোর পরিশ্রম করে যে রেমিট্যান্স যোদ্ধারা অর্থ পাঠিয়ে অর্থনীতির চাকা সচল রাখে, “এরা দেশে আসলে, চুরি চামারি বেড়ে যাবে’ বিদেশ মন্ত্রীর এমন মন্তব্যে, বঙ্গবন্ধুর জীবন থেকে মহোদয় কি শিখলেন তা নিয়ে আমার মনে সংশয় জাগে। সাবেক শিবির ক্যাডার, যার হাত অনেক প্রগতিশীল ছাত্র আর জাতির জনকের আদর্শের অনুসারীদের রক্তে রঞ্জিত, সে যখন একটি খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার হয়ে জাতির জনকের আদর্শের ব্যবসা করে বেড়ায়, জেলা ছাত্র শিবিরের সাবেক সভাপতি প্রশাসনের যুগ্ম সচিব হয়ে প্রয়াত এক মহান মুক্তিযোদ্ধার সন্তান মন্ত্রী মহোদয়ের সফর সংগী হয়ে দেশে বিদেশে ঘুরে বেড়ায়, এ হেন পরিস্থিতিতে হৃদয়ের রক্তক্ষরণ না বাড়ার উপায় কি বলুন।
বঙ্গবন্ধুর ভাষায়, “আমার কৃষক শ্রমিক দুর্নীতি করে না, এদের টাকায় আপনারা মাইনে পান, এদের সম্মান করে কথা বলবেন।” সেই কৃষকের সম্মান কতটুকু বেড়েছে জানিনা, তবে একমন ধান বিক্রির টাকায় এক কেজি গরুর গোশত কিনতে হয়, এতো অতিরঞ্জিত নয়। শোকের মাস আগস্ট, ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট পরিবারের একান্ত আপনজনদের হারিয়ে বঙ্গবন্ধু কন্যা রিক্ত হয়েছিলেন, জাতি হারিয়েছিল তার শ্রেষ্ঠ সন্তানকে। সেই থেকে দেশীয়, আন্তর্জাতিক, সাম্প্রদায়িক, প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির আস্ফালনে ক্ষত-বিক্ষত জাতির শেষ ঠিকানা বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা ও ২৪ বার হামলা-মৃত্যুর মুখোমুখি হয়ে এখনো জাতিকে নিরলস সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। তারই সুযোগ্য নেতৃত্বে, এ শতাব্দীর তৃতীয় দশকেই সব প্রতিকূলতা জয় করে উদিত হোক বঙ্গবন্ধুর বহু আকাংকিত সুখী, সমৃদ্ধ অর্থনীতির অসাম্প্রদায়িক, বৈষম্যহীন, দৃঢ় নৈতিক মূল্যবোধ সম্পন্ন সমাজ ব্যবস্থার সোনালী সূর্য, শোক হোক শক্তির উৎস।
লেখক : সাবেক উন্নয়ন গবেষক ও সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষক
আগস্ট ১৩, ২০২০
প্রবাস বাংলা ভয়েস/ঢাকা/১৪ আগস্ট ২০২০/এমএম





