বাংলানিউজসিএ ডেস্ক :: ‘জন্মিলে মরিতে হয়’ এটাই আল্লাহ বিধান। কিন্তু কিছু কিছু মৃত্যু আছে যা মেনে নেয়া খুবই কঠিন। দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী-শিল্পোদ্যোক্তা নুরুল ইসলামের প্রয়াণ আমার কাছে ছিল অনেকটা বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো। প্রতিদিনের মতো টিভি নিউজের স্ক্রল দেখছিলাম। হঠাৎ করেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পোদ্যোক্তা নুরুল ইসলাম আর নেই। কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে থাকি।
নুরুল ইসলাম আমার কোনো আত্মীয় নন। তার সঙ্গে আমার তেমন একটা ঘনিষ্ঠ পরিচয়ও ছিল না। একবার শুধু যুগান্তর অফিসে যাওয়ার সময় নিচে মসজিদের কাছে তার সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত পরিচয় হয়। আমাকে দেখে তিনি কাছে ডাকলেন। এরপর পরিচয় জিজ্ঞাসা করে কিছুক্ষণ আলাপ করলেন। দেশবরেণ্য শিল্পোদ্যোক্তা অথচ তার মাঝে কোনো অহংকার লক্ষ করিনি। আমি যুগান্তরে কলাম লিখি এটা জানার পর তিনি আমাকে বেশ উৎসাহিত করলেন।
সেদিনের সামান্য ক্ষণের সেই পরিচয় ও তার ব্যক্তিত্বে আমি ভীষণভাবে মুগ্ধ হই। মরহুম নুরুল ইসলামকে আগে ব্যক্তিগতভাবে না চিনলেও তার অনেক খবরই আমি রাখতাম। এর কারণ হচ্ছে তার বাড়ি ঢাকার নবাবগঞ্জে। আর আমার বাড়ি মানিকগঞ্জে। আমরা পাশাপাশি জেলার বাসিন্দা। সেই হিসেবে নুরুল ইসলামকে আমি নিকটজন হিসেবেই মনে করতাম। কাজেই তার এই আকস্মিক মৃত্যু আমাকে স্বজন হারানোর বেদনায় আচ্ছন্ন করেছে।
মরহুম নুরুল ইসলামের জন্ম ১৯৪৬ সালে। সেই হিসেবে তার বয়স হয়েছিল ৭৪ বছর। বাংলাদেশের মানুষের গড়পড়তা আয়ুষ্কাল হিসেবে খুব অল্প বয়সে তিনি চলে গেলেন বলা যাবে না। তবে তার এই চলে যাওয়াটা এমন এক সময় ঘটল যখন দেশে তার মতো একজন কর্মদ্যোমী ও ক্রিয়েটিভ শিল্পোদ্যোক্তার বড়ই প্রয়োজন ছিল। বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া মহামারী করোনাভাইরাস সংক্রমণ উত্তরকালে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নুরুল ইসলামের মতো একজন নেতৃস্থানীয় উদ্যোক্তার বড়ই প্রয়োজন ছিল।
জনাব নুরুল ইসলাম একজন বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধে তিনি অসামান্য বীরত্ব প্রদর্শন করেছেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর অনেকেই যখন জীবিকার সন্ধানে বিপথগামী হয়েছেন, তখন নুরুল ইসলাম চাকরির পেছনে না ঘুরে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং সম্ভাব্য বেকার সমস্যা দূরীকরণে অবদান রাখার উদ্দেশ্যে ১৯৭৪ সালে যমুনা শিল্পগোষ্ঠী প্রতিষ্ঠা করেন।
তিনি একটি নির্দিষ্ট ও সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য নিয়ে কাজ শুরু করেছিলেন। বর্তমানে এই শিল্পগোষ্ঠীর অধীনে ৪১টি বিভিন্ন ধরনের শিল্পপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানে ৫০ হাজারেরও বেশি মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। যমুনা গ্রুপের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত যমুনা ফিউচার পার্ক এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ ও অত্যাধুনিক একটি শপিংমল।
প্রয়াত নুরুল ইসলামের হাতের জাদুর স্পর্শে ছাই থেকে সোনা ফলেছে। যমুনা শিল্পগোষ্ঠী প্রতিষ্ঠার পর তাকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। তিনি যেখানেই হাত দিয়েছেন, সাফল্য এসে ধরা দিয়েছে। দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পপতি নুরুল ইসলামের সবচেয়ে বড় গুণ ছিল তিনি সবকিছুই নিজে নিয়ন্ত্রণ করতেন, যে কারণে এ গ্রুপের সব পণ্যই একটি নির্দিষ্ট মান রক্ষা করে উৎপাদিত হয়ে আসছে।
প্রয়াত নুরুল ইসলাম সোনার চামচ মুখে দিয়ে জন্মগ্রহণ করেননি। কঠোর পরিশ্রম ও অধ্যবসায়ের মাধ্যমেই তাকে আজকের অবস্থানে আসতে হয়েছে। উদ্যম ও আন্তরিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে যে একজন মানুষ খ্যাতি ও সাফল্যের শীর্ষে আরোহণ করতে পারেন, নুরুল ইসলাম তার জ্বলন্ত উদাহরণ।
আমি একজন ব্যাংকার। দেশের একটি শীর্ষস্থানীয় বিশেষায়িত ব্যাংকের উচ্চপদে দীর্ঘদিন চাকরি করার পর অবসর গ্রহণ করেছি। ব্যাংকার হিসেবে আমাদের দেশের শীর্ষস্থানীয় উদ্যোক্তা-ব্যবসায়ীদের সঙ্গে প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষ যোগাযোগ ঘটে থাকে। যোগাযোগ না থাকলেও অন্তত তাদের কার্যকলাপ সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা রাখতে হয়।
দেশের কোন্ শিল্পোদ্যোক্তা কেমন চরিত্রের সে সম্পর্কে কিছুটা ধারণা আমাদের থাকে। আমরা যাদের বিশিষ্ট শিল্পোদ্যোক্তা হিসেবে চিনি ও জানি, তাদের অনেকেই ঋণখেলাপি। বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে সময়মতো পরিশোধ না করাই তাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য।
অনেকেই মনে করেন, ব্যাংক ঋণ আত্মসাৎ না করলে রাতারাতি বড়লোক হওয়া যায় না। এ ক্ষেত্রে নুরুল ইসলাম ছিলেন এক চমৎকার ব্যতিক্রম। তিনি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ গ্রহণ করেছেন উৎপাদন বাড়ানোর স্বার্থে; কিন্তু কখনও ঋণখেলাপি হয়েছেন বলে শোনা যায়নি। তিনি ব্যাংক ঋণের কিস্তি নিয়মিত পরিশোধ করেছেন।
এ ক্ষেত্রে তার সুনাম ছিল। আমাদের দেশের শিল্পপতি-ব্যবসায়ীদের একটি বড় অংশেরই বিদেশে বাড়ি বা অন্যান্য সম্পদ রয়েছে। অনেকেই ব্যবসা-বাণিজ্যের নামে অর্থ পাচার করে থাকেন। সম্প্রতি প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাংকে বাংলাদেশিদেরআমানতের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ৩৮৬ কোটি টাকা। ১০ বছরে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের
আমানতের হার বেড়েছে ১৫৬ শতাংশ। ইতোপূর্বে পানামা পেপারস কেলেঙ্কারিতে দেশের অনেক ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তার নাম এসেছে। কিন্তু এর কোনোটিতেই নুরুল ইসলামের কোনো নাম নেই। প্রয়াত নুরুল ইসলামের বিরুদ্ধে কখনও এ ধরনের অভিযোগও পাওয়া যায়নি। তিনি কখনও অর্থ পাচারের মতো ঘৃণ্য অপকর্মে লিপ্ত হননি। বরং সবসময় দেশের অর্থ বাইরে পাচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার থেকেছেন। আমি প্রায়ই অর্থ পাচার, মানি লন্ডারিং, ঋণখেলাপি প্রবণতা ইত্যাদির বিরুদ্ধে লিখে থাকি। এসব লেখা যুগান্তরেও প্রকাশিত হয়েছে।
মানবদরদী শিল্পোদ্যোক্তা নুরুল ইসলাম সবসময় দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে অবদান রাখার জন্য নিরলস চেষ্টা চালিয়ে গেছেন। একজন নুরুল ইসলাম চলে গেছেন। প্রত্যেক মানুষকেই একদিন চলে যেতে হবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু জাতি গঠনে এবং দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও বেকার সমস্যার সমাধানে নুরুল ইসলাম যে অবদান রেখেছেন, জাতি চিরদিন তা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে।
দেশের ভবিষ্যৎ ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তাদের কাছে নুরুল ইসলাম আদর্শ হয়ে থাকবেন। নিজের কাজের প্রতি একনিষ্ঠতাই তাকে বর্তমান পর্যায়ে উন্নীত করেছে। মহান আল্লাহ্র দরবারে প্রার্থনা করি, এই ক্ষণজন্মা কর্মবীরকে যেন জান্নাতবাসী করেন।এম এ খালেক : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার ও অর্থনীতিবিষয়ক কলাম লেখক
বাংলানিউজসিএ/ঢাকা/ ১৮ জুলাই ২০২০/এমএম





