Menu

বায়াজিদ গালিব, ক্যালগেরি :: আশি-নব্বই দশকে প্রয়াত সাংবাদিক ও টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব ফজলে লোহানী একটি ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করতেন যার নাম “যদি কিছু মনে না করেন”। ওই সময়ে টেলিভিশনে তেমন কোনো ভালো বিনোদনমূলক ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান না থাকায় এই অনুষ্ঠান খুবই জনপ্রিয়তা পেয়েছিলো। আমিও এটি পছন্দ করতাম। ওই ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানে দুইজন কৌতুকাভিনেতা (তাঁদের নাম ঠিক মনে করতে পারছি না) বিভিন্ন ধরনের কৌতুকের মাধ্যমে আমাদের আনন্দ দিতেন। তাছাড়া বিভিন্ন ধরনের প্রশ্ন করে দর্শকদের আনন্দ দিতেন।

প্রশ্নের ধরণ ছিল এমনঃ ‘আইচ্ছা কোনছেন দেহি কোন নানী, নানী না’ ? কিংবা কোন দেশ, দেশ না? ইত্যাদি। উত্তর ছিল ‘বনানী’ এবং ‘সন্দেশ’। আমার মতে দেশের প্রশ্নে, কোন দেশ দেশ না ? তার উত্তর ‘সন্দেশ’ না হয়ে ‘উপদেশ’ হলে আরো ভালো হতো। বাংলাদেশের সরলমনা মানুষ অন্যের উপকারের জন্য সাধারণত উপদেশ দিয়ে থাকেন। আমি নিজেও এর বাইরে না। তাছারা, ‘উপদেশ’ খুবই সুলভ একটা বস্তু যা না চাইতেই পাওয়া যায়। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, ” না চাহিলে যারে পাওয়া য়ায়”।

তখন ডিজিটাল মিডিয়ার যুগ ছিল না, রেডিও টেলিভিশন একমাত্র মাধ্যম। যা আমাদের বিনোদন দিত। সে যা হোক, আসল কথায় ফেরা যাক। সম্প্রতি বিশ্ব আজ করোনা আতঙ্কে ভীতসন্ত্রস্ত। এর মাঝেও আমাদের উপদেষ্টার অভাব নেই। করোনা প্রতিরোধে মেসেঞ্জারের ইনবক্সে হাজার হাজার স্তর ভিত্তিক উপদেশ চলে আসলো। তারমধ্যে উল্লেখযজগ্য,”কিট ছাড়াই কি ভাবে করোনা টেস্ট করতে পারবেন”। এই অভিনব পদ্ধতি হচ্ছে নিঃশ্বাস টেনে আধা মিনিট দম বন্ধ করে রাখলে যদি কাশি আসে তাহলে বুঝতে হবে তাঁর করোনা আছে। বাব্বাহ! কি আবিস্কার!

আমরাও মাগনায় আলকাতরা খেতে অভস্ত্য। খেতে দোষ কি? হুজুগ বলে কথা, লাখো লাখো জনগন এই টেস্টে লেগে গেলো। পরে না কি খবর আসছিল, (আমি মুল খবর দেখি নাই ভাইরালে দেখেছি) “করোনা টেস্ট করতে গিয়ে দম বন্ধ হয়ে একজনের মৃত্যু। তাঁরপর থেকে এই আত্মঘাতী টেস্ট বন্ধ। যারা এই অভাবনীয় করোনা টেস্টের প্রচার করেছিলেন তারা কেউই ডাক্তার বা মেডিক্যাল সায়েন্সের কেউ না। আমার অতি পরিচিত এমন একজন ব্যঙ্কার অভিজ্ঞ চিকিৎসকের মতোই ইনবক্সে করোনা হলে কি কি ওষুধ খেতে হবে তাঁর একটা প্রেসক্রিপশন পাঠিয়ে দিল।

আমার অনেক আগের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, অনেক আগের কথা, আমি যখন প্রথম গাড়ি কিনলাম, টোয়োটা পাবলিকা। খুশি আর উত্তেজনায় আমার পা মাটিতে পড়ে না। বাস্তবতা এই যে গাড়ি থাকতে মাটিতে কেনই বা পা পড়বে? ঘুমও হারাম। গাড়ি তো কিনলাম কিন্তু কেউ তো জানলো না, তাই বাড়ি বাড়ি গিয়ে সবার সাথে দেখা করতে লাগলাম। কারণ আমি তখন গাড়িওয়ালা, ছোট্ট এক গুচ্ছ দাঁড়ি ছিল তাই দাড়িওয়ালা আর বাড়ি থাকার সুবাদে বাড়িওয়ালাও। বাড়ি দাড়ি নিয়ে কেউ কোনো উপদেশ না দিলেও আমার ভাঙা গাড়ি নিয়ে উপদেশের পাহাড় জমে প্রায় উপমহাদেশ হয়ে যাবার দশা।

প্রথম যার বাসায় গেলাম তিনি প্রথমে গাড়ি থেকে আমাকে নামতে দেখে একটু অবাক হলেন। বললেন, বাহ্ বেশ সুন্দর গাড়ি তো (আসলে গাড়িটা অতটা সুন্দর ছিল না, কোথাও কোথাও ট্যাপ খাওয়া, বেশ কিছু স্ক্র্যাচও ছিল), কবে কিনলে? আমি বললাম এইতো কাল রাতে কেনার পরই আপনাকে দেখানোর জন্য প্রথম আপনার বাসায়ই এলাম। উনি খুবই খুশী হলেন। বিভিন্ন গল্পের পর শুরু হলো উপদেশের পালা। একটা কথা বলি, ‘কখনো ড্রাইভার রাইখো না তাইলে কাম সারা’।

আমি বললাম কেন? উনি বললেন, ড্রাইভারে তোমার গাড়ি মোয়া বানাইয়া তোমার হাতে ধরাইয়া দিয়া ভাগবো’, তাছাড়া ব্যাটারা তেল চুরি করতে ওস্তাদ, তোমার তেলের খরচ বাইরে যাইবো’। আমি ভাবলাম ঠিকই তো, তাছাড়া দুই দরোজার গাড়ি যদি ড্রাইভার চালায় আমাকে বসতে হবে পেছনে। আর আমি খাঁচায় বন্দী পাখির মত বসে থাকবো! না তা হতেই পারে না তাই ড্রাইভার রাখা ঠিক হবে না। তাঁর উপদেশ শিরোধার্য করে ওদিনের মত আনন্দ চিত্তে বাসায় ফিরলাম।

তখন মোবাইল ফোনের যুগ না, তাই কাউকে যোগাযোগ করা এত সহজ ছিল না। আর ল্যান্ড ফোন পাওয়া ছিল ভাগ্যের ব্যাপার। টি এন্ড টি তে ফোনের জন্য দরখাস্ত করার পর ছয় মাস পর ডিম্যান্ড নোট তার বছর খানেক পর ফোন পাওয়া যেতো। যাও বা পাওয়া যেতো প্রায়ই ফোন ডেড থাকতো। সৌভাগ্যক্রমে পৈত্রিক সুত্রে একটা ফোনের সংযোগ আমাদের বাসায় ছিল। তাই গাড়ি দেখানোর জন্য যে বন্ধুদের ফোনের সংযোগ আছে তাঁদের ফোন করতে শুরু করলাম।

ফোনের পর ফোন করেও প্রায় কাউকেও পাওয়া গেলো না। কি মুশকিল! কাছেই এক বন্ধুর বাসা ছিল তাঁর উদ্দেশেই রওয়ানা হলাম। ভাগ্য ভাল বন্ধু বাড়িতেই ছিল। আমার গাড়ি দেখে বেশ খুশীই হলো। বলল, ‘গাড়ি কিনেছিস? তা খালি হাতে কেন’? আমি বললাম, হাত খালি কই? হাতে গাড়ির চাবি, দেখতে পাচ্ছিস না? বলেই হেসে দিলাম। আমি শুনতে চাচ্ছিলাম সে কি বলে। বা উপদেশ দেয়। গাড়ি কিনলাম অথচ উপদেশ পাব না তা কি হয়! অনেক পরে শুরু হলো। তাঁর উপদেশ। যেমন, সময়মত মবিল (ইঞ্জিন অয়েল) চেঞ্জ করতে ভুলিস না কিন্তু, তাহলে না করলে ইঞ্জিন ছিজ হয়ে যাবে কিন্তু। ইত্যাদি ইত্যাদি।

আমার প্রতিবেশী সিদ্দিক সাহেব, হঠাত বাসায় এসে হাজির। ওনার শারীরিক গঠন বিশাল। সৈয়দ মুজতবা আলির নরশার্দূল দেখি নাই তবে ওনাকে দেখে আমার নরশার্দূল দেখা হয়ে গেছে। ভদ্রলোক সবসময়ই পান খান। আর যখন কথা বলেন অনবরত মুখ থেকে ছড়রা গুলির মত পিক মিশ্রিত থুথু স্প্রে হতে থাকে। সব চেয়ে সমস্যা হচ্ছে উনি যখন গুরুত্বপূর্ণ গোপনীয় কোন কথা বলেন তখন মুখটা কানের কাছে নিয়ে ফিসফিস করে কথা বলেন।

আমি গাড়ি কিনেছি এতে কোন গোপনীয়তা নেই তারপর কানে কানে বললেন, তুমি না কি গাড়ি কিনেছ? পিক স্প্রে অনুভব করলাম। তারপর বললেন, গাড়ির আসল হচ্ছে ইঞ্জিন, ওটা ঠিক মত দেখে নিয়েছ তো? আমি বললাম একটা ইঞ্জিনের দাম ৫০০০ টাকা আর গাড়ির দাম ৭৫০০০ টাকা তাহলে ইঞ্জিন সব হলো কেমন করে? একটু বিরক্ত হয়েই বললেন, তোমরা হচ্ছ চ্যংরা ছেলেপেলে, আর তর্ক করাই হচ্ছে এ বয়সের দোষ। আমি আর কথা বাড়ালাম না।

এখন ওঁর কাছ থেকে রেহাই পেতে চাই, তাছাড়া পানের পিকের অতি বর্ষণে আমার ডান কানে ফুটো প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে ততক্ষনে। আমি মনে হয় কানে কম শুনছি। নিজেকে এ অবস্থা থেকে রেহাই পাবার চেষ্টা করছি। বিধি সহায় হলেন ঘরের ফোন বেজে উঠলো আমি ফোন ধরার উছিলায় উঠে গেলাম। বাথরুমে আয়ানায় দাড়িয়ে দেখি আমার কান রক্তে লাল। আসল রক্ত না পানের পিক। কান পরিস্কার করতে গিয়ে কানে পানি ঢুকে গেলো। বসার ঘরে এসে ভদ্রলোককে বললাম আমাকে এখুনি বের হতে হবে। আচ্ছা পরে কথা হবে। আমার আর উপদেশ দরকার নেই বাবা অনেক হয়েছে। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, যারা আমাকে উপদেশ দিলেন তাঁদের কারো গাড়ি নেই কিন্তু গাড়ির নলেজ অসীম।

আমার মত মূর্খের কাছেও একবার আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের এক জুনিয়র ছেলে এসে হাজির। তার বেশ বড় সমস্যা দেখা দিয়েছে। আমি বললাম, ‘বলো তোমার জন্য কি করতে পারি’? ছেলেটা একটু লাজুক প্রকৃতির তাই বলার আগেই কান আর মুখ লজ্জায় লাল হয়ে গেলো। আমি বললাম অরে বলো না লজ্জার কি আছে’! সে বলবে বলবে করেও বলতে পারছে না। আমি তার কথা বের করার জন্য আন্দাজে ঢিল ছুড়তে লাগলাম। অবশেষে বাধ্য হয়েই বললাম, ‘এই ছেলে তুমি কি প্রেমে পড়েছো’? অব্যর্থ লক্ষ্য, উপরে নিচে বেশ কয়েবার মাথা নাড়লো।

আমি বললাম, ‘ ভালো খবর, তা তুমি মেয়েদের মত লজ্জা পাচ্ছ কেন? এবার সে সহজেই বলা শুরু করলো। তার বর্ণনা হচ্ছে, সে এক সাথে দুইটা মেয়েকে ভালোবেসে ফেলেছে, তাদের প্রতি তার ভালোবাসা সমান। কাউকেই সে না বলতে পারবে না। মানে মেয়ে দুটিও তার প্রেমের আহ্বানে সাড়া দিয়েছে। সমস্যা হলো ওই মেয়েরাও জেনে গেছে যে সে দুজনকেই প্রেমের প্রস্তাব দিয়েছে। এ সমস্ত ক্ষেত্রে সাধারণত দুজনেই কেটে পরে। কিন্তু এখানে তা হচ্ছে না। ওর বর্ণনা শুনে আমি পাথর হয়ে গেলাম। এ কি প্রেম না কি অন্য কিছু !ছেলেটি বললো, ‘আমাকে কিছু একটা উপায় বলে দিন প্লিজ ভাইয়া’।

আমি বললাম, ‘এ ব্যাপারে তোমাকে যে আমি ভালো উপদেশ দিতে পারবো, তোমার কেন এমন মনে হলো’? ছেলেটি বললো, ‘আমি সিনিয়রদের মধ্যে আপনাকেই সবচেয়ে জ্ঞানী মনে করি তাই এসেছি’। আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে কিছুক্ষন বসে রইলাম। এই মুহূর্তে ওর উপর রাগ হবার কথা তা হচ্ছে না, রাগের পরিবর্তে করুণা হচ্ছে। তারপর ভানু বন্ধোপাধ্যায়ের মতোই বললাম, ‘আচ্ছা তুমি যখন দুজনকেই সমান ভালোবাসো, সেক্ষেত্রে দুজনকেই একসাথে বিয়ে করে ফেলো, তাহলে ওরাও বুঝে যাবে যে তুমি ওদেরকে সমান ভালোবাসো।

এখন যাও আর বিরক্ত করো না’। ছেলেটি বললো, ‘কি বলেন ভাইয়া! তাহলে তো আরো সমস্যা বেড়ে যাবে, দুজনে সারাক্ষন ঝগড়া লাগবে আরও অশান্তির সৃষ্টি হবে’। আমি বললাম, ওরা ঝগড়া করলে তোমার কি? সেটা তাদের ব্যাপার’। আমার দিকে এমন ভাবে তাকালো যেন আমার মত আহাম্মক সে জীবনে দেখে নি। এরপর আমার কাছে তো উপদেশ নিতে আসেই নাই উপরোন্ত আমাকে দেখলে সে উল্টো দিকে হাঁটা দিত। ভাব খানা ভুলে রুম থেকে কি যেন আনা হয় নাই।

বাংলানিউজসিএ/ঢাকা/০৯ জুলাই ২০২০/এমএম

 

 


Array