মো. মইনুল হাসান (বাহার), ক্যালগারি, কানাডা :: ২৩ জুন ছিল ঐতিহাসিক পলাশী ট্রাজেডি দিবস । এই দিনটার নির্মম ট্রাজেডি, ষড়যন্ত্র ও বিশ্বাসঘাতকতার কথা মনে করে আমরা বেদনাহত হই । পলাশীর যুদ্ধের ষড়যন্ত্র, বিশ্বাসঘাতকতার ও কলঙ্কজনক ঘটনার মাধ্যমে কিভাবে এই দেশের মানুষের ভাগ্যে ব্যাপক বিপর্যয় নেমে আসে সে বিষয়ে সংক্ষিপ্ত কিছু লিখার চেষ্টা করছি। ঐতিহাসিক Melson পলাশীর প্রান্তরে সংঘর্ষকে ‘যুদ্ধ’বলতে নারাজ।
তার মতে, “কুচক্রীদের চক্রান্তে যুদ্ধের প্রহসন হয়েছিলো। বিশ্বাসঘাতকতা না হলে নবাবের বিজয় ছিলো সুনিশ্চিত।” ২৩ বছর বয়সী নবাব সিরাজউদ্দৌলা ক্ষমতা গ্রহণের পর নিজেকে দেশি ও বিদেশী কুচক্রী বেষ্টিত দেখতে পান। নিজ পরিবারেই তাঁর সবচেয়ে বড় শত্রূ ছিলেন তাঁর মায়ের বড় বোন ঘসেটি বেগম। তরুণ নবাবের পক্ষে কুচক্রীদের মোকাবেলা করার মতো দক্ষতা এবং অভিজ্ঞতা ছিলোনা। নবাবের পরাজয় ছিল রাজনৈতিক দুর্বলতা, সামরিক নয়।’
বিখ্যাত আরব পর্যটক ইবনে বতুতার বর্ণনায় ঐ সময়ে (উপনিবেশ শাসনের পূর্বে)) বাংলার সমৃদ্ধ অর্থনৈতিক অবস্থার বিবরণ পাওয়া যায়। দেশে খাদ্যশস্যের প্রাচুর্য এবং দৈনন্দিন ব্যবহার্য পণ্যের সস্তা দর উল্লেখ করে তিনি বলেছেন যে, পণ্যের এমন প্রাচুর্য ও সস্তা দর তিনি পৃথিবীর আর কোথাও দেখেন নি। এই মধুর লোভে ইউরোপীয়ানদের আনাগোনা শুরু হয় ।
মূলত বাংলার মসলিন, সুতি বস্ত্র, রেশম ও রেশমি বস্ত্র, নীল, চাল, মসল্লাসহ বিভিন্ন পণ্য তাদের কাছে আকর্ষণীয় ছিল । ইউরোপীয় বণিকদের মধ্যে প্রথমে পর্তুগিজরা এসে ষোল শতকের প্রথম দিকে বাণিজ্য শুরু করে। পরে ইংরেজ এবং ফরাসি ব্যবসায়ীদের আগমন ঘটে। তাছাড়া পর্তুগিজ এবং ওলন্দাজ জলদস্যুরা লুটপাটও করতে থাকে ।
পলাশীর বিপর্যয়ের ফলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তাদের সেবাদাসদের সাহায্যে বাংলায় আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়, এভাবেই গোটা ভারতবর্ষে ব্রিটেনের উপনিবেশ প্রতিষ্ঠার পথ সুগম হয়। এরপর সাম্রাজ্যবাদী শক্তি দীর্ঘ ১৯০ বছর এদেশে শাসন শোষণ করে। কোটি টাকার অর্থ সম্পদ ইংল্যান্ডে পাচার করে। বাংলাদেশ থেকে লুটকৃত পুঁজির সাহায্যে ইংল্যান্ডে শিল্প বিপ্লব ঘটে।
আর এককালের প্রাচ্যের স্বর্গ সোনার বাংলা পরিণত হয় শ্মশান বাংলায়, স্থান পায় বিশ্বের দরিদ্রতম দেশে । ব্রিটিশদের দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা এবং শত্রুতামূলক নানা নীতির কারনে ১৭৬৯-৭০ (বাংলা ১১৭৬) সালে নেমে আসে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ, তাতে লক্ষ মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। এটাই ইতিহাসিক ছিয়াত্তরের মন্বন্তর নামে পরিচিত।
তখন বাংলা, বিহার, উডিষ্যা, আসাম ও আরো কিছু অঞ্চল নিয়ে গঠিত হয়েছিল বৃহৎ বাংলা। এর আয়তন বিশাল হওয়াই পুরো বাংলা প্রেসিডেন্সিকে একসাথে শাষন করা ব্রিটিশদের পক্ষে প্রায় অসম্ভব ছিল। লর্ড কার্জন ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ করে পূর্ব বঙ্গ ও আসামকে নিয়ে গঠিত করেন পূর্ব বঙ্গ, যার রাজধানী হয় ঢাকা। পূর্ব বাংলায় পাট উৎপাদন হতো বেশি কিন্তু পাটকল ছিল না।
পাটকল ছিল কলকাতায় ও হুগলিতে, পূর্ববাংলার জনগণ পাটের উপযোক্ত মূল্য পেত না। এ জন্য পূর্ব বাংলার জনগন বঙ্গভঙ্গের পক্ষে ছিল। এ সময় লর্ড কার্জন বঙ্গভঙ্গের পক্ষে ঢাকার নওয়াব সলিমুল্লাহ সহ অনেক নেতৃবৃন্দের সমর্থন লাভ করেন। আর কলকাতাকেন্দ্রিক রাজনীতিবিদ এবং বুদ্ধিজীবীরা এর ঘোর বিরোধিতা করেছিল এই বলে যে আমরা একজাতি, বাংলা আমাদের মা, মাকে ভাগের চেষ্টা জীবন দিয়ে প্রতিরোধ করব।
অবশেষ ব্রিটিশ সরকার ১৯১১ সালে কলকাতা কেন্দ্রিক লোকদের আন্দোলনের কারণে বঙ্গভঙ্গ বাতিল করে দেয়া হয় । অথচ ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের সময় হোসাইন শহীদ সোহরাওয়ারদী, মৌলনা ভাসানী সহ অনেক পূর্ববাংলার রাজনীতিবিদ চেষ্টা করেছিলেন বাংলাকে (শেরে বাংলার ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাব অনুযায়ী) এক রেখে স্বাধীন রাষ্ট্র করার জন্য, কিন্তু এই কলকাতাকেন্দ্রিক রাজনীতিবিদরা বাংলাকে ভাগ করে কলকাতাসহ পশ্চিম বাংলা ভারতের অন্তুর্ভূক্তির সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এটা ছিল চরম দ্বিচারিতা।
পশ্চিম বাংলা একটা খণ্ডিত অংশ হিসেবে ভারতের অন্তুর্ভূক্তি হলেও রাজধানী কলকাতা নিয়ে শুরু হয় দ্বন্ধ। বাংলার শেরে বাংলা মুসলিম লীগের শীর্ষ নেতৃত্বে থাকার সময় জিন্নাহর সাথে দ্বন্দ্বের কারণে আলাদা দল (কৃষক প্রজা পার্টি) গঠন করে, তাতে মুসলিম লীগের সর্বময় ক্ষমতা জিন্নাহসহ পশ্চিমাদের হাতে চলে যায়। কংগ্রেস এবং মুসলিমলীগ পূর্ববাংলার রাজনীতিবিদদের আস্বস্থ করেছে এইবলে যে কলকাতার মূল্যবাবদ যে পরিমান টাকা পূর্ববাংলাকে দেয়া হবে তাতে ঢাকাকে আধুনিক এবং সমৃদ্ধশীল রাজধানী করা যাবে। সেই টাকা বাংলাদেশ আজ পর্যন্ত পায়নি।
তারপর, পাকিস্তান আমলের শোষণতো সর্বজন স্বীকৃত। বাংলাদেশের পাটের উপর নির্ভর করে পাকিস্তানের অর্থনীতি চলতো, অথচ বাংলাদেশের তেমন কোনো উন্নতি না করে বেশিরভাগ নিজেদের উন্নতির পিছনে খরচ করতো। ইসলামাবাদকে যখন নতুন এবং আধুনিক রাজধানী হিসেবে উদ্বোধন করা হয়, সেখানে বঙ্গবন্ধুও ছিলেন।
সাংবাদিকরা প্রশ্ন করেছিল নতুন রাজধানীর ব্যপারে ওনার অনুভূতির কথা জানানোর জন্য। বঙ্গবন্ধু চমৎকার উত্তর দিয়েছিলেন, বলেছিলেন “নতুন এবং আধুনিক রাস্তাঘাট এবং পরিকাঠামো, কিন্তু সর্বত্র পাটের গন্ধ”যাহোক, ১৯৭১ সালে অনেক রক্তের বিনিময়ে দেশ স্বাধীন হলো। কিন্তু পাকিস্তানিদের ফেলে যাওয়া অস্ত্র এবং সম্পদ কে নিয়ে গেলো! ‘দিনে দিনে বহু বাড়িয়াছে দেনা শুধিতে হইবে ঋণ’
বাংলানিউজসিএ/ঢাকা/ ২৯ জুন ২০২০ /এমএম