বাংলানিউজসিএ ডেস্ক :: করোনা মহামারীর এ দুঃসময়ের প্রায় পুরোটাই আমার পাবনার বাড়িতে কাটাতে হল। আর এ দীর্ঘ সময় শুয়ে-বসে কাটালেও লেখালেখিতে তেমন মন বসাতে পারিনি। সব সময় করোনায় আক্রান্ত মানুষের এবং নিজের কথা ভেবে ভাইরাসটির কবল থেকে পৃথিবী কবে মুক্ত হবে-এ চিন্তায় আচ্ছন্ন থাকায় মনটাকে লেখালেখির উপযুক্ত করে তুলতে না পারাই এর কারণ। তদুপরি এ রোগে আক্রান্ত হয়ে যারা ইন্তেকাল করেছেন এবং করছেন, তাদের তালিকাটাও মনকে খুব বেশি ভারাক্রান্ত করে চলেছে।
যেমন- এই সেদিন, পাবনা আসার আগের দিনও মোহাম্মদ নাসিমের সঙ্গে দেখা করে এসেছিলাম। বলেছিলাম, ‘যাই এলাকার মানুষের জন্য যৎসামান্য যা পারি করে আসি।’ সেদিন তাকে অত্যন্ত প্রফুল্ল অবস্থায় দেখে এসেছিলাম। তার এলাকা থেকে আগত লোকজন একের পর এক তার সঙ্গে ফটো তোলার বায়না ধরছিলেন আর তিনি তাদের সে ইচ্ছা পূরণ করছিলেন। সে অবস্থায় আমিও তার একটি ছবি তুলে এনেছিলাম। আর সেই নাসিম ভাই-ই চলে গেলেন, জীবনে আর কোনোদিন তার সঙ্গে দেখা হবে না!
আবার প্রায় এর কাছাকাছি সময়ে এক সন্ধ্যায় অফিসার্স ক্লাব থেকে বের হয়ে পাশেই ধর্ম প্রতিমন্ত্রী আবদুল্লাহ ভাইয়ের বাসায় তার সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে বন্ধুসুলভ সম্পর্ক থাকায় বলেছিলাম, ‘ভাই, এবারে হজে যাব বলে আমরা স্বামী-স্ত্রী নাম রেজিস্ট্রি করে রেখেছি; কিন্তু বয়স ও স্বাস্থ্যগত কারণে ভয় পাচ্ছি, আপনার মন্ত্রণালয়ের সরকারি আনুকূল্যে বিশেষ ব্যবস্থায় যেতে পারলে একটু ভরসা পেতাম।’ তিনি পরে যোগাযোগ করতে বলেছিলেন। বলেছিলেন, ‘আমার একার জন্য ব্যবস্থা করা যাবে। দুজনের জন্য নয়।’ সেই আবদুল্লাহ ভাইও চলে গেলেন! এভাবে আমার আরও বেশ ক’জন ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি ও বন্ধু করোনা আক্রান্ত হয়ে না ফেরার দেশে চলে গেলেন।
সুতরাং করোনা যে আমার মনে জেঁকে বসবে, সেটাই স্বাভাবিক। তাছাড়া দেশের সচেতন সব মানুষের মনেই এখন করোনাভীতি ছড়িয়ে পড়েছে। তাদের মনও এ রোগটির কারণে আকুলিত হওয়ায় তারাও স্বাভাবিক কাজকর্ম করতে পারছেন না। সীমিত আকারে অফিস-আদালত খুলে দেয়া হলেও সেখানে কাজকর্ম তেমন কিছু হচ্ছে বলে মনে হয় না। ইচ্ছা হলে কেউ অফিসে যাচ্ছেন, আর ইচ্ছা না হলে যাচ্ছেন না; এমন অবস্থায়ই অফিস-আদালত চালু রাখা হয়েছে। যাক সে কথা। এখন করোনা চিকিৎসা নিয়ে কিছু বলতে চাই।
বর্তমানে করোনা সমস্যা একটি বৈশ্বিক সমস্যা। সুতরাং সারা বিশ্বকেই এ সমস্যা মোকাবেলা করে পথ চলতে হচ্ছে, আর ইতোমধ্যে করোনাভারে জ্বরাক্রান্ত বেশ কয়েকটি দেশ সফলভাবে সমস্যাটি মোকাবেলা করে স্বাভাবিকতার দিকে এগিয়ে চলেছে। এর অন্যতম করোনার সূতিকাগার হিসেবে পরিচিত রাষ্ট্র চীন। তাছাড়া ভিয়েতনামসহ বেশ কয়েকটি রাষ্ট্রও এ ক্ষেত্রে সফলতা দেখিয়েছে। তবে এ বিষয়ে আমরা যা কিছু করেছি বা যা কিছু করতে পেরেছি সে বিষয়ে এখানে কিছু আলোচনা বা আলোকপাত করা যেতে পারে।
প্রথমেই যে বিষয়টি বলা প্রয়োজন তা হল, মার্চ-এপ্রিলের প্রাথমিক সময়টিতে আমরা কোথায় কী করেছি। সে সময়ে একশ্রেণির ডাক্তারের পলায়নপর মনোবৃত্তিসহ করোনাসংক্রান্ত বিভিন্ন বিধি-ব্যবস্থায় যে অব্যবস্থাপনা লক্ষ করা গেছে, তা কি পৃথিবীর অন্য কোথাও ঘটেছে? এমনকি আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ নেপালে? তখনই যদি সঠিক ব্যবস্থাপনাসহ করোনাসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ যথাযথভাবে গ্রহণ করা হতো, তাহলে বর্তমানে আমরা এর সুফল পেতাম। সে সময়ে চিকিৎসাক্ষেত্রে যে অব্যবস্থাপনা-অরাজকতা দেখা গেছে, তাতে আমাদের দেশের চিকিৎসাব্যবস্থার স্বরূপটিও উন্মোচিত হয়েছে।
যদিও সরকার এসব দেখেশুনে সময়োপযোগী পদক্ষেপ হিসেবে নতুন ডাক্তার নিয়োগ দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দিয়েছে; কিন্তু সে সময়ের মধ্যেই এ বিষয়ে অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে। আর বর্তমানেও সে বেহাল দশার অবসান হয়েছে এমনটিও নয়। দেশের স্বাস্থ্য খাতে যুগ যুগ ধরে যে অনিয়ম-দুর্নীতি জমাট বেঁধে আছে, তা সরিয়ে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়নি। আর কবে তা সম্ভব হবে সেটিও আমরা জানতে বা বুঝতে পারছি না।
কারণ, এ মুহূর্তেও মানুষ এ হাসপাতাল, সে হাসপাতাল ঘুরে ভর্তি হতে না পেরে চিকিৎসার অভাবে রাস্তায় প্রাণ বিসর্জন দিচ্ছেন! করোনা পরীক্ষা করানোর জন্য মানুষের হাহাকার দেখে মনে হছে এ কোথায় আছি! আবার টেস্টের পর রিপোর্ট আসতে যে সময় লাগছে সে সময়ের মধ্যে রোগীর মৃত্যুহারও স্বাস্থ্য বিভাগের ব্যর্থতা স্পষ্ট করে তুলেছে। সরকারের হাজার চেষ্টায় যেসব উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে, তার সুফল জনগণের কাছে পৌঁছাতে স্বাস্থ্য বিভাগ ব্যর্থ হচ্ছে। স্বাস্থ্য বিভাগের দুর্বল ব্যবস্থাপনার কারণে চিকিৎসাক্ষেত্রে মানুষের ভোগান্তি কমানো যাচ্ছে না।
এ খাতে সরকার কর্তৃক বরাদ্দ অর্থের ব্যবহারসহ প্রায় সব ক্ষেত্রই দুর্নীতির করাল গ্রাসে আক্রান্ত। দুর্নীতির ধারাবাহিকতা থেকে স্বাস্থ্য খাতকে উদ্ধার করে জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়া মহা কঠিন কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ, এ বিষয়ে সরকার গৃহীত পদক্ষেপগুলো বারবার ব্যর্থতায় পর্যবসিত হচ্ছে। বারবার ব্যক্তি পরিবর্তন করেও এ ক্ষেত্রে সুফল পাওয়া যাচ্ছে না।
সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিক কোথাও নিয়ম মানা হচ্ছে না। অত্যন্ত নির্দয়ভাবে রোগী ভর্তি করতে, চিকিৎসা দিতে অস্বীকার করা হচ্ছে। হাসপাতালের পর হাসপাতাল থেকে রোগী ফেরত দেয়ায় মহান আল্লাহর সৃষ্টি আশরাফুল মাখলুকাত আদম সন্তানকে বিনা চিকিৎসায় রাস্তায় প্রাণ দিতে হচ্ছে। আর এ বিষয়ে সরকারি নির্দেশ অনুযায়ী রোগী ভর্তির নিয়ম বা বাধ্যবাধকতা থাকলেও তা মানা হচ্ছে না।
কারণ, যেসব সরকারি কর্তাব্যক্তি আদেশ-নির্দেশ বাস্তবায়ন করাবেন তাদের যোগ্যতা, দক্ষতা, মেধা, ইচ্ছাশক্তি ইত্যাদির অভাব আছে। ফলে ওইসব হাসপাতাল-ক্লিনিকের ওপর তাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। এতদিন তারা এসব পদে প্রাইজ পোস্টিং নিয়ে এসে নিয়োগ-বদলি বাণিজ্য করেছেন, ওষুধ ও যন্ত্রপাতিসহ আনুষঙ্গিক পণ্য ক্রয়ে দুর্নীতি করেছেন বিধায় সেই অভ্যাস থেকে বেরিয়ে এসে সরকারের সদিচ্ছা বাস্তবায়নে ব্রতী হতে পারছেন না। আর রাতারাতি তা পারবেন বলেও মনে হয় না। অভ্যাস বদলাতে সময় লাগবে। আর ততদিনে ছোটবেলায় ইংরেজি গ্রামারের Past participle শেখার মতো ‘ডাক্তার আসিবার পূর্বে রোগী মারা যাইতেই থাকিবেন।’
উপরোক্ত অবস্থায় সরকারকেও খানিকটা কৌশলী ও কঠোর ভূমিকা অবলম্বন করতে হবে। স্বাস্থ্য বিভাগে ইতোমধ্যে যারা প্রাইজ পোস্টিং গ্রহণ করে ‘কী’ পোস্টগুলো দখল করে বসে আছেন, তাদের প্রায় সবাই রাজনীতি করেন। ড্যাব ইত্যাদি সংগঠনের মাধ্যমে তারা যখন যে সরকার আসে সেই সরকারেরই লেজুড়বৃত্তি করেন বা করতে চান। আজ থেকে বহু বছর আগে আমি একবার একজন নবনিযুক্ত স্বাস্থ্যমন্ত্রীর বাসায় গিয়ে দেখেছিলাম, বেলা ১১টার দিকে প্রায় দেড়শ’ ডাক্তার তার বাড়িতে উপস্থিত এবং আগের দিনসহ দু’দিনের যে পরিমাণ ফুলের তোড়া তার বাসার সামনে দেখেছিলাম, তা সরাতে কমপক্ষে বড় আকারের একটি ট্রাক প্রয়োজন!
অথচ ওই সময়টায় তাদের ডিউটিতে থাকার কথা। এ অবস্থায় ডাক্তার সাহেবদের এ কালচার থেকে বের করে আনাই হবে সময়ের কাজ। জানি না আমার সঙ্গে বর্তমান স্বাস্থ্যমন্ত্রী বা সরকারের নীতিনির্ধারক মহল একমত হবেন কি না। তবে আবারও বলে রাখি, অবস্থা এমনটি চলতে থাকলে রাজনীতি করে খাওয়া ডাক্তারদের সঙ্গে কোনোদিনও পেরে ওঠা যাবে না।
তাছাড়া তাদের পেশাগত সংগঠন ব্যবহার করেও তারা যাতে স্বার্থ উদ্ধার করতে না পারেন বা পরিবহন শ্রমিকদের মতো সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে না পারেন, সে বিষয়েও আইন প্রণয়ন জরুরি বলে মনে করি। আর সেসব আইন প্রয়োগে সরকারের সদিচ্ছা ও সক্ষমতার প্রশ্নটিও মাথায় রাখতে হবে। অন্যথায় বারবার স্বাস্থ্যমন্ত্রী বদলালেও যে লাউ সেই কদুই থেকে যাবে। কোনো স্বাস্থ্যমন্ত্রীই রাজনীতি করা ওই শ্রেণির ডাক্তার সাহেবদের সঙ্গে এঁটে উঠবেন বলে মনে হয় না।
বর্তমানে কয়েক হাজার জুনিয়র ডাক্তারকে বাড়ি থেকে ডেকে এনে রাতারাতি নিয়োগ দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেয়ার চেষ্টা করায় এবং নবনিযুক্ত ডাক্তার সাহেবরা খুশিমনে দায়িত্ব পালনে ব্রতী হওয়ায় বিষয়টি আপাতত সংকট সমাধান হিসেবে বিবেচিত হলেও মূল সমস্যা কিন্তু রয়েই গেছে। সিনিয়র লেভেলে যেমন ডাক্তার সমস্যা রয়েছে, তেমনি বিশেষজ্ঞ পর্যায়ে সমস্যাটি আরও প্রকট।
করোনা রোগে তো নয়ই, অন্যান্য রোগেও দেশের মানুষ এ মুহূর্তে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সেবা পাচ্ছেন না। ভিভিআইপি রোগীদের বিষয়টি আলাদা। সুতরাং সবকিছু বিবেচনা করে চিকিৎসাসেবাকে ঢেলে সাজানো প্রয়োজন। আর সরকারকেও তাই বলব, আমরা আমাদের ট্যাক্সের টাকায় ভালো স্বাস্থ্যসেবা চাই, স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দকৃত অর্থের লুটপাট দেখতে চাই না। সেই সঙ্গে স্বাস্থ্য বিভাগে রাজনীতি করা ডাক্তারও দেখতে চাই না। চাই পেশাজীবী ডাক্তার।
দেশের এ সংকটময় মুহূর্তে যেসব ডাক্তার তাদের মহান পেশাকে সমুন্নত রাখতে জীবনবাজি রেখে মানুষের সেবা দিয়ে চলেছেন, করোনা রোগী দেখে ভয়ে দূরে সরে না থেকে সেবার মহান দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, করছেন এবং করবেন, তাদের হাতে স্বাস্থ্য বিভাগের দায়িত্ব তুলে দেয়াই হবে এখন সময়ের কাজ।
পরিশেষে মৃত্যুঞ্জয়ী ওইসব ডাক্তার সাহেবকে স্যালুট জানিয়ে বলতে চাই, দেশের এ সংকটকালে, এ দুঃসময়ে যেসব ডাক্তার-নার্স-স্বাস্থ্যকর্মী মানুষের সেবা করে চলেছেন, করোনা রোগী দেখে পালিয়ে থাকেননি, তারা বীরের মতো কাজ করেছেন। আর এ জাতি বীরের সম্মান দিতে জানে। মুক্তিযুদ্ধের বীরদের এ দেশ ও জাতি ভোলেনি। একাত্তরে দেশ ও জাতিকে বাঁচাতে যারা ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন আর বর্তমানে যারা করোনাযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন এবং পড়ছেন, তাদের মধ্যে একটা পার্থক্য থাকলেও সে পার্থক্যটুকু খুব বড় নয়।
কারণ, উভয় ক্ষেত্রেই জীবনের ঝুঁকি ছিল এবং আছে। সুতরাং, করোনাযুদ্ধে যেসব ডাক্তার-নার্স-স্বাস্থ্যকর্মী আর্তমানবতার সেবায় এগিয়ে এসে প্রাণ দিলেন, তাদের যেন আমরা সুসময়ে ভুলে না যাই, তজ্জন্য স্বাস্থ্যমন্ত্রী মহোদয়কে এখন থেকেই এসব বীরের তালিকা প্রস্তুত করে তাদের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের প্রস্তুতি গ্রহণ করার বিষয়টি ভেবে দেখার অনুরোধ জানাচ্ছি। সবশেষে কবিগুরুর ভাষায় বলছি, ‘ভয় নাই ওরে ভয় নাই, নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই।’
বাংলানিউজসিএ/ঢাকা/ ২৭ জুন ২০২০ /এমএম





