বাংলানিউজসিএ ডেস্ক :: বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও বিশেষজ্ঞদের মতে, করোনার তাণ্ডব খুব শিগগির শেষ হচ্ছে না। কারও কারও মতে, এ অবস্থা আগামী দু’বছর পর্যন্ত চলতে থাকবে। এ অবস্থায় আগামী দিনগুলোয় বিশ্বের গরিব দেশগুলোয় করোনার সংক্রমণ আরও বাড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
এসব গরিব দেশের কথা ভেবেই মোবাইলভিত্তিক অ্যাপ তৈরি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। গুগল ও মাইক্রোসফটের অ্যাপ ডেভেলপারদের তত্ত্বাবধানে অ্যাপটি তৈরি করা হচ্ছে।
যে কোনো দেশ অ্যাপটির কাস্টমাইজ সংস্করণ তৈরি করে জনগণের জন্য উন্মুক্ত করতে পারবে। কোভিড-১৯ হয়েছে কি না, তা যাচাইয়ে অ্যাপটি ব্যবহারকারীকে বিভিন্ন লক্ষণ সম্পর্কে প্রশ্ন করবে। এতে ব্লুটুথভিত্তিক ‘কন্টাক্ট ট্রেসিং’ ফিচার সংযোজন করা হয়েছে।
‘কন্টাক্ট ট্রেসিং’ বা সংক্রমণ-বাহক অনুসন্ধান প্রক্রিয়াটি জনস্বাস্থ্য খাতে সংক্রামক রোগব্যাধির নিয়ন্ত্রণে বহু দশক ধরেই ব্যবহৃত হয়ে আসছে। ‘কন্টাক্ট ট্রেসিং’ বলতে বোঝায়- যারা নিশ্চিতভাবে ছোঁয়াচে রোগাক্রান্ত (বা নিশ্চিতভাবে রোগজীবাণু দ্বারা সংক্রমিত) ব্যক্তির সংস্পর্শে এসেছেন, এমন সম্ভাব্য সব ব্যক্তিকে অনুসন্ধান ও শনাক্ত করা। এভাবে প্রক্রিয়াটি চলতে থাকে, যতক্ষণ-না পর্যন্ত সব সংক্রমিত ব্যক্তিকে খুঁজে পাওয়া না যায়।
এ পদ্ধতিতে মোবাইলের ব্লুটুথ ওয়াই-ফাই দিয়ে আশপাশের লোকজনের তথ্য সংগ্রহ (স্ক্যানিং) করে স্ক্যানিংকৃত ডেটা তাৎক্ষণিকভাবে মোবাইল নেটওয়ার্কের মাধ্যমে মূল সার্ভারে রক্ষিত করোনা সংক্রান্ত বিগডেটা তথা ইন্ট্রিগেটেড ডেটা ওয়্যারহাউসের সঙ্গে পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণ করে প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত নিয়ে রিয়েলটাইম রেসপন্স বা বার্তা রোগীর কাছে প্রেরণ করে। উল্লেখ্য, করোনার সব বৈশ্বিক বৈশিষ্ট্যসংবলিত একটি সংস্করণ ওই অ্যাপ স্টোরে থাকবে।
‘কন্টাক্ট ট্রেসিং’ পদ্ধতিতে তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে সংক্রমণের আশঙ্কা থাকলে কীভাবে পরীক্ষা ও টেস্ট করাতে হবে, সে দিকনির্দেশনা দেবে অ্যাপটি। এ ক্ষেত্রে অবশ্য দেশভেদে তথ্যের ভিন্নতা থাকবে। এরপর যে কোনো দেশের সরকার চাইলে অ্যাপের প্রযুক্তি ব্যবহার করে এতে নতুন সুবিধা যোগ করে নিজেদের মতো সংস্করণ ছাড়তে পারবে।এমনকি এসব অ্যাপের মাধ্যমে ব্যবহারকারী উপসর্গের ভিত্তিতে কোথায় গিয়ে করোনা পরীক্ষা করানো যাবে, তা জানতে পারবে।
ধরুন, আপনি করোনায় আক্রান্ত কি না, তা আপনার জানা নেই। আবার জানা থাকলেও অনেকে লজ্জায় কিংবা আতঙ্কে বলতে চান না। তথ্য লুকানো কিংবা গোপন রাখেন অনেকে; কিন্তু এ অ্যাপ থাকলে সেটি করার সুযোগ নেই। এভাবে করোনা প্রতিরোধ ও সচেতনতায় ‘কন্টাক্ট ট্রেসিং’ খুবই কার্যকর ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
‘কন্টাক্ট ট্রেসিং’ বা স্ক্যানিং প্রক্রিয়ার এ সুবিধা পেতে হলে ব্যবহারকারীর মোবাইলে এ অ্যাপটি ইন্সটল করা থাকতে হবে। আর এর জন্য অবশ্যই থাকতে হবে ব্যবহারকারীর মোবাইলে ইন্টারনেট কানেকটিভিটি। অর্থাৎ যেসব মোবাইলে অ্যাপটি ইন্সটল করা আছে শুধু তাদের তথ্যই সে আদান-প্রদান করতে পারে। তবে যেখানে ইন্টারনেট নেই সেখানে শুধু ব্লটুথ দিয়েই এর কার্যকারিতা পাওয়া যাবে বলে দাবি করছেন এর আবিষ্কারকরা।
এভাবে যত বেশি ব্যবহারকারী এ অ্যাপটি তার মোবাইলে রাখবে- ততই এর কার্যকারিতা ও উপযোগিতা পাওয়া যাবে। বিশ্ববাজারে এখন পর্যন্ত এ ধরনের যেসব অ্যাপ ডেভেলপ হয়েছে এবং ব্যবহৃত হচ্ছে সেগুলো প্রায় দু-তিন সপ্তাহের তথ্য বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা রাখে।
অর্থাৎ গত ১৪ থেকে ২১ দিনে ব্যবহারকারী কোনো করোনা রোগীর সংস্পর্শে এসেছিলেন কি না, সেই তথ্য সংরক্ষণ করতে পারে। এভাবে এক মোবাইল থেকে অন্য মোবাইলে তথ্যের আদান-প্রদান ঘটে এবং করোনাভাইরাস নিয়ে মানুষকে সচেতন করে থাকে। তাই বলা যেতে পারে, এ মুহূর্তে মোবাইল অ্যাপ করোনাযুদ্ধে কার্যকর ও প্রশংসনীয় ভূমিকা রাখছে।
আমাদের দেশেও ব্লুটুথভিত্তিক এ ধরনের অ্যাপ তৈরি হচ্ছে। ‘কোভিড ফাইন্ডার’ নামে মোবাইল অ্যাপ উদ্ভাবন করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আইআইটির সহযোগী অধ্যাপক ড. ওয়াহিদুজ্জামান ও শিক্ষার্থী রাজন হোসেন। ‘পাশে আছি মোবাইল অ্যাপ’ নামে অপর আরেকটি অ্যাপ উদ্ভাবন করেছেন একই ইন্সটিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড. শামীম আল মামুন ও শিক্ষার্থী শাহিন বাশার।
অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণাগারেও এ ধরনের অ্যাপ তৈরি হচ্ছে। আইসিটি ডিভিশনের তত্ত্বাবধানে ‘লাইভ করোনা টেস্ট’ নামে একটি অ্যাপ তৈরি করা হয়েছে। সাধারণ কিছু তথ্যের মাধ্যমে অ্যাপটি বলে দিতে পারে করোনার ঝুঁকির মাত্রা। ‘করোনা আইডেন্টিফায়ার’ নামে অপর একটি অ্যাপ তৈরি করেছে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ।
ভারতে ‘আরোগ্য’ নামে এক ধরনের অ্যাপ ব্যবহৃত হচ্ছে। সিঙ্গাপুর, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্য, ইউরোপসহ বিশ্বের অনেক উন্নত দেশ এ ধরনের অ্যাপ ব্যবহার করে সুফল পাচ্ছে। দক্ষিণ কোরিয়া বেশ দ্রুততম সময়ের মধ্যে করোনা আতঙ্ক মোটামুটি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছে এ অ্যাপ ব্যবহার করে।
বাংলাদেশে করোনায় আক্রান্ত অনেক রোগী যখন ডাক্তার ও হাসপাতালের পেছনে ঘুরতে ঘুরতে ক্লান্ত, তখন তার হাতে থাকা মোবাইল অ্যাপ থেকেই জানতে পারেন তিনি কতটুকু আক্রান্ত। জানতে পারবে তার আশপাশে থাকা লোকজনের অবস্থা কী। যদি অ্যাপটি হাসপাতালে প্রবেশ মুখে কিংবা ডাক্তারের চেম্বারে বা শপিং মলে সেট করা থাকে, তবে সেখান থেকেই বোঝা যাবে আগত লোকটি কিংবা ব্যবহারকারী করোনায় আক্রান্ত কি না অথবা তার বর্তমান স্ট্যাটাস কী।
প্রস্তুতকৃত প্রতিটি অ্যাপের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য থাকতে পারে, তবে মূল উদ্দেশ্য একটাই- করোনা সচেতনতায় সহায়তা করা। তাই করোনার এ ভয়াবহ পরিস্থিতিতে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা কমিয়ে সব ধরনের উদ্ভাবনকে আমলে নিলে বিজ্ঞানীরা অনুপ্রাণিত হবেন এবং ভবিষ্যতে দেশের কল্যাণে কাজ করতে উৎসাহিত হবেন। কাজেই দ্রুত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে অ্যাপগুলো কার্যকর করার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে যথাযথ পদক্ষেপ নেয়া দরকার।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বিশ্বের গরিব দেশগুলোয় অ্যাপ তৈরি করার মতো প্রকৌশলীরও অভাব রয়েছে এবং অ্যাপ তৈরি করে দিলেও তা পরীক্ষা-নিরীক্ষার সুযোগ নেই। এ অবস্থায় সারা বিশ্বের সব অঞ্চলের ডেটা সংগ্রহ করে ‘বিগডেটা অ্যানালাইসিস’, ‘ডেটা মাইনিং’ কিংবা অন্য কোনো ডিজিটাল পদ্ধতিতে বিশ্লেষণপূর্বক ফলাফল পর্যবেক্ষণ করে অঞ্চলভিত্তিক সমাধানের দিকে এগোলে টেকসই ফল পাওয়া যাবে।
অর্থাৎ বিশ্বের অন্যান্য দেশের দিকেও নজর দিতে হবে এবং সে অনুযায়ী মোবাইল অ্যাপ উদ্ভাবনের দিকে মনোযোগ দিতে হবে। অনুন্নত দেশগুলোয় অনেকের এ ধরনের অ্যাপ ব্যবহার উপযোগী মোবাইল ফোন কেনার সামর্থ্য নেই। সে ক্ষেত্রে বিনা মূল্যে কিংবা স্বল্পমূল্যে মোবাইল ফোনও সরবরাহের ব্যবস্থা করতে হবে।
লেখাপড়া না-জানা ব্যবহারকারীর জন্য প্রয়োজনে আঞ্চলিক ভাষায় অডিও ও ভিডিওর মাধ্যমে প্রয়োজনীয় বার্তা পৌঁছানোর ব্যবস্থা রাখা যেতে পারে। ব্যবহৃত মোবাইল থেকেও সংক্রমণ ছড়াতে পারে। সে জন্য ঘন ঘন হাত ধোয়ার মতো নিজের মোবাইল ফোনটিও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে।
প্রফেসর ড. এম মেসবাহউদ্দিন সরকার : পরিচালক (আইআইটি) এবং তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
বাংলানিউজসিএ/ঢাকা/ ২২ জুন ২০২০ /এমএম





