Menu

বাংলানিউজসিএ ডেস্ক :: ২৩ মার্চ থেকে ৩১ মে লকডাউন জীবনের ৭০ দিন পার করেছে যুক্তরাজ্য। ১ জুন থেকে লকডাউন শিথিল হয়েছে। এখন খোলা মাঠে একাধিক পরিবার একত্রে মিলিত হতে পারছে। তবে সর্বোচ্চ ৬ জন করে নির্ধারিত সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে।

কেউ দূরে কোথাও ড্রাইভ করে যেতে পারবেন না। অন্যের ঘরে রাত্রিযাপন করতে পারবেন না। অনেকেই এখন স্বাস্থ্যবিধি মেনে সপরিবারে পার্কে ঘুরতে যাচ্ছেন। তবে মানুষের মন থেকে আতঙ্ক কাটছে না।

আমাদের নাড়ির টান যে দেশের সঙ্গে; সেই মাতৃভূমি বাংলাদেশে করোনায় মৃত্যু ও আক্রান্তের হার বাড়ছে অস্বাভাবিক গতিতে। দিন দিন পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাচ্ছে। আমাদের প্রত্যেকের স্বজন আছেন দেশে। যুক্তরাজ্যে স্বস্তির বাতাস গায়ে লাগলেও বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে আমরা খুব উদ্বিগ্ন।

বিশেষ করে যখন করোনায় আক্রান্ত নন এমন কোনো রোগীর সারাদিন বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালের দ্বারে দ্বারে ঘুরে চিকিৎসা করানোর সুযোগ না পেয়ে বহনকারী গাড়ি কিংবা অ্যাম্বুলেন্সেই মৃত্যুবরণ করার খবর দেখি তখন হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়।

সম্প্রতি বাংলাদেশের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত একটি খবর আমার মতো অনেককেই ব্যথিত করেছে। সিলেট নগরীর পশ্চিম কাজীরবাজার মোগলটুলা এলাকার বাসিন্দা আবদুল আহাদ লেচু মিয়ার স্ত্রী মনোয়ারা বেগম প্রায় ৩০ বছর ধরে অ্যাজমায় ভুগছিলেন। ৩০ মে রাতে শরীর বেশি অসুস্থ হয়ে পড়ায় স্বজনরা তাকে হাসপাতালে নিয়ে যান।

তিনি নগরীতে অর্ধডজন বেসরকারি হাসপাতালে ঘুরে চিকিৎসা না পেয়ে রাত আড়াইটার দিকে সিলেট ওসমানী হাসপাতালের জরুরি বিভাগের গেটে অ্যাম্বুলেন্সেই মারা যান।

এর চেয়ে আরও ভয়ংকর পরিণতি বরণ করতে হয়েছে মৌলভীবাজারের রাজনগর সদর ইউনিয়নের যুক্তরাজ্য প্রবাসী আজিজুজ জামান খানকে। সম্প্রতি তিনি ব্রিটিশ সরকারের পাঠানো বিশেষ ফ্লাইটে যুক্তরাজ্যে ফিরে বাংলাদেশের চিকিৎসাসেবা নিয়ে সাংবাদিকদের কাছে ভয়াবহ অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়েছেন।

যুক্তরাজ্য থেকে ১ মার্চ বাংলাদেশে গিয়েছিলেন তিনি। ৯ মার্চ আকস্মিক বুকে ব্যথা অনুভব করেন। ওই রাতেই তাকে নিয়ে যাওয়া হয় নগরীর আল-হারামাইন হাসপাতালে। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, জামান খান যুক্তরাজ্যপ্রবাসী এ কথা জানার পর ওই হাসপাতাল তাকে চিকিৎসা দিতে অপারগতা প্রকাশ করে। এরপর রাত ১২টার দিকে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় শহরের ইবনেসিনা হাসপাতালে। একটা কেবিনে রেখে চিকিৎসা শুরু হয়।

পরদিন সকালে তাকে স্থানান্তর করা হয় ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে। সেখানে তাকে মনিটরে রাখা হয়। কিন্তু যখন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানতে পারেন জামান খান যুক্তরাজ্য প্রবাসী, তখনই উত্তেজিত হয়ে ওঠেন। রোগীকে দ্রুত সেখান থেকে নিয়ে যেতে বলা হয়। এতে খানিকটা দেরি হওয়ায় মনিটর খুলে রেখে তাকে হুইল চেয়ারে করে হাসপাতালের একেবারে নিচতলায় গাড়ি পার্কিংস্থলে রেখে আসা হয়।

এরপর সেখান থেকে তাকে পাঠিয়ে দেয়া হয় সিলেটের একমাত্র করোনা চিকিৎসাকেন্দ্র শহীদ শামসুদ্দিন হাসপাতালে। সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক প্রাথমিক পরীক্ষা-নিরীক্ষায় নিশ্চিত হন জামান খান হৃদরোগে ভুগছেন। তিনি তাকে ঢাকায় নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন। সঙ্গে সঙ্গে এও সতর্ক করে দেন, তারা যে যুক্তরাজ্য প্রবাসী এ কথা কাউকে যেন ভুলেও না বলেন।

ডাক্তারের পরামর্শমতো তারা ঢাকায় যাওয়ার জন্য ৪৫ হাজার টাকায় একটি অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করেন। রোগীকে অ্যাম্বুলেন্সে শোয়ানোর পর মনিটর লাগানো হয়। কিন্তু দুঃখের বিষয়, কিছুক্ষণের মধ্যেই অ্যাম্বুলেন্স ড্রাইভার জানতে পারেন রোগী যুক্তরাজ্য প্রবাসী। আর তৎক্ষণাৎ মনিটর খুলে রোগীকে জোর করে নামিয়ে দেয়া হয়।

অবশেষে অনেক চেষ্টার পর সাধারণ একটা অ্যাম্বুলেন্সে করে রোগীকে ঢাকায় নিয়ে যেতে সক্ষম হয় জামান খানের পরিবার। কিন্তু দুর্গতি যেন তাদের পিছু ছাড়ে না। ঢাকায় ছয়টি হাসপাতাল ঘুরে তাকে কোথাও ভর্তি করতে পারলেন না। কারণ হাসপাতালের ডাক্তার-নার্সরা তাদের কথাবার্তা থেকে আঁচ করতে পারেন তারা বিদেশি।

শেষতক বিদেশি পরিচয় লুকিয়ে রাখতে সক্ষম হন এবং ১১ মার্চ ধানমণ্ডির একটি হাসপাতালে রোগীকে ভর্তি করা সম্ভব হয়। ১০ দিন চিকিৎসা শেষে তিনি গ্রামের বাড়িতে ফিরে যান। দেড় মাসের বেশি সময় বাড়িতে একাকী থাকেন। ভাগ্য সুপ্রসন্ন হওয়ায় ৭ মে ব্রিটিশ সরকারের পাঠানো বিশেষ ফ্লাইটে যুক্তরাজ্যে ফিরে আসেন।

এ তো গেল করোনা আক্রান্ত না হয়েও হাসপাতালের দ্বারে দ্বারে ঘুরে চিকিৎসা না পাওয়ার মর্মান্তিক ঘটনার কথা। সম্প্রতি একটি পত্রিকায় প্রকাশিত আরও একটি সংবাদ দেখে মানুষ শিউরে উঠেছে। সংবাদের শিরোনাম : ‘মৃত্যুর আগে বাইরে থেকে দরজার সিটকিনি লাগিয়ে দেন স্ত্রী সন্তান, পানি চেয়েও পাননি’।

ফেনীর সোনাগাজীতে করোনাভাইরাস সংক্রমণের উপসর্গ জ্বর, কাশি ও শ্বাসকষ্ট নিয়ে বদ্ধঘরে সাহাব উদ্দিনের মৃত্যুর আগের বীভৎস চিত্র ফুটে উঠেছে ওই প্রতিবেদনে। মৃত্যুর আগে পরিবারের লোকজন তাকে ঘরের একটি রুমে একা রেখে বাইরে থেকে দরজার সিটকিনি লাগিয়ে রাখেন। দেয়া হয়নি দুপুরের খাবার। মৃত্যুর সময় পানি চেয়েও পাননি।

মৃত্যুর পরও কাছে আসেননি স্ত্রী, ছেলে, মেয়ে ও জামাতাসহ কোনো স্বজন। মৃত্যুর পর তিনি পাননি স্থানীয় মসজিদের খাটিয়া, কেউ দেয়নি কবর খোঁড়ার কোদালও। কত মর্মান্তিক ঘটনা! বিশ্বের ২১৪টি দেশের মানুষ করোনা আক্রান্ত হয়েছেন। তবে করোনাকালে এমন নিষ্ঠুর ঘটনা সম্ভবত বাংলাদেশেই প্রথম। এর আগেও অনেক ঘটনা ঘটেছে। তবে এবারের ঘটনা নিষ্ঠুরতার দিক থেকে সব ঘটনাকে ছাড়িয়ে গেছে।

ব্রিটেনে আমাদের বন্ধু-স্বজনদের মধ্যে অনেকেই করোনা আক্রান্ত হয়ে দুই-তিন সপ্তাহ ঘরবন্দি ছিলেন। কিন্তু পরিবারের লোকজন কাউকে রুমের ভেতরে রেখে বাইরে থেকে দরজার সিটকিনি লাগিয়ে দেয়নি। বরং পরিবারের লোকজন ঘরেই ছিলেন। স্বাস্থ্যবিধি মেনে করোনা আক্রান্ত ব্যক্তির সেবা-শুশ্রূষা করেছেন। তারা সুস্থও হয়ে উঠেছেন।

এতে করে পরিবারের অন্য কোনো সদস্যের আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া যায়নি। আর গোটা দেশে প্রায় ৪৩ হাজার মানুষ মারা গেলেও হাসপাতালের দ্বারে দ্বারে ঘুরে চিকিৎসা না পেয়ে কারও মৃত্যুবরণ করার সংবাদ শুনতে হয়নি।

বাংলাদেশে এমন অমানবিক ঘটনা একের পর এক ঘটেই চলেছে। সংবাদপত্র ও সোশ্যাল মিডিয়ায় যখন ঘটনাগুলো দেখি তখন অসুস্থবোধ করি। আগে যে ক্লিনিকগুলো রোগী ধরার জন্য ২৪ ঘণ্টা দালাল নিয়োগ করে রাখত, আজ তারা রোগীদের তাড়িয়ে দিচ্ছে। বিপদের সময় মানুষ যদি হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসা নিতে না পারে, তাহলে এসব ক্লিনিক নামক টাকা বানানোর কারাখানা রেখে লাভ কী?

বাংলাদেশ সরকারের সিদ্ধান্ত, সব হাসপাতালে করোনা ইউনিট থাকবে। এই সিদ্ধান্ত অনুসারে প্রতিটি বেসরকারি হাসপাতালেও এ ব্যবস্থা থাকার কথা। কিন্তু সরকারের সেই নির্দেশনা কেন কার্যকারিতা পায়নি, তা কারও বোধগম্য নয়।

বেসরকারি হাসপাতালের দ্বারে দ্বারে ঘুরে করোনা নয় এমন রোগীদের বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুবরণের খবর জাতীয় দৈনিকে হরহামেশা ছাপা হচ্ছে। কিন্তু কর্তৃপক্ষ যেন অতীব গুরুত্বপূর্ণ এ বিষয়টি দেখেও না দেখার ভান করছে।

মানুষের পাঁচটি মৌলিক অধিকারের একটি হল চিকিৎসাসেবা। রাষ্ট্রের দায়িত্ব তার নাগরিককে চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করা। ধরে নিলাম, ১৭ কোটি মানুষের দেশে রাষ্ট্রের পক্ষে সব মানুষের চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। তাই বলে নিজের পকেটের টাকা খরচ করেও একজন মৃত্যুপথযাত্রী রোগী চিকিৎসাসেবা নিতে পারবে না- এ কেমন কথা?

জীবন-মৃত্যু আল্লাহর হাতে। হায়াত শেষ হয়ে গেলে এক মিনিটও আমরা বাঁচব না, কাউকে বাঁচাতেও পারব না। মরতে পারি আকাশে। মরতে পারি জলে কিংবা স্থলে। কিন্তু মানুষ হিসেবে ন্যূনতম চিকিৎসাটুকু তো পাওয়ার অধিকার আছে।

যারা আজ করোনার ভয়ে করোনা আক্রান্ত নন এমন রোগীকেও হাসপাতালে ভর্তি না করে তাড়িয়ে দিচ্ছেন; তারা যে কতটুকু অমানবিক কাজ করছেন সেই উপলব্ধিটুকুও কি মারা গেছে? এই হাসপাতালগুলোর কোনো মালিক যদি আজ অসুস্থ হন, আর করোনা আক্রান্ত না হওয়া সত্ত্বেও যদি কোনো হাসপাতাল তাকে চিকিৎসা না দিয়ে তাড়িয়ে দেয়, তাহলে তার অনুভূতি কেমন হবে?

একবার অন্যের কষ্টের কথাটি উপলব্ধি করলে বোধহয় তারা চৈতন্য ফিরে পাবে। আর যারা করোনার ভয়ে নিজের আপনজনকে ঘরের রুমে বাইরে থেকে সিটকিনি লাগিয়ে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিচ্ছেন, তারা কী জবাব দেবেন? তাদের ভয় এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, তারা মনে করছেন করোনা উপসর্গের কোনো ব্যক্তিকে দূর থেকে দেখলেও করোনা উড়ে এসে শরীরে বাসা বাঁধতে পারে! সাধারণ মানুষের মন থেকে এই অমূলক ভয় দূর করার দায়িত্ব সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগের।

প্রয়োজন মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করা। নতুবা দুই মিটার সামাজিক দূরত্ব বজার রাখার স্লোগান প্রচারের কোনো অর্থ হয় না। মানুষকে বোঝাতে হবে নিজে নিরাপদ দূরত্বে থেকে করোনা আক্রান্ত আপনজনের সেবা করতে হয় কীভাবে।

আরও একটি মর্মান্তিক বিষয়। কোনো মানুষ যখন করোনার উপসর্গ নিয়ে মারা যান তখন পরিবারের কেউ তো কাছেই আসে না; উপরন্তু গোরস্থানে লাশ দাফন করতে গেলে গ্রামবাসী লাঠিসোটা নিয়ে তেড়ে আসেন। কেন? করোনা আক্রান্ত মৃত ব্যক্তি কি অন্যদের সংক্রমিত করতে পারে? নাকি গোরস্থান অপবিত্র হয়ে যাবে? ব্রিটেনে মাত্র ৪.৪ শতাংশ মুসলমানের বসবাস।

রাজধানী লন্ডনের গার্ডেন্স অব পিস মুসলিম গোরস্থানসহ বিভিন্ন গোরস্থানে তো শত শত মানুষের দাফন-কাফন চলছে। এখানে তো এমন ভয় নেই? এখানে তো লাঠিসোটা নিয়ে কেউ মারতে আসে না। তাহলে ৯০ ভাগ মুসলমানের দেশে এমন পরিস্থিতি কেন?

তাই আসুন, আমরা একটু মানবিক হই। করোনার ভয়ে পালিয়ে বেড়ালেই কি আমরা করোনা থেকে বাঁচতে পারব? আমরা আপনজনের প্রতি নিষ্ঠুর না হয়ে মানবিক হলে মহান প্রতিপালকও আমাদের ওপর মানবিক হবেন।

তাইসির মাহমুদ : সম্পাদক, সাপ্তাহিক দেশ, লন্ডন, যুক্তরাজ্য

বাংলানিউজসিএ/ঢাকা/ ২১ জুন ২০২০ /এমএম


Array