Menu

প্রকৌশলী আব্দুল্লা রফিক, ক্যালগেরি, কানাডা :: গত ২৫ শে মে, সোমবার, ২০২০, জর্জ ফ্লয়েড নামে কৃষ্ণাঙ্গ এক ব্যক্তি আমেরিকার মিনেসোটা অঙ্গরাজ্যের মিনিয়াপোলিস শহরে পুলিশের হেফাজতে মৃত্যুবরণ করে I তার বিরুদ্ধে অভিযোগ সে নিকটস্থ মুদির দোকান থেকে সিগারেট কেনার সময় ২০ ডলারের একটি জাল নোট দিয়েছে, মুদির দোকান থেকেই ৯১১ কল এর মাধ্যমে পুলিশ ডাকা হয় l চার পুলিশ অফিসার এসে গাড়িতে তোলার চেষ্টার এক পর্যায়ে ফ্লয়েড মাটিতে পরে যায়, তখন একজন অফিসার হাটু দিয়ে তার ঘাড় মাটির সাথে চেপে ধরে আর বাকি অফিসার রা ফ্লয়েড এর শরীরের অন্যান্য অংশ চেপে ধরে l ৮ মিনিট ৪৬ সেকেন্ড তার ঘাড় মাটিতে চেপে ধরা ছিলো, ফ্লয়েড বার বার তার শাসকষ্টের কথা জানান দিয়েও পুলিশ এর মন গলাতে পারেনি ! পরিণামে তাকে বিয়োগান্তক ঘটনার জন্ম দিয়ে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে হয় !

অত্যন্ত মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের এই ঘটনায় আমেরিকার সাধারণ মানুষ ঘরের বাইরে এসে প্রতিবাদ শুরু করে এবং অতি দ্রুত যা সারা দেশে ছড়িয়ে পরে l এখন আমেরিকার গন্ডি পেরিয়ে অন্য দেশ কানাডা, যুক্তরাজ্যতেও এই বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে l বেশিরভাগ জায়গায় শান্তিপূর্ণ হলেও কিছু কিছু জায়গায় সহিংস বিক্ষোভ এ রূপ নেয়, লুটপাটের ঘটনাও ঘটে, হোয়াইট হাউসের (মার্কিন প্রেসিডেন্ট এর বাসভবন ) খুব কাছাকাছি সহিংস অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাও ঘটে l সারা আমেরিকায় পুলিশ এখনো মৃদু লাঠিচার্জ, টিয়ার গ্যাস এর মধ্যে থেকে বিক্ষোভ দমনের চেষ্টা করছে l তাদের সবার দাবী – এর সুষ্ঠ বিচার, আমেরিকার পুলিশ ব্যবস্থার সংস্কার ইত্যাদি l প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প কঠোর হস্তে এই আন্দোলন দমন করতে চাইলেও তার প্রশাসন নমনীয় পর্যায়েই থাকতে চায় l বিক্ষোভ দমনে প্রেসিডেন্ট সেনাবাহিনী রাস্তায় নামাতে চাইলেও প্রতিরক্ষামন্ত্রী তার সাথে দ্বিমত পোষণ করেছে l

স্থানীয় মেডিকেল এক্সামিনার এবং জর্জ ফ্লয়েড এর পরিবারের দ্বারা নিরপেক্ষ একজন ডাক্তার দুটি ময়না তদন্ত রিপোর্ট তৈরী করে l মেডিকেল এক্সামিনারের রিপোর্ট এ ফ্লয়েড হার্ট এ কিছু সমস্যা থাকার কারণে এবং পুলিশ এর অ্যাকশন এ তার হার্ট এটাক এ মৃত্যু হয় l আবার নিরপেক্ষ ডাক্তারের ময়না তদন্তে রিপোর্ট এ বলা হয় ফ্লয়েড এর ঘাড় এবং শরীরের অন্যান্য অংশ মাটির সাথে চেপে ধরার কারণে তার মস্তিষ্কে রক্ত চলাচল বন্ধ হওয়ায় সে মৃত্যুর কোলে ঢলিয়ে পরে l দুটি রিপোর্ট এ মৃত্যুর কারণ নিয়ে কিছুটা ভিন্নতা থাকলেও উভয় রিপোর্ট ই ফ্লয়েড এর মৃত্যুকে হত্যাকান্ড বলে উল্লেখ করেছে l

জর্জ ফ্লয়েড এর হত্যাকাণ্ডের একদিন পর পুলিশ ডিপার্টমেন্ট হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকা ওই চার জন পুলিশ অফিসার কে বরখাস্ত করেছে l তারও তিন দিনের মাথায় শুক্রবার এ মিনিয়াপোলিস শহরের হেনিপিন কাউন্টি এটর্নী বা সরকারি উকিল ‘মাইক ফ্রিম্যান’ পুলিশ অফিসার ‘ডেরেক সুভান’, ‘যে হাটু দ্বারা ফ্লয়েড এর ঘাড় মাটিতে চেপে রেখে ছিল’ থার্ড ডিগ্রী মার্ডার এর চার্জশিট দেয় l বোঝার জন্য একটু ব্যাখ্যার প্রয়োজন -১) ফার্স্ট ডিগ্রী (1st degree) মার্ডার বলা হয় যখন পূর্বপরিকল্পিত ঠান্ডা মাথায় হত্যাকান্ড হয়, যেখানে সর্বচ্চো শাস্তি হয় -২) সেকেন্ড ডিগ্রী (2nd degree) মার্ডার বলা হয় যখন পুরপরিকল্পিত নয় ঘটনার আকর্ষিকতায় ইচ্ছাকৃতভাবে হত্যাকান্ড, মাঝারি ধরণের শাস্তি — ৩) আর থার্ড ডিগ্রী (3rd degree) মার্ডার হচ্ছে কোনো পূর্বপরিকল্পনা ছিল না আবার ঘটনার আকর্ষিকতায় ইচ্ছকৃত হত্যাকান্ড নয়, এই ক্ষেত্রে শাস্তিও অনুমান যোগ্য l

আজ ৩রা জুন আমার এই লেখা চলাকালীন সময় খবর পেলাম ফ্লয়েড হত্যাকান্ডে পুলিশ অফিসার ডেরেক সুভান এর অপরাধ থার্ড ডিগ্রী (3rd degree ) থেকে সেকেন্ড (2nd degree) ডিগ্রী তে উন্নীত করছে এবং অন্য তিন পুলিশ অফিসার থমাস লেন, আলেক্সান্ডার লিউইঙ, এবং টাও থাও কে হত্যাকান্ডে উৎসাহ এবং সহযোগিতা করার অপরাধে চার্জশীট এ অন্তর্ভুক্ত করেছে l

আমেরিকার ইতিহাসে শেতাঙ্গ পুলিশ অফিসার এর হেফাজতে কৃষ্ণাঙ্গ মানুষ হত্যা আজকে নতুন নয় এবং দৃস্টান্ত মূলক শাস্তিও যে হয়েছে তারও উদাহরণ কম ! ২০১৪ সালে টামির রাইস নাম এ এক ১২ বছরের বালক পার্কে খেলনা পিস্তল নিয়ে খেলছিল এক শেতাঙ্গ পুলিশ অফিসার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় অরিজিনাল পিস্তল মনে করে ওই কিশোর কে গুলি করে এক দিন পর মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে না ফেরার l আবার মাইকেল ফারগুনসন নামে আরেক টিন এইজ বালক খুন হয় পুলিশের হাতে. বিক্ষোভ হয়েছে, আন্তর্জাতিক ভাবেও অনেক নিন্দা জ্ঞাপন হয়েছে, অনেক আলোচনা, সমালোচনা হয়েছে, টাস্ক ফোর্স হয়েছে, কিন্তূ আমেরিকান পুলিশ বাহিনীর নির্মমতা কোনো অংশেই যেন কমছে না l

অবিশ্বাস্য হলেও সত্য – এক জরিপে উঠে এসেছে আমেরিকাতে গত দশ বছরে গড়ে প্রতি বছর পুলিশ হেফাজতে মৃত্যুবরণ করেছে প্রায় ১১০০ জন মানুষ l শুধু ২০১৫ সালে পুলিশ হেফাজতে মোট মৃত্যুর সংখ্যা ১১৩৪, আমেরিকার মোট জনসংখ্যার মাত্র ২ শতাংশ আফ্রিকান আমেরিকান ১৫-৩৪ বয়সের কৃষ্ণাঙ্গ তরুণদের পুলিশ হেফাজতে মৃত্যের সংখ্যা মোট মৃত্যের ১৫ শতাংশ l শুধু ওই বছরে শেতাঙ্গ তরুণ এর চেয়ে কৃষ্ণাঙ্গ তরুণ এর মৃত্যু প্রায় পাঁচ গুন l পুলিশ এর ভয়ানক বলপ্রয়োগে খুন করা অনেকটা নিয়মে পরিণত হয়েছে l

ফারগুনসন হত্যাকান্ডের পর পুলিশি নির্যাতন, পুলিশের বলপ্রয়োগের বন্ধের জন্য যে আন্দোলন গড়ে উঠেছিলো তাতে আপাতঃ দৃষ্টিতে মনে হয়েছিলো হয়তো কমে এসেছে, অনেক অঙ্গরাজ্য তাদের আইন পরিবর্তন করেছিল কিন্তূ ছয় বছর পর আবার জানান দিচ্ছে – এখনো অনেক বাঁকী? কৃষ্ণাঙ্গ অধিকার আন্দোলনের নেতাদের মতে – গত ছয় বছরে কিছু ক্ষেত্রে কিছুটা উন্নতি হয়েছে যেমন জনসচেনতা অনেক বেড়েছে l আবার ফ্লয়েড এর মৃত্যুতে যে আন্দোলন গড়ে উঠেছে তাতে শ্বেতাঙ্গ মানুষের সম্পৃক্ততা অনেক বেড়েছে l

জর্জ ফ্লয়েড এর মৃত্যুতে সারা আমেরিকা জুড়ে যে আন্দোলন গড়ে উঠেছে, দল মত নির্বিশেষে সবাই অংশ গ্রহণ করছে l এখন সময় এসে গেছে চিন্তা করার কিভাবে পুলিশ অনেক বেশি মানবিক আচরণ করবে? পুলিশ এর গুলি চালানোর অধিকার এর উপর নিয়ন্ত্রণ করতে নতুন আইন করতে হবে l সারা পুলিশ বাহিনীর জন্য মানবাধিকার রক্ষার নিয়মিত ট্রেনিং এর ব্যবস্থা করতে হবে l

সারা পৃথিবী থেকে সাদা, কালো, ব্রাউন বিভিন্ন কালার এর মানুষ ইমিগ্র্যান্ট হয়ে এসে আমেরিকার উন্নয়নে অংশগ্রহণ করছে l বিভিন্ন জাতি, ধর্ম, বর্ণ ভেদে মানুষের আচার, আচরণ এ অনেক ভিন্নতা থাকে এসব বিষয় বোধগম্য করার জন্য পুলিশের ট্রেনিং জরুরি l জনসচেনতার জন্য ঘন ঘন আলোচনা সভা, সেমিনার করতে হবে l পুলিশ বাহিনী এবং জনগণের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়তে হবেl সহজ কথায় আমেরিকান পুলিশ বাহিনীকে জনবান্ধব করার জন্য যা যা দরকার তা করতে হবে l আর এর জন্য রাজনীতিবিদদের সমন্বিত উদ্যোগ খুব ই জরুরী l

পুলিশ হেফাজতে মৃত্যু পৃথিবীর কোনো দেশে কখনোই কাম্য নয় l আমেরিকায় প্রতি বছর গড়ে পুলিশি হেফাজতে মৃত্যুর সংখ্যা ১১০০ থেকে পর্যাপ্ত পরিমানে কমিয়ে আনতে যা যা করার দরকার সবকিছু করতে হবে l দল মত ধর্ম বর্ণ সবার সমান অধিকার নিশ্চিৎ করতে হবে l আর তাহলেই আমরা বলতে পারবো আব্রাহাম লিংকন এর ভাষায়, ”government of the people,by the people, for the people”

বাংলানিউজসিএ/ঢাকা/ ০৪ জুন ২০২০/এমএম


Array