বাংলানিউজসিএ ডেস্ক :: প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসে ইতিমধ্যে মৃত্যের সংখ্যা বৈশ্বিকভাবে ১ লাখ ছাড়িয়েছে। বাংলাদেশেও এ প্রাণঘাতী ভাইরাস দ্রুত সংক্রমিত হচ্ছে। আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে।এ ভয়াবহ ও নির্মম দুর্যোগে প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল ভৌত অবকাঠামো, জনবল ও সরঞ্জাম নিয়ে আমাদের যে সকল চিকিৎসক, নার্স, প্যারামেডিক্স, টেকনিশিয়ান, ওয়ার্ডবয় ও সুইপারসহ অন্যান্যা স্বাস্থ্যকর্মীরা করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে নিজেদের জীবনকে বাজি রেখে আমাদের বাঁচানোর চেষ্টা করে যাচ্ছেন। তাদের প্রতি আমাদের সশ্রদ্ধ কৃতজ্ঞতা ও নির্মল ভালবাসা প্রকাশ করা উচিত।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা অনুযায়ী, প্রতিটি দেশে এক হাজার মানুষের জন্য ১ জন চিকিৎসক প্রয়োজন। ইতালিতে প্রতি ১ হাজার মানুষের জন্য প্রায় ৬ জন করে চিকিৎসক রয়েছেন। বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ স্বাস্থ্য ব্যবস্থা হল ইতালির। সে ইতালি আজ করোনাভাইরাস মোকাবেলা করতে গিয়ে ব্যাপক হিমশিম খাচ্ছে। এ পর্যন্ত ইতালিতে ২০ হাজারেরও বেশি মানুষ মারা গেছেন।এদিকে, বাংলাদেশে ২৫০০ মানুষের জন্য মাত্র একজন চিকিৎসক রয়েছেন। এরপর শহরের তুলনায গ্রামের চিত্র আরও করুণ।
শহর ও নগরে চিকিৎসক ও রোগীর অনুপাত কিছুটা সহনীয় পর্যায়ে থাকলেও মফস্বল ও গ্রামে রোগী ও চিকিৎসকের অনুপাত প্রয়াজনের তুলনায় রীতিমত ভয়াবহ।বাংলাদেশের ৭০ শতাংশ মানুষ এখনো গ্রামে বসবাস করে। গ্রামের মানুষের স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তির সবচেয়ে বড় জায়গা হল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স।পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, বাংলাদেশের অধিকাংশ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে প্রয়োজনীয় জনবল, ভৌত অবকাঠামো ও সরঞ্জাম নেই। অনেক উপজেলায় ৫ লাখ মানুষের জন্য সরকারিভাবে ৫জন চিকিৎসকও নেই!
এ সীমাবদ্ধতার মধ্য দিয়েই আমাদের চিকিৎসকদের চিকিৎসা সেবা দিতে হয়। ফলে স্বাভাবিকভাবেই অনেক সময় তারা যথোপযুক্ত চিকিৎসা সেবা দিতে সক্ষম হন না। এ ধরণের বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার কারণে উপযুক্ত চিকিৎসা না পেলে আমরা কেবল চিকিৎসকদের ওপর হামলে পড়ি।
কসাই ইত্যাদি বলে তাদের গালিগালাজ করি। কিন্তু সমস্যার গভীরে যেতে চাই না।
আমরা বুঝতে চাই না যে, স্বাস্থ্যখাতের এ দুর্বলতার জন্য কেবল চিকিৎসকরা এককভাবে দায়ী নয়। বরং রাষ্ট্রযন্ত্রের পুরো সিস্টেম এখানে দায়ী। সে সিস্টেমকে আমরা চ্যালেঞ্জ করার সাহস করি না। কেবল পারি নিরীহ চিকিৎসকদের ওপর হামলে পড়তে। অকথ্য ভাষায় তাদের গালিগালাজ করতে। অনেক সময় চরম সীমা লংঘন করে চিকিৎসকদের শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করতেও আমাদের বিবেকে বাধে না।
এত সীমাবদ্ধতা, অপ্রতুলতা, অপমান ও লাঞ্ছনা সহ্য করেও আমাদের চিকিৎসকরা যে আমাদের চিকিৎসা সেবা দিয়ে যাচ্ছেন।
হ্যাঁ, এটি অস্বীকার করার সুযোগ নেই, কিছু চিকিৎসক কর্তব্যে অবহেলা করেন। রূঢ় আচরণ করেন। স্বাস্থ্যখাতের দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেন ও নিজেরা বিবেকবর্জিত দুর্নীতি ও অন্যায়ের সঙ্গে যুক্ত হন। কিন্তু গুটিকয়েক অসাধু চিকিৎসকদের জন্য পুরো চিকিৎসক কমিউনিটিকে হেয়, অশ্রদ্ধা ও গালিগালাজ করা কোনোভাবেই বাঞ্ছনীয় হতে পারে না।
আমাদের মত তৃতীয় বিশ্বের দেশে কোনো পেশার শতভাগ লোকই সৎ ও দায়িত্বে আন্তরিক নয়। এ তিক্ত বাস্তবতা স্বীকার করতেই হবে। এর মধ্যেও যারা সঠিকভাবে দায়িত্ব পালনের চেষ্টা করছেন, তাদেরকে অবশ্যই ইতিবাচকভাবে উৎসাহ দিতে হবে, প্রশংসা করতে হবে ও পুরস্কৃত করতে হবে।
আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধে পৃথিবীর পরাশক্তিগুলো খেই হারিয়ে ফেলেছে। করোনার বিরুদ্ধে কোনো পারমাণবিক বোমা, হাইড্রোজেন বোমা ও মিসাইল কাজ করছে না, কাজ করছে কেবল চিকিৎসকদের আন্তরিকতা, ভালোবাসা ও মানুষের প্রতি তাদের মমত্ববোধ। আমরা যখন বাসায় বসে গান শুনছি, মুভি দেখছি, বই পড়ছি, ইবাদত করছি, প্রার্থনা করছি, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন
চ্যালেঞ্জ খেলছি, ঠিক সেই মুহূর্তেই আমাদের চিকিৎসক ও অন্যান্যা স্বাস্থকর্মীরা জীবনের সর্বোচ্চ ঝুঁকি নিয়ে আমাকে, আপনাকে অথবা আমাদের বাবা, মা, ভাই, বোন, স্বামী, স্ত্রী ও অন্যান্য পরিজনকে বাঁচানোর জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
ইতোমধ্যে বিশ্বব্যাপী প্রায় ১ হাজার স্বাস্থ্যকর্মী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে আছেন। কেবল ইতালিতেই শতাধিক চিকিৎসক ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীরা করোনাভাইরাস আক্রান্ত মানুষের সেবা দিতে গিয়ে জীবন দিয়েছেন।
বাংলাদেশেও এ পর্যন্ত ৬২১ জন করোনাভাইরাস আক্রান্তদের মধ্যে একজন সিভিল সার্জনসহ ২৯ জন স্বাস্থ্যকর্মী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু ঝুঁকিতে রয়েছেন।
দুই.
চিকিৎসাসেবা একটি দলগত বিষয়। যেখানে একজন চিকিৎসক হবেন দলনেতা আর সে দলের সদস্য হবেন নার্স, প্যারামেডিক্স, টেকনিশিয়ান থেকে শুরু করে ওয়ার্ডবয়, সুইপার পর্যন্ত সবাই। রোগীর সুচিকিৎসার স্বার্থে সেবা প্রদানকারী এই দলের মধ্যে চমৎকার সমন্বয় গড়ে ওঠা জরুরি।
চিকিৎসকদের যেমন সম্মান করা উচিত, তেমনি অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রতিও আমাদের শ্রদ্ধা থাকা বাঞ্ছনীয়। কিন্তু, অনেক ক্ষেত্রেই আমরা চিকিৎসকদের কিছুটা সম্মান করলেও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীদের অবহেলা ও তাচ্ছিল্য প্রদর্শন করি। যেটি খুবই অনাকাঙ্ক্ষিত ও দুঃখজনক।
তিন.
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, একজন চিকিৎসকের অনুপাতে তিনজন নার্স থাকা আবশ্যক। বাংলাদেশে সেটি নেই। বাংলাদেশে এই অনুপাত হচ্ছে ১:০.৫৬। অর্থাৎ প্রতি ২ জন চিকিৎসক অনুপাতে ১ জন নার্স রয়েছেন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানদ- বিবেচনায় নিয়া স্বাস্থ্য অধিদফতর ইতিমধ্যেই স্বীকার করেছে যে, দেশের স্বাস্থ্যখাতের উন্নয়নের জন্য আরও অন্তত ২ লাখ নার্স ও ১ লক্ষ চিকিৎসক প্রয়োজন। প্রয়োজনের তুলনায় যেখানে আমাদের চিকিৎসক, নার্স ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীর সংখ্যা খুবই অপ্রতুল। এখন আমাদের আকাশচুম্বি সেবা প্রত্যাশাও করা ঠিক নয়।
বিশাল জনগোষ্ঠীর তুলনায় মুষ্ঠিমেয় কিছু চিকিৎসক রাতদিন মানুষকে সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। করোনার এ দুর্যোগকালে নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আমাদের বাঁচানোর চেষ্টা করে যাচ্ছেন।আমাদের উচিত চিকিৎসকদের মানসিকভাবে উৎসাহ দেয়া, তাদের সহযোগিতা করা, করোনা উত্তরকালে তাদের পুরস্কৃত করা ও আমাদের ভঙ্গুর স্বাস্থ্যখাতকে পুননির্মাণ করা।
বাংলানিউজসিএ/ঢাকা/ ১৪ এপ্রিল ২০২০/এমএম





