Menu

বাংলানিউজসিএ ডেস্ক :: বৈশাখ এবার বাংলাদেশে আসবে না। হয়তো পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরায়ও নয়। কেউ ধান-দূর্বা দিয়ে বরণ করবে না বাঙালির চিরপ্রিয় বৈশাখকে। রবীন্দ্রনাথের সেই সর্বপ্রিয় গানটি ‘এসো হে বৈশাখ এসো এসো’ গানটি কি এবারের পহেলা বৈশাখে শোনা যাবে? নাকি এবার শোনা যাবে এসো না এসো না তুমি, হে বৈশাখ বা এই ধরনের গান? না, এসব কিছুই হবে না। বাংলাদেশে এবার বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর উৎসবের মতো ফেসবুক লাইভে দেখানো হবে নববর্ষের অনুষ্ঠানটি। টেলিভিশনেও দেখা যাবে।

ঘোষণাটি শুনে একটু উৎকণ্ঠিত হয়েছিলাম। আমাদের হাতে পড়ে বঙ্গবন্ধুর অনুষ্ঠানের মতো নতুন বছরের অনুষ্ঠানও ব্যাকলাশ করবে না তো? সেই উদ্বেগ অনেকটা দূর হল পর্দায় আমার প্রিয় রবীন্দ্রসঙ্গীতশিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যার ছবি ভেসে ওঠা এবং তার কাছ থেকে আশ্বাস পাওয়ার মতো কথা শোনায়। হাতে গ্লাভস, মুখে মাস্ক (গলায় ঝুলে পড়েছে) বন্যা যখন বললেন, সরকার এবার দেশের সব মহৎ ও গুণী শিল্পীদের নিয়ে বৈশাখ আবাহনীর ব্যবস্থা করে তা টেলিভিশন ও ফেসবুক লাইভে দেখানোর ব্যবস্থা করবে, তখন কিছুটা আশ্বস্ত হয়েছি।

তারপর যখন পর্দায় দেখেছি আমাদের চিরতরুণ বুদ্ধিজীবী আবদুল্লাহ আবু সাইয়ীদ ও অনেক সমমনা বুদ্ধিজীবী এই অনুষ্ঠান প্রযোজনায় থাকবেন, তখন আরও খুশি হয়েছি। কোভিড-১৯-এর আক্রমণে আমরা সবাই এখন গৃহবন্দি। বৈশাখের অনুষ্ঠানটিও থাকবে গৃহবন্দি; কিন্তু এর আবেদনটি যেন সর্বমুখী হয়। দর্শকদের মন থেকে করোনার আতঙ্কের বদলে যদি মুহূর্তের জন্যও বাঁচার আনন্দ সৃষ্টি করা যায়, সেটাই হবে এই অনুষ্ঠানের সাফল্য।

অপেক্ষা করছি বিদেশে বসে স্বদেশের এই অনুষ্ঠানটি দেখার জন্য। আশা করছি এই অনুষ্ঠানে আউল-বাউলদের গান শুনব। লোকজ নৃত্যের অনুষ্ঠান দেখব। রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা, অদিতি মহসিন প্রমুখের কণ্ঠের রবীন্দ্রসঙ্গীত দ্বারা বর্ষবরণ দেখব। কোনো আমলার কবিতার বদলে শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, সিকান্দার আবু জাফর, আহসান হাবীবের মতো কবির কবিতার আবৃত্তি শুনব। খুব খুশি হব রবীন্দ্রনাথের কোনো ছোট নাটিকার মঞ্চায়ন যদি এই অনুষ্ঠানে যুক্ত হয় এবং তাতে ফেরদৌস, রিয়াজ এবং পূর্ণিমা, মৌসুমীর মতো এ যুগের অভিনয়শিল্পীদের অভিনয় দেখতে পাই।

শুনেছি, একবার কোনো এক নাটকে নিজের গান (যদি আপনার মনে মাধুরী মিশায়ে) কাননদেবীর কণ্ঠে শোনার জন্য রবীন্দ্রনাথ কলকাতার এক রঙ্গালয়ে এসেছিলেন নিজের দাড়ি-গোঁফ রুমালে ঢেকে। আরেকটি ঘটনা, বহু আগে শান্তিনিকেতনের পৌষ মেলায় কবিতার অনুষ্ঠানে নিজের কবিতা পাঠ করতে এসেছিলেন কবি মঙ্গলাচরণ ভট্টাচার্য। সেই কবিতা আধুনিক হলেও ছিল আড়ষ্ট। জীবনানন্দ দাশ ছিলেন সেই কবিতার মেলায় শ্রেতাদের একজন। কবি মঙ্গলাচরণ যখন তার কবিতা পাঠ করছিলেন, তখন জীবনানন্দ অস্ফুট কণ্ঠে বলেছেন, ‘এগুলো কি কবিতা?’ বাংলাদেশে বর্ষবরণ উৎসবে এই ধরনের কবিদের কবিতা আবৃত্তি যেন শুনতে না হয়, এটা অনুষ্ঠানের ব্যবস্থাপকদের কাছে আমার বিনীত নিবেদন।

পহেলা বৈশাখের আর দেরি নেই। কিন্তু এই বৈশাখ ও জ্যৈষ্ঠে করোনার প্রকোপ আরও বাড়বে বলে বিশেষজ্ঞরা সতর্কবার্তা উচ্চারণ করেছেন। এই ঘোষণা যেন মানুষের মনে আতঙ্ক সৃষ্টি না করে, নতুন বছরকে আনন্দচিত্তে সবাই যাতে বরণ করতে পারে, সেজন্য মানুষের মনকে প্রস্তুত করতে পারে হালকা আনন্দ নয়, প্রস্তুত করতে পারে চিত্তের তন্ময়তা। আমাদের কুশলী শিল্পী ও গায়করা যদি এই সংকটের দিনে বাঙালির হৃদয়ে তাদের অনুষ্ঠান দিয়ে এই তন্ময়তা সৃষ্টি করতে পারেন, তাহলে সেটাই হবে এবারের সেরা বর্ষবরণ।

লন্ডনে আমি একবার এই সমাহিত তন্ময়তা বা আনন্দ-বেদনার প্রকাশ প্রত্যক্ষ করেছি। বহু বছর আগের কথা। ‘ডেইলি মেইল’ পত্রিকায় একটা খবর দেখলাম- ছবিসহ প্রেমিক যুগলের মৃত্যুর খবর। প্রেমিক তরুণের বয়স পঁচিশ এবং প্রেমিকা তরুণীর বয়স তেইশ। আর সাতদিন পর তাদের বিয়ের তারিখ ঠিক করা হয়েছে। বিয়ের আগে একটা ‘জয় রাইডে’ গিয়ে তারা দ্রুতগতিতে গাড়ি চালাচ্ছিল। ফলে রোড অ্যাকসিডেন্টে তাদের দু’জনেরই মৃত্যু হয়।

দুই পরিবারই শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়ে। কিন্তু নির্ধারিত দিনে নির্দিষ্ট চার্চে তাদের বিয়ে দেয়ার জন্য দুই পরিবারই সিদ্ধান্ত নেয়। খবরটি পড়ে দেখলাম এই বিয়ের আর দু’দিন আছে। আর গ্রামটিও লন্ডন থেকে শ’খানেক মাইল দূরে। তখন আমি সুস্থ স্বাস্থ্যবান মানুষ। ঠিক করলাম বিয়ের দিন ওই গ্রামে যাব। দু’দিন পর গ্রামটিতে গিয়ে উপস্থিত হলাম। ছোট গ্রাম। চার্চের সন্ধান পেতে দেরি হল না। নিজের বাহুতে একটা কালো ফিতে বেঁধে অনুষ্ঠানে গিয়ে হাজির হলাম।

দুই পরিবারের লোকেরাই আমার আগমনের কারণ জানতে পেরে বাহু থেকে কালো ব্যাজটি খুলে রাখার অনুরোধ জানালেন। বললেন, বিয়ের অনুষ্ঠান হয়ে যাওয়ার পর দম্পতিকে কবরস্থ করার সময় আমি কালো ব্যাজ পরতে পারি। আমি তাদের অনুরোধ রাখলাম আর দেখলাম, আমার সামনে পাশাপাশি দক্ষিণে শোয়া ফুলের মতো শুভ্র পবিত্র দুটি মুখ। দেহে বিয়ের পোশাক পরানো।

কারও চোখে জল নেই। চার্চের পুরোহিত বিয়ে পড়ানোর জন্য প্রস্তুত। চারদিকে আনন্দের বন্যা। নাচগানের মধ্য দিয়ে বিয়ে পড়ানো হল। নবদম্পতিকে কফিন থেকে তুলে এনে পাশাপাশি শোয়ানো হল। তরুণের হাত রাখা হল তরুণীর হাতের ওপর। চার্চ সঙ্গীত বাজল। প্রেয়ার শেষ হল। নিমিষে আনন্দ-ফুর্তি থেমে গেল। মৃত তরুণ-তরুণীকে বিয়ের পোশাকেই কবরে শোয়ানো হল। তখন দুই পরিবারেরই বাবা-মা ফুঁপিয়ে কাঁদলেন। তারপর আর আনন্দ নেই, হাসিও নেই। কেমন এক শূন্যতা, নিঃসঙ্গতা। আমার মনে তখন রবীন্দ্রনাথের গান- জীবন মরণের সীমানা পেরিয়ে…।

এবারের বাংলা বর্ষবরণ উৎসবে আতঙ্ক নয়, আনন্দও নয়। এই সমাহিত তন্ময়তা যদি বর্ষবরণের অনুষ্ঠানগুলোতে সৃষ্টি করা যায় তাহলে তা হবে আমাদের সর্বকালের সেরা বর্ষবরণ অনুষ্ঠান। আমাদের বৈশাখ মাসেরও বৈশিষ্ট্য ধ্বংস এবং সৃষ্টি। কালবোশেখির আকস্মিক ঝড়ে বৃদ্ধ গাছ ভেঙে পড়ে। জীর্ণ পাতা ঝরে যায়। পাশাপাশি নতুন গাছ জন্মায়। নতুন তাজা পাতা গজায়। নতুন ফুল-ফলের ঘ্রাণে বাতাস ভরে ওঠে। এখন আমাদের মনে এই ভরসা রাখতে হবে যে, করোনার এই ধ্বংসযজ্ঞের পর নতুন সৃষ্টির আনন্দে পৃথিবীর আকাশ-বাতাস ভরে যাবে। আমরা বুড়ো ও প্রাচীনরা তখন হয়তো থাকব না। তাতে কী, আমরা তো চিরকালের জন্য বেঁচে থাকতে পৃথিবীতে আসিনি। আজ হোক, কাল হোক পৃথিবীর মায়া ছাড়তে হবেই।

পৃথিবীর জনসমাজ অবক্ষয়ের এমন একটা অবস্থায় পৌঁছেছে যে, অনেকেই আশঙ্কা করছিলেন প্রাকৃতিক অথবা অপ্রাকৃতিক ধ্বংসযজ্ঞের মধ্য দিয়ে এই অবস্থায় শেষ হবে। সেই লাস্ট ডে’জ অব পম্পিও’র গল্পের মতো। পম্পিও’র মানুষ অবক্ষয় ও পচনের এমন তলানিতে গিয়ে পৌঁছেছিল যে, পাশেই ভিসুভিয়াসের মতো অগ্নিগিরি থেকে যে মাঝে মাঝেই ধোঁয়া বেরুচ্ছে তা তারা আমলেই নেয়নি। তারপর একদিন ভয়াবহ মৃত্যুদূতের মতো সেই মৃত গিরি অগ্নিউদ্গীরণ শুরু করে। নিমিষে সেই আগুনের পিণ্ডি আর লাভা সারা নগরীকে গ্রাস করে। পম্পিও মৃত নগরীতে পরিণত হয়।

পম্পিও নগরীর মানুষের মতোই বর্তমান বিশ্বের মানুষ, ধনতান্ত্রিক সভ্যতার অবক্ষয়ের শেষ পর্যায়ে এসে একটা বিশ্বব্যাপী ধ্বংসযজ্ঞের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে। এই ধনতান্ত্রিক বিশ্বের নেতা প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তাকে গুরুত্ব দেননি। বলেছেন, ‘এটা সামান্য ফ্লু, দু-একদিনেই চলে যাবে।’ শূন্য কুম্ভ যেমন বেশি বাজে, তেমনি ট্রাম্প সাহেবও বেশি গর্জান। এখন আমেরিকায় করোনার ছোবল এত সাংঘাতিক হয়ে উঠেছে যে, ট্রাম্প সাহেবের সব তর্জন-গর্জন থেমে গেছে। লন্ডনের ‘গার্ডিয়ান’ পত্রিকার শনিবারের সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে, ব্যর্থ নেতৃত্বের খেসারত এখন আমেরিকাকে দিতে হচ্ছে। করোনায় মৃত্যু সামাল দিতে আমেরিকা ছোট দেশগুলোর মতো হাঁসফাঁস করছে।

সেদিক থেকে তুলনামূলকভাবে করোনাকে মোকাবেলা করার ব্যাপারে হাসিনা সরকার তাদের সীমাবদ্ধ ক্ষমতা নিয়ে প্রশংসা করার মতো না হলেও আশাপ্রদ সাফল্য দেখাচ্ছে। দেশবাসীর মনোবল ঠিক রাখতে পারলে আশপাশের দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশ করোনাভাইরাসের মোকাবেলায় অনেক বেশি সাফল্য দেখাবে। এই সাফল্য দেখানো- অর্থাৎ দেশবাসীর বিপন্ন ও আতঙ্কিত মনোবল দূর করার জন্য নববর্ষের অনুষ্ঠান সরকারের সামনে একটা সুযোগ এনে দিয়েছে। চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নয়ন, হেলথ সেক্টরে কঠোর হাতে দুর্নীতি দমনের পাশাপাশি সরকার যদি দেশের মেধাবী এবং বুদ্ধিজীবীদের সঠিক মতো সম্মানের সঙ্গে কাজে লাগিয়ে বাংলা বর্ষবরণের অনুষ্ঠানটি সীমাবদ্ধ প্রচারের মধ্যেও ভালোভাবে করতে পারে এবং জনচিত্তে আতঙ্ক দূর করার সঙ্গে মনোবল ও নৈতিক শক্তি ফিরিয়ে আনতে পারে, তাহলে মানবতার বিরুদ্ধে অসম্ভব যুদ্ধ জয়ের অর্ধেকটা সম্ভব করে ফেলা যাবে। আমার পাঠক এবং কর্মীদের জন্য বাংলা নতুন বছরের আগাম প্রীতি-শুভচ্ছো রইল।

বাংলানিউজসিএ/ঢাকা/ ০৬ এপ্রিল ২০২০/এমএম


Array