Menu

গ্রামীণ অর্থনীতির রূপান্তর যেভাবে

ড. জাহাঙ্গীর আলম :: কবিতায় গ্রামকে বলা হয়েছে ‘ছায়া সুনিবিড়, শান্তির নীড়’। তবে সেই ছায়া ও শান্তি এখনও অনেক গ্রামেই নেই। ক্রমাগত বৃক্ষ নিধনে ছায়া পলায়নরত। আর্থিক অনটন ও বঞ্চনার কারণে শান্তি অনেকটা তিরোহিত। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে উদয়াস্ত মাঠে কাজ করে গ্রামের মানুষ। অনেকে গরু পালে, মাছ ধরে, ধান ভানে ও নৌকা বায়।

সবাই অক্লান্ত পরিশ্রম করে উন্নত জীবনের আশায়, সমৃদ্ধির আশায়- যে জীবন তারা দেখে শহরে, যে সমৃদ্ধি দৃশ্যমান হয় শহুরে মানুষের মধ্যে। দেশের প্রায় ৭৬ শতাংশ মানুষের বসবাস গ্রামে। শহরে বাস করে বাকি ২৪ শতাংশ।

কিন্তু জীবনের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য, আনন্দ-আয়েশ, ভোগবিলাস শহরে বেশি। কারণ শহরের মানুষের আয় বেশি। ঘর-দুয়ার, রাস্তাঘাট শহরে ভালো। খাদ্য, শিক্ষা ও চিকিৎসার মান শহরে উন্নত। শিল্পজাত পণ্যের দাম গ্রামে বেশি। তাই গ্রাম থেকে মানুষের অভিগমন হচ্ছে শহরে।

গ্রামের মানুষ শহরের মানুষের চেয়ে আয় করে কম। বছরে গড়ে শহরের মাত্র ৫৯ শতাংশ আয় হয় গ্রামের একটি পরিবারে। চিকিৎসা ও শিক্ষার জন্য পারিবারিক ব্যয়-সামর্থ্য শহরের তুলনায় গ্রামে কম। উচ্চশিক্ষিত লোকের হার গ্রামে মাত্র এক-ততৃীয়াংশ।

এ বৈষম্যের কারণে নিজেদের অবহেলিত ভাবে গ্রামের মানুষ। গ্রাম্য বা গেঁয়ো শব্দটি সচরাচর ব্যবহৃত হয় আভিজাত্যের বিপরীতে। এ প্রেক্ষাপটে এখন গ্রাম উন্নয়নের কথা ভাবা হচ্ছে। অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ করার প্রচেষ্টা নেয়া হচ্ছে গ্রামের পিছিয়ে পড়া মানুষকে।

আমাদের সংবিধানের ১৪নং অনুচ্ছেদে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব হইবে মেহনতী মানুষকে- কৃষক ও শ্রমিককে- এবং জনগণের অনগ্রসর অংশসমূহকে সকল প্রকার শোষণ হইতে মুক্তিদান করা।’

অতঃপর সংবিধানের ১৬নং অনুচ্ছেদে নগর ও গ্রামের বৈষম্য ক্রমাগতভাবে দূর করার উদ্দেশ্যে কৃষিবিপ্লবের বিকাশ, গ্রামাঞ্চলে বৈদ্যুতায়নের ব্যবস্থা, কুটির শিল্প ও অন্যান্য শিল্পের বিকাশ এবং শিক্ষা, যোগাযোগ ব্যবস্থা ও জনস্বাস্থ্যের উন্নয়নের মাধ্যমে গ্রামাঞ্চলের আমূল রূপান্তর সাধনের জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে বলে অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়েছে। রাষ্ট্রের এ প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করার জন্য গ্রহণ করা দরকার সার্বিক গ্রাম উন্নয়ন কর্মসূচি। এর জন্য প্রয়োজন গ্রামীণ অর্থনীতির রূপান্তর।

এ লক্ষ্য অর্জনের জন্য স্বাধীনতার পর থেকেই নিরন্তর কাজ চলছে- বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মসূচি গ্রহণ করা হচ্ছে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে। বিশেষ করে আওয়ামী লীগ সরকারের বিগত ১০ বছরের শাসনামলে এ কার্যক্রম অনেক বেশি বেগবান হয়েছে।

ইতিমধ্যেই গ্রামীণ রাস্তাঘাটের প্রভূত উন্নতি হয়েছে। কৃষি খাতে আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে। শিক্ষা ও চিকিৎসার সম্প্রসারণ ঘটেছে। অকৃষি খাতের বিকাশ ও আর্থিক সেবা খাতের বিস্তার ঘটেছে। ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ও কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি সম্ভব হয়েছে। তবে তা যথেষ্ট নয়।

গ্রামের মানুষের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্য আরও এগিয়ে যেতে হবে বহুদূর। সে লক্ষ্য অর্জনের জন্যই বর্তমান সরকার গ্রাম উন্নয়নকে প্রাধান্য দিচ্ছে সার্বিক উন্নয়ন পরিকল্পনায়। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ইশতেহার ঘোষণাকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, গ্রাম হবে শহর। ‘আমার গ্রাম-আমার শহর’ : প্রতি গ্রামে আধুনিক নগর সুবিধার সম্প্রসারণ- এ প্রতিপাদ্য সামনে রেখে তিনি গ্রাম উন্নয়নের পথ-নকশাও উপস্থাপন করেছেন। তারপর থেকে এ বিষয়টি আমাদের উন্নয়ন আলোচনায় বেশ গুরুত্ব পাচ্ছে।

গ্রাম উন্নয়ন বলতে গ্রামীণ অর্থনীতি, কৃষি ও কুটির শিল্প, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অবকাঠামো, সংস্কৃতি ও পরিবেশ- সবকিছুরই উন্নয়ন বোঝায়। এর আধুনিকায়ন মানে সব ক্ষেত্রে নয়া প্রযুক্তির প্রসার ও বৈজ্ঞানিক ধ্যান-ধারণার বাস্তবায়ন।

এ ক্ষেত্রে প্রতিটি গ্রামে শহরের সুযোগ-সুবিধা সম্প্রসারণের বিষয়টিও জড়িত। এ ক্ষেত্রে গ্রামবাংলার প্রকৃত রূপ অটুট রাখতে হবে। গ্রামের নদী-নালা, খাল-বিল, হাওর-বাঁওড়, পুকুর-ডোবা, গাছপালা, বনবীথি, ক্ষেতখামার আর দিগন্ত বিস্তৃত মাঠ যথাযথভাবে অক্ষুণ্ণ রেখেই প্রণয়ন করতে হবে সব উন্নয়ন পরিকল্পনা।

তাতে নাগরিক সুবিধাসংবলিত প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যময় উন্নত বাসস্থানে পরিণত হবে গ্রামের প্রতিটি বাড়ি। কৃষি ও কৃষিবহির্ভূত গ্রামীণ খাতে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাবে। গ্রামীণ অর্থনীতিতে গতিশীলতা আসবে। মানুষের আয় বাড়বে, বৈষম্য কমবে গ্রামীণ ও শহর জীবনে। গ্রামে বসবাস করতে স্বচ্ছন্দবোধ করবে নারী-পুরুষ সবাই।

গ্রামীণ অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি কৃষি। আধুনিক প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমাদের কৃষি এখন বেশ অগ্রসরমান। কিন্তু কালক্রমে কৃষি একটি কম লাভজনক পেশা হিসেবে দাঁড়িয়েছে। এর প্রধান কারণ কৃষক তার উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য দাম পাচ্ছে না।

অথচ কৃষি শ্রমিকসহ উপকরণের মূল্যবৃদ্ধির ফলে ক্রমাগত বেড়ে যাচ্ছে মোট উৎপাদন খরচ। এ সমস্যার সমাধানের জন্য একদিকে উপকরণ ভর্তুকি বাড়ানো দরকার, অন্যদিকে কৃষিপণ্যের উপযুক্ত মূল্য নিশ্চিত করা দরকার কৃষকের জন্য।

তাছাড়া উৎপাদিত ফসলের সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বিপণন ব্যবস্থাকে দক্ষ করে গড়ে তোলা দরকার। তদুপরি জলবায়ুর অভিঘাতপ্রবণ সমস্যা সংকুল কৃষির উৎপাদন ও জীব প্রযুক্তির ওপর গবেষণা জোরদার করা প্রয়োজন।

খাদ্যশস্যবহির্ভূত ফসল যেমন- শাকসবজি, ডাল, তেলবীজ, মসলা ও ফলমূলের উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে জোরদার করা দরকার গবেষণা ও সম্প্রসারণ কর্মসূচিকে। বর্তমানে আমাদের শস্য বিন্যাসের উন্নয়ন দরকার।

আর্থিক সহায়তা ও বাজেট বাড়ানো দরকার কৃষি খাতে। কৃষি ঋণের সুদ হার কমানো দরকার। ঋণের সঙ্গে সংযুক্ত করা দরকার কৃষি বীমা কর্মসূচিকে। সেই সঙ্গে কৃষির বাণিজ্যিকীকরণকে উৎসাহিত করা প্রয়োজন। কৃষিকে রফতানিমুখী করতে সহায়তা দেয়া প্রয়োজন।

শস্যবহির্ভূত কৃষি খাত যেমন- পশুপাখি, মৎস্য ও বন উপখাতে বিনিয়োগের সুযোগ অনেক বেশি। উৎপাদন বৃদ্ধির সম্ভাবনাও বিস্তর। দানাদার খাদ্যশস্যের উৎপাদনে আমরা স্বয়ম্ভরতার কাছাকাছি থাকলেও আমিষজাতীয় খাদ্য উৎপাদনে এখনও আমরা বেশ পিছিয়ে আছি। দেশের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ মানুষ এখনও অপুষ্টির শিকার।

মাছ, মাংস, ডিম, দুধ ও ফলমূলের উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে আমরা অপুষ্টিজনিত সমস্যার সমাধান করতে পারি। এ উপখাতে সহজ শর্তে ঋণ ও সরকারি প্রণোদনা আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়িয়ে দেবে। নতুন কর্মসৃজনে তা সহায়ক হবে। তদুপরি এসবের সরবরাহ বৃদ্ধির মাধ্যমে ভোক্তা পর্যায়ে মূল্য স্থিতিশীল রাখা সম্ভব হবে। ফলে আমিষজাতীয় খাদ্যের ভোগ বৃদ্ধি পাবে। এজন্য বাজারব্যবস্থা ও সংরক্ষণ সুবিধার উন্নয়ন দরকার।

আমাদের কৃষি খামারগুলো ক্রমেই ছোট আকার ধারণ করছে। উন্নত দেশগুলোতে খামারের আকার বড়। তাতে আধুনিক খামার যন্ত্রপাতির ব্যবহার সহজসাধ্য। কিন্তু এর বিপরীতে আমাদের দেশের জোতগুলো ছোট হওয়ায় যন্ত্রপাতির ব্যবহার ততটা সহজ হচ্ছে না। বড় আকারের বিনিয়োগও তেমন সম্ভব হচ্ছে না।

এক্ষেত্রে সমবায়ভিত্তিক কৃষি খামার গড়ে তোলার যথেষ্ট যৌক্তিকতা আছে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গ্রামীণ উন্নয়ন তথা কৃষির উৎপাদন ও বিপণনে সহায়তার জন্য বহুমুখী কৃষি সমবায় গড়ে তোলার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছিলেন।

স্বাধীনতার পর দেশের বিভিন্ন স্থানে গ্রামভিত্তিক কৃষি সমবায় গড়ার অনেক অভিজ্ঞতা রয়েছে। বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমিও এর ওপর একাধিক মাঠ-গবেষণা কর্মসূচি পরিচালনা করেছে। বর্তমানে সরকার পরিচালিত ‘একটি বাড়ি একটি খামার’ প্রকল্পও এক্ষেত্রে বেশ ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে।

তাতে সম্মিলিত উদ্যোগে গ্রামের বিভিন্ন স্তরের মানুষের অংশগ্রহণ ও অর্থায়ন নিশ্চিত করাসহ উৎপাদন ও আয় বাড়ানো সম্ভব হয়েছে। এর নিরিখে দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন পরিকল্পনার আওতায় গ্রামগুলোকে বিন্যস্ত করা যেতে পারে। তবে কৃষি খাতে আধুনিক প্রযুক্তি ধারণ এবং কৃষি যান্ত্রিকীকরণের লক্ষ্যে বিষয়ভিত্তিক ভর্তুকি বাড়ানো দরকার, যা সার্বজনীনভাবে প্রযোজ্য হওয়া উচিত।

সময় যত গড়িয়ে যাচ্ছে, কৃষি খাতের ওপর মানুষের নির্ভরতা ততই হ্রাস পাচ্ছে। গ্রামীণ শিল্প, ছোট ব্যবসা ও রেমিটেন্সের ওপর নির্ভরতা বাড়ছে। বর্তমানে গ্রামীণ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের সংখ্যা প্রায় ৭-৮ লাখ। এগুলোকে আধুনিক প্রযুক্তিবান্ধব করা দরকার। ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে সরকারিভাবে সমর্থন জোগানো দরকার

। গ্রামে সার্বক্ষণিক বিদ্যুৎ সরবরাহ এবং সবার জন্য বিদ্যুৎ নিশ্চিত করা দরকার। বর্তমানে বিদেশ থেকে যে রেমিটেন্স আসছে তার সিংহভাগই অর্জন করছে গ্রামের মানুষ। কিন্তু এর উৎপাদনমুখী বিনিয়োগ কম। গ্রামীণ কৃষি উৎপাদনে, ক্ষুদ্র শিল্প ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে যাতে এ অর্থ বিনিয়োগ করা যায় তার ব্যবস্থা নিতে হবে।

আবহমান কাল ধরে হস্তচালিত তাঁত, তেলের ঘানি, বাঁশ-বেত ও মাটির কাজ গ্রামের মানুষের সম্পূরক আয়ের ব্যবস্থা করছে। এগুলোকে প্রযুক্তিনির্ভর করতে হবে। আরও পুঁজিনির্ভর এবং শ্রম সৃজনকারী ক্ষুদ্র শিল্প স্থাপনে উদ্যোগ নিতে হবে গ্রামে।

তাছাড়া গ্রামে গ্যাস সংযোগ, পরিবহন ব্যবস্থা সম্প্রসারণ, বাজার ও রাস্তাঘাটের উন্নয়ন স্থানীয় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে বেগবান করতে পারে। সর্বোপরি গ্রামের নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। তাতে বিনিয়োগ উৎসাহী হবে গ্রামের মানুষ। স্থায়ী বসবাসের আগ্রহী হবে তারা।

গ্রামের মানুষের আর্থিক অন্তর্ভুক্তিকরণ গ্রামীণ উন্নয়নের একটি প্রধান শর্ত। বর্তমানে গ্রামে যে বিনিয়োগ হয় তার বড় অংশই অপ্রাতিষ্ঠানিক উৎস থেকে আসে। প্রাতিষ্ঠানিক উৎসের অবদান এক্ষেত্রে খুবই কম। অধিক সুদের মহাজনি ব্যবসা গ্রামে এখনও বড় ভূমিকা পালন করছে আর্থিক খাতে।

এ অবস্থার উন্নতিকল্পে গ্রামপর্যায়ে ব্যাংক শাখার দ্রুত সম্প্রসারণ দরকার। বিশেষ করে কৃষি ব্যাংক ও রাকাবকে পুরোপুরি নিয়োজিত রাখা দরকার কৃষি ও গ্রামীণ খাতে অর্থায়নের জন্য। তাছাড়া এজেন্ট ব্যাংকিং, মোবাইল ব্যাংকিং ও কমিউনিটি ব্যাংকিংকে উৎসাহিত করা দরকার।

তদুপরি সমবায় ব্যাংক, কর্মসংস্থান ব্যাংক, আনসার ভিডিপি ব্যাংক, ডাকঘর সঞ্চয় ব্যাংক, পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন ও পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকে নির্দিষ্ট এলাকা নির্ধারণ করে গ্রামীণ আর্থিক অন্তর্ভুক্তির জন্য কাজ করার নির্দেশনা দেয়া যেতে পারে।

গ্রামের মানুষ মহাজনের কাছে যায় ঋণের সহজলভ্যতার জন্য। এটি প্রাতিষ্ঠানিক ঋণের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হতে পারে। মনে রাখতে হবে, কৃষিতে নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টি এবং গ্রামীণ অকৃষি খাত সম্প্রসারণের জন্য আর্থিক অন্তর্ভুক্তিকরণের বিকল্প নেই।

শহরে যোগাযোগ সহজ। গ্রামে তা ধীরগতির। তথ্যপ্রযুক্তির বিকাশ গ্রামীণ যোগাযোগের ক্ষেত্রে অভাবনীয় উন্নয়ন সাধনে সক্ষম। ২০২১ সালের মধ্যে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্য অর্জন করতে হলে গ্রামগুলোকেও ডিজিটাল কর্মসূচির আওতায় আনতে হবে।

এর জন্য গ্রামের মানুষের কাছে ব্রডব্যান্ড সুবিধা পৌঁছে দিতে হবে। তাদের জন্য স্মার্টফোন সহজলভ্য করতে হবে। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ৯ কোটি মোবাইল ফোন আছে। এর মাত্র ৩০ শতাংশ স্মার্টফোন। বাকিগুলো ডিজিটাল ফর্মেটে নিয়ে আসতে হবে দ্রুত। গ্রামে তথ্যপ্রযুক্তির বিকাশ স্থানীয় জনমনে আস্থার সৃষ্টি করবে। তাদের সুন্দর ও সাবলীল জীবন গড়তে সাহায্য করবে।

গ্রামে এখন ভূমিহীনতা বাড়ছে। জনসংখ্যার চাপে জমিগুলো হচ্ছে খণ্ড-বিখণ্ড। নতুন বসতবাড়ি ও রাস্তাঘাট উন্নয়নের ফলে অনেক জমি চলে যাচ্ছে চাষের বাইরে। তাতে প্রতি বছর গড়ে প্রায় ০.৭৪ শতাংশ কৃষিজমি হ্রাস পাচ্ছে।

এ পরিস্থিতিতে চিরায়ত কৃষিজমি সংরক্ষণ করা দরকার ফসল উৎপাদনের জন্য। অপরদিকে ভূমিহীন ও ক্ষুদ্র কৃষকের জন্য আবাসস্থল গড়ে তোলা দরকার প্রতিটি গ্রামে। এ অবস্থায় পরিকল্পিত আবাসন কর্মসূচি হাতে নেয়া দরকার গ্রামের ক্রমবর্ধমান বাসিন্দাদের জন্য।

এ ক্ষেত্রে গ্রামে গ্রামে নির্মাণ করা যেতে পারে বহুতল পাকা ভবন, যেখানে বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংযোগসহ শহুরে জীবনের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা থাকবে। এর জন্য প্রতিটি গ্রামে জনগণের মতামত সাপেক্ষে আলাদা পরিকল্পনা প্রণয়ন করা যেতে পারে। সেই সঙ্গে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপ কমানোর জন্য ইতিবাচক পদক্ষেপ নিতে হবে। আরও সফল করে তুলতে হবে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি।

গ্রামীণ শিক্ষাব্যবস্থাকে মানসম্মত পর্যায়ে উন্নীত করা দরকার। গ্রামের বিদ্যালয়গুলোকে কাঠামোগতভাবে উন্নয়নের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। নিয়োগ দিতে হবে যোগ্য শিক্ষক। স্থানীয় জনগণের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণে গড়ে তুলতে হবে দক্ষ ব্যবস্থাপনা। গ্রামের মক্তবগুলোকে শিক্ষার মূলধারার সঙ্গে সংযুক্ত করতে হবে।

স্কুল, মাদ্রাসা ও অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধ সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজনীয় শিক্ষাক্রম চালু করতে হবে। একইসঙ্গে শিক্ষার্থীদের মাদক, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ থেকে দূরে থাকার শিক্ষাও দিতে হবে।

তাছাড়া সংস্কৃতির বিকাশ, খেলাধুলা ও স্কাউটিং কার্যক্রমকে উৎসাহিত করার জন্য প্রয়োজনীয় কর্মসূচি চালু করতে হবে প্রতিটি স্কুলে। তাতে পুঁথিগত শিক্ষার সঙ্গে শিক্ষার্থীদের দেহ ও মনের সুষম বিকাশ ঘটানো সম্ভব হবে।

মানবিক উন্নয়নের আরেকটি প্রধান ক্ষেত্রে হচ্ছে চিকিৎসাব্যবস্থার উন্নয়ন। এ ক্ষেত্রে আমাদের গ্রামগুলো অনেক পিছিয়ে আছে। কমিউনিটি ক্লিনিক ছাড়া গ্রামগুলোতে চিকিৎসার আর কোনো বিকল্প ব্যবস্থা নেই।

এগুলোর আধুনিকায়ন গ্রামীণ চিকিৎসাসেবার উন্নয়নে একটি মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে। তাছাড়া দক্ষ ও অভিজ্ঞ চিকিৎসকের মাধ্যমে এগুলো পরিচালনার ব্যবস্থা নিতে হবে। সপ্তাহে অন্তত দুই দিন এগুলোতে এমবিবিএস ডাক্তারের সেবা নিশ্চিত করতে হবে। অধিকন্তু গ্রামীণ রোগীদের জন্য প্রয়োজনে শহরের সরকারি হাসপাতালগুলোতে ভর্তি ও চিকিৎসাসেবা নেয়ার অগ্রাধিকার নিশ্চিত করতে হবে।

নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশ অনেকদূর এগিয়ে গেছে। তবে এখনও গ্রামের নারীর অনেকেই পারিবারিকভাবে অবহেলিত। সামাজিক অধিকার থেকে তারা বঞ্চিত। খাদ্য গ্রহণ, আর্থিক উপার্জন ও সম্পদের মালিকানা প্রতিষ্ঠায় তাদের অধিকার ক্ষুণ্ণ। এর প্রতিকার দরকার।

নারীর জন্য গ্রামীণ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে পুরুষদের পাশাপাশি অংশগ্রহণের সমান সুযোগ সৃষ্টি করা দরকার। তাদের পারিবারিক ও গৃহস্থালি কাজের আর্থিক মূল্যায়ন দরকার। নারী কৃষক ও নারী উদ্যোক্তাদের জন্য পৃথক অর্থায়ন, প্রণোদনা ও সমর্থন ইত্যাদির ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে।

তাদের আর্থিক অন্তর্ভুক্তির জন্য প্রাতিষ্ঠানিক ঋণপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার প্রতিষ্ঠার নীতিমালা প্রণয়ন করা যেতে পারে। গ্রামের উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন ও তা বাস্তবায়নে নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। তাদের স্বাস্থ্য রক্ষা ও নিরাপত্তার জন্য আলাদা কর্মসূচি গ্রহণ করা যেতে পারে।

গ্রামের প্রাকৃতিক পরিবেশ দিন দিন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বর্জ্য ও পয়ঃনিষ্কাশন বিঘ্নিত হচ্ছে। খাল-ডোবা ভরাট হচ্ছে। বৃক্ষ, জঙ্গল কেটে ফেলা হচ্ছে। নদী ও বায়ুদূষণ হচ্ছে প্রতিনিয়ত। এর অবসান দরকার।

গ্রামে উন্নয়ন পরিকল্পনায় নতুন বনায়ন সৃষ্টি, বৃক্ষরোপণ ও ফলের বাগান তৈরির ব্যবস্থা থাকতে হবে। পাহাড়, হাওর ও জলাভূমি উন্নয়নের জন্য আলাদা পরিকল্পনা নিতে হবে। গ্রামের মানুষের বিনোদনের জন্য খেলাধুলা, যাত্রাগান, পালাগান ইত্যাদির আয়োজন থাকতে হবে নিয়মিত। সংরক্ষণ করতে হবে তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি। অতীতে গ্রামের সব মানুষের মধ্যে এক ধরনের আত্মীয়তার বন্ধন ছিল। কালক্রমে তা হারিয়ে যাচ্ছে। সেই মূল্যবোধ ফিরিয়ে আনতে হবে।

বর্তমানে দেশের জিডিপি প্রায় ৮ শতাংশ হারে বাড়ছে। ২০২১ সালে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালনকালে বাংলাদেশ হবে মধ্যম আয়ের দেশ। ২০৩০ সালে উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালে উন্নত দেশ হিসেবে বাংলাদেশ বিশ্বের বুকে মাথা তুলে দাঁড়াবে।

সেই লক্ষ্যে ২০২১ থেকে ২০৪১ সাল পর্যন্ত জিডিপি প্রবৃদ্ধির গড় হার ১০ শতাংশে উন্নীত করতে হবে। দারিদ্র্য নির্মূল করতে হবে। সবার জন্য কর্মসংস্থান নিশ্চিত করতে হবে। নগরের সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি করতে হবে প্রতিটি গ্রামে।

আমাদের ৮৭,২২৩টি গ্রামকে উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে এসেই এ সাফল্য অর্জন করা সম্ভব। এজন্য সব আগ্রহ ও ঐকান্তিকতা দিয়ে আমাদের গ্রাম উন্নয়ন কর্মসূচিকে সাফল্যমণ্ডিত করতে হবে। শুধু আক্ষরিক অর্থে নয়, সত্যিকারভাবেই বাস্তবায়ন করতে হবে ‘আমার গ্রাম, আমার শহর’ স্লোগান।

ড. জাহাঙ্গীর আলম : উপাচার্য, ইউনিভার্সিটি অব গ্লোবাল ভিলেজ (ইউজিভি); সাবেক মহাপরিচালক, বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইন্সটিটিউট
সূত্র: যুগান্তর

বাংলানিউজসিএ/ঢাকা/২১ মার্চ ২০১৯/ইএন