বাংলানিউজসিএ ডেস্ক :: বাংলা নাটকের গৌড়জন নাট্যাচার্য সেলিম আল দীনের মহাপ্রয়াণ দিবস আজ। ২০০৮ সালের এই দিনে তিনি মর্ত্যলোকের মায়া ত্যাগ করে চলে যান অনন্তলোকে। রেখে যান তার অবিনশ্বর মহাকাব্যিক সব সৃষ্টিসম্ভার। তার নাটক বাংলা থিয়েটারের বহু যুগের প্রতীক্ষার অবসান ঘটায়।
১৯৪৯ সালের ১৮ আগস্ট ফেনী জেলার সোনাগাজী উপজেলার সেনের খিলে জন্মগ্রহণ করেন রবীন্দ্রোত্তরকালের বাংলা নাটকের প্রধান পুরুষ সেলিম আল দীন। তার সৃষ্টিশীলতার কিরণচ্ছটা ভারতবর্ষ ছাড়িয়ে ইউরোপ পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে এমএ ডিগ্রি নেয়ার পর কর্মক্ষেত্র হিসেবে বেছে নেন শিক্ষকতাকে।
১৯৭৪ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। এরপর থেকেই তার কর্মক্ষেত্র বিস্তৃত হতে থাকে। একদিকে সৃজসশীলতার ভুবন আলোকিত করে রাখেন নতুন নতুন ভিন্নমাত্রিক রচনা সম্ভার দিয়ে, অন্যদিকে শিল্পের একাডেমিক ও প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তির জন্য কাজ করে যান।
১৯৮১-৮২ সালে দেশব্যাপী গড়ে তোলেন বাংলাদেশ গ্রাম থিয়েটার। এর আগেই অবশ্য তার আজীবনের শিল্পসঙ্গী নাট্যনির্দেশক নাসির উদ্দিন ইউসুফের সঙ্গে যুক্ত হয়ে ঢাকা থিয়েটার প্রতিষ্ঠা করেন।১৯৮৬ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে তার উদ্যোগেই খোলা হয় নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগ। প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করে এ বিভাগকে তিনি অধিষ্ঠিত করেন মর্যাদার আসনে।
তার প্রথম রেডিও নাটক ‘বিপরীত তমসায়’ ১৯৬৯ সালে এবং প্রথম টেলিভিশন নাটক আতিকুল হক চৌধুরীর প্রযোজনায় ‘লিব্রিয়াম’ প্রচারিত হয় ১৯৭০ সালে। ‘বহুবচন’ কর্তৃক প্রযোজিত হয় তার প্রথম মঞ্চনাটক ‘সর্পবিষয়ক গল্প’ ১৯৭২ সালে। এরপর থেকে একের পর এক নতুন নতুন বিষয় ও আঙ্গিকে সৃষ্ট তার নাটক প্রদর্শিত হয় মঞ্চে ও টেলিভিশনে।
শুরু করেছিলেন বিদেশ অনুপ্রাণিত নিরীক্ষাকে ভর করে; কিন্তু খুব শিগগির তা বর্জন করে বাংলার মধ্যযুগীয় নাট্যরীতির সম্ভারে গড়ে তোলেন নিজর জগৎ। ভাঙা মানুষ, তারুণ্যের বিলীয়মান উপজাতি, লাঞ্ছিত নারী- মূলত নিচুতলার মানুষেরই ভিড় তার নাটকে।এক নবতর শিল্পরীতি প্রবর্তন করেন তিনি। নাম দেন ‘দ্বৈতাদ্বৈতরীতি শিল্পতত্ত্ব’। বর্ণনাত্মক নাট্যরীতিতে লেখা তার নাটকগুলোতে নিচুতলার মানুষের সামাজিক নৃতাত্ত্বিক পটে তাদের বহুস্তরিক বাস্তবতাই উঠে আসে।
মধ্যযুগের বাংলা নাট্যরীতি নিয়ে গবেষণা করে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। বাংলাদেশের একমাত্র বাংলা নাট্যকোষেরও তিনি প্রণেতা। আদিবাসী জনগোষ্ঠীর জীবনাচরণকেন্দ্রিক এথনিক থিযেটারেরও তিনি উদ্ভাবক। তার নাটক ‘চাকা’র চলচ্চিত্ররূপ আন্তর্জাতিকভাবে একাধিক পুরস্কার পেয়েছে।
তার রচিত কথানাট্য ‘হরগজ’ সুইডিশ ভাষায় অনুদিত এবং ভারতের নাট্যদল রঙ্গকর্মী কর্র্তৃক হিন্দি ভাষায় মঞ্চস্থ হয়েছে। সেলিম আল দীনের নাটক ভারতের যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয় এবং বাংলাদেশের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্য।
অসংখ্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন তিনি। ১৯৮৪ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, ১৯৯৬ সালে পান জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। ২০০৭ সালে একুশে পদকে ভূষিত করা হয় তাকে।বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভের উপদেষ্টা ছিলেন তিনি। বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ডের সদস্যও ছিলেন। বর্ণময় কর্মজীবনে তিনি দেশে-বিদেশে বহুবার সংবর্ধিত হয়েছেন। আমরা এই মহান শিল্প স ষ্টাকে আজকের দিনে গভীর শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি।
বাংলানিউজসিএ/ঢাকা/ ১৪ জানুয়ারি ২০২০ /এমএম