Menu

বাংলানিউজসিএ ডেস্ক :: আজ যখন আমরা ইরানের দ্বিতীয় শক্তিধর ব্যক্তি এবং সেনাধ্যক্ষ মেজর জেনারেল কাসেম সোলেমানির ট্র্যাজিক হত্যাকাণ্ড এবং এর আন্তর্জাতিক তাৎপর্য ও এর পরিণতি নিয়ে আলোচনা করতে যাচ্ছি তখন স্বাভাবিকভাবেই প্রথম মহাযুদ্ধের ঘটনাবলী স্মৃতিপটে ভেসে ওঠে, কারণ সেই যুদ্ধও শুরু হয়েছিল একটি হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হওয়ার পর।

প্রথম মহাযুদ্ধের দুর্ভাগ্যজনক যাত্রা শুরু হয়েছিল ২৮ জুন, ১৯১৪ সালে। সেদিন বসনিয়ার সারায়েভোতে আর্ক-ডিউক ফ্রান্য ফার্ডিনান্ড মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। ফ্রান্য ফার্ডিনান্ড ছিলেন অস্ট্রো-হাঙ্গেরি সাম্রাজ্যের সিংহাসনের উত্তরাধিকারী। ফার্ডিনান্ডের সঙ্গে তার স্ত্রীও নিহত হন।

এ সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ডের পরিকল্পনা করা হয়েছিল বেলগ্রেডে। হত্যার পরিকল্পনা সম্পর্কে সার্বিয়ার কর্মকর্তারা অবগত ছিলেন। এ ব্যাপারে সুনিশ্চিত হয়ে হ্যাবসবার্গের সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীরা ভিয়েনায় বসে সিদ্ধান্ত নিলেন যে, সার্বদের সামরিক পরাজয়ের মাধ্যমেই বহুজাতিক রাষ্ট্রটির বিরুদ্ধে দক্ষিণ স্লাভদের অভিযোগ নস্যাৎ করা সম্ভব।

বড় রকমের কোনো যুদ্ধ হলে হ্যাবসবার্গ নেতৃত্ব জার্মানির সামরিক সহায়তা পাবে বলে জুলাই মাসের প্রথম দিকে আশ্বাস পেল। বার্লিন আশা করেছিল ১৮৭৯ সাল থেকে দীর্ঘদিনের এ অনুগত মিত্রের পক্ষে অবস্থান রুশ হস্তক্ষেপকে নিরস্ত্র করবে।

অস্ট্রিয়া ২৩ জুলাই ১৯১৪ বেলগ্রেডের কাছে একটি চরমপত্র হস্তান্তর করল। অস্ট্রিয়া জানত বেলগ্রেড এই চরমপত্র প্রত্যাখ্যান করবে। ২৫ জুলাই অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি সার্বিয়ার সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করল। এর ৩ দিন পর ভিয়েনা যুদ্ধ ঘোষণা করে। হ্যাবসবার্গ বিশ্বাস করত তারা তৃতীয় বলকান যুদ্ধের সূচনা করেছে।

রুশরা এমন পদক্ষেপ নিল যাতে করে যুদ্ধটি আঞ্চলিক পর্যায়ে সীমিত না থাকে। শুরু থেকে সেন্ট পিটার্সবার্গ তার সার্বিয়ান অধস্তন মিত্রদের সুরক্ষা দিতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হল। এবং বলকান অঞ্চলকে কেন্দ্র করে রাশিয়ার নিজেরও উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিল।

অবাক হওয়ার বিষয় নয় যে, জুলাই সংকটের দিনগুলোয় রাশিয়ার দৃঢ়চিত্ততা ভিয়েনার প্রতিশোধ গ্রহণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গেল এবং জার্মানরা তার মিত্রকে সমর্থন করার প্রতিশ্রুতি দিল। ৩০ জুলাই রাশিয়া যুদ্ধের সার্বিক প্রস্তুতির নির্দেশ প্রদান করল।ওই সময় একটি বৃহৎ শক্তির পক্ষ থেকে এটাই ছিল প্রথম পদক্ষেপ। এর প্রতিক্রিয়ার জার্মানি বিপরীত পদক্ষেপ গ্রহণ করল। এর ফলে মধ্যস্থতা করার বিলম্বিত ব্রিটিশ পদক্ষেপ বাধাগ্রস্ত হল।

বার্লিনও সার্বিক যুদ্ধ প্রস্তুতির নির্দেশ প্রদান করল এবং কয়েক দিনের মধ্যে ফ্রান্সের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করল। জার্মানি ইচ্ছাপূর্বকভাবে বেলজিয়ামের নিরপেক্ষতা অমান্য করার ফলে ব্রিটিশ মন্ত্রিসভা জার্মানির বিরুদ্ধে ফ্রান্সকে সমর্থন করার বিষয়ে সম্মত হল। ৫ আগস্ট, ১৯১৪ প্রথম মহাযুদ্ধ শুরু হয়ে গেল, যদিও বড় আকারের লড়াই শুরু হতে আরও কিছুদিন বাকি ছিল।

ইউরোপ দু’ধরনের মিত্রতার বন্ধনে আবদ্ধ ছিল। এর একটি হল জার্মানি, অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি এবং ইটালির সমন্বয়ে ত্রি-মিত্রতা এবং অপরটি হল রাশিয়া, ফ্রান্স এবং ব্রিটেনকে নিয়ে ত্রি-আঁতাত। বেশ কয়েক যুগ ধরে এ মিত্রতা ও আঁতাতের বন্ধনে আবদ্ধ দেশগুলোর প্রচেষ্টায় এদের অংশীদারদের মধ্যে প্রত্যক্ষ সংঘর্ষ এড়ানো সম্ভব হয়েছে।

এক্ষণে দু’বছর ধরে বলকানে অবিরাম উত্তেজনা চলার পর সারায়ভ’র হত্যাকাণ্ড ইটালি বাদে সব দেশকে মহাদেশীয় যুদ্ধে জড়িয়ে ফেলেছে। লাগামহীন সমরবাদ, সংবাদপত্রের মাধ্যমে উত্তেজনা সৃষ্টি, উগ্র জাতীয়তাবাদ, অপরীক্ষিত সামরিক ও নৌশক্তি এবং এক ধরনের বিরক্তিকর একঘেয়েমি- সবকিছু একত্র হয়ে শতাব্দীব্যাপী ইউরোপের স্থিতিশীলতা এবং শান্তিকে বিনষ্ট করে দিল। গোলাগুলি শুরু হতে না হতেই চূড়ান্ত বিশ্বযুদ্ধে পরিণত হল।

২৩ আগস্ট জাপান জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করল। ব্রিটেনের সঙ্গে জাপানের মিত্রতার শর্ত পূরণ করতেই এ যুদ্ধ ঘোষণা করা হল। জাপান দূরপ্রাচ্যে জার্মানির কিছু স্থাপনা দখল করে নিল। অল্প কিছুদিনের মধ্যে আফ্রিকায় জার্মান ও ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সৈন্য বাহিনীর মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ-সংঘর্ষ শুরু হয়ে গেল।

ইউরোপের কাছে অটোম্যান সরকার আগস্টে নিরপেক্ষ থাকার অবস্থান ঘোষণা করলেও অক্টোবরে এসে জার্মানি এবং অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরির কেন্দ্রীয় শক্তির সঙ্গে যুদ্ধে যোগদান করল। যুদ্ধটি সত্যিকার অর্থে বিশ্বযুদ্ধের রূপ লাভ করল। একজন রাজপুত্র এবং তার স্ত্রীকে হত্যা যুদ্ধের আশু কারণ হলেও এর গভীর ছিল দীর্ঘদিনের চাপা উত্তেজনা এবং বিপরীতমুখী মিত্রশক্তি বৈরী সম্পর্ক।

যে ইউরোপে দীর্ঘদিন কোনো বড় যুদ্ধ হয়নি, সেই ইউরোপ পরিণত হল প্রথম মহাযুদ্ধের থিয়েটারে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধেও ইউরোপ ছিল যুদ্ধের থিয়েটার। এখন প্রশ্ন জাগে যদি দৈবাৎ তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ বেঁধে যায় তাহলে তার থিয়েটারটি কোথায় হবে? সেটা কি মধ্যপ্রাচ্য?

ইরানের সমরবিদ কাসেম সোলেমানি ছিলেন ইরানের কুদস ফোর্সের প্রধান। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনির পরই ক্ষমতাধর ছিলেন তিনি। সিরিয়া ও ইরাক যুদ্ধের গতিপ্রকৃতি তিনি বদলে দিয়েছিলেন নিজের অনন্য সমরকৌশলে। পর্যুদস্ত করে ছেড়েছেন মার্কিন বাহিনী ও তাদের মিত্রদের। লেবাননের হিজবুল্লাহ ও ফিলিস্তিনের জিহাদিদের শক্তি জুগিয়ে ছিলেন তিনি। পুরো মধ্যপ্রাচ্যে তার প্রভাব ছিল ব্যাপক।

ইরানি এ জেনারেল কাসেম সোলেমানিকে (৬২) হত্যা করেছে যুক্তরাষ্ট্র। তিনি ছিলেন ইরানের রেভল্যুশনারি গার্ডের শাখা কুদস ফোর্সের প্রধান। গত ৩ জানুয়ারি শুক্রবার ভোরে ইরাকের বাগদাদ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে মার্কিন ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় নিহত হয়েছেন সোলেমানিসহ ৭ জন।

সোলেমানিকে হত্যার নির্দেশ এসেছে খোদ মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছ থেকে। এ ব্যাপারে স্বীকৃতি জ্ঞাপন করে তিনি বলেছেন, সোলেমানিকে হত্যা করা উচিত ছিল আরও অনেক আগেই। সোলেমানিকে হত্যার চরম প্রতিশোধ নেয়া হবে বলে হুশিয়ারি দিয়েছেন ইরানের শীর্ষ আধ্যাত্মিক নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি। নিজের কাজের জন্য কেবল খামেনির কাছেই জবাবদিহি করতেন সোলেমানি।

তার মৃত্যুতে তিন দিনের শোক ঘোষণা করেছে ইরান। সোলেমানির দাফন অনুষ্ঠানে কালো পোশাক পরে মাতম করেছে লাখ লাখ ইরানি। ইরানের সাধারণ মানুষ তাকে ভালোবাসত। তার মৃত্যুতে ইরানের যে অপরিমেয় ক্ষতি হয়েছে তারই প্রতিফলন ঘটেছে তার শেষ কৃত্যানুষ্ঠানে শোকার্ত জনতার ঢলে। ইরানিদের জাতীয়তাবোধ এবং স্বদেশপ্রেম সোলেমানির মৃত্যুকে কেন্দ্র করে উদ্বেল হয়ে উঠেছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে সোলেমানি হত্যা মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা বাড়িয়ে দেবে আরও অনেকখানি। এমনকি এ ঘটনা যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানকে সরাসরি যুদ্ধের দিকে ঠেলে দিতে পারে। বিশ্ব আজ এমন এক সূক্ষ্ম ধারালো পুলের উপর দাঁড়িয়ে আছে যেখান থেকে যে কোনো মুহূর্তে পতনের আশঙ্কা রয়েছে এবং যার তলদেশে রয়েছে জ্বলন্ত নরক কুণ্ড। বিশ্ব আজ অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় অনেক বেশি বিপদসংকুল অবস্থার মধ্যে রয়েছে।

১৯৬২-তে কিউবায় সোভিয়েত মিসাইল স্থাপনকে কেন্দ্র করে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে যুদ্ধ বেধে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। সেদিন পৃথিবীর সব চিন্তাশীল মানুষ আরেকটি মহাযুদ্ধের ভয়াবহতা কল্পনা করে ভীষণভাবে শঙ্কিত হয়ে পড়েছিলেন। দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেল দুই পরাশক্তির মধ্যে মধ্যস্থতা করতে এগিয়ে আসেন। তার মধ্যস্থতা ফলপ্রসূ হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত সোভিয়েত ইউনিয়ন কিউবা থেকে মিসাইলগুলো প্রত্যাহার করে নেয়ার ঘোষণা দেয়।

পৃথিবী আরেকটি মহাযুদ্ধের মরণখেলা থেকে রক্ষা পায়। কিউবার নেতারা এর ফলে হতাশ ও ক্ষুব্ধ হয়েছিল। গণচীন তখন বলেছিল, কিউবায় মিসাইল স্থাপন ছিল হঠকারিতা এবং তা প্রত্যাহার করে নেয়া ছিল সুবিধাবাদ। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের ধারালো চোয়ালের মধ্যে অবস্থিত ক্ষুদ্র কমিউনিস্ট রাষ্ট্র কিউবাকে নিরাপত্তা দেয়ার আরও অনেক কূটনৈতিক পন্থা ছিল। অগ্র-পশ্চাৎ বিবেচনা না করে কিউবায় মিসাইল স্থাপন একটি অবাঞ্ছিত পরিস্থিতির সৃষ্টি করে।

যুদ্ধ সম্পর্কে নৈতিকতার দিক থেকে বলা হয়, যুদ্ধ হতে পারে ন্যায় যুদ্ধ এবং অন্যায় যুদ্ধ। একটি দেশ যখন অন্য একটি দেশের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন করে সামরিক হামলা চালায় তখন সেই যুদ্ধ হয় অন্যায় যুদ্ধ। অন্যদিকে এ অন্যায় যুদ্ধের বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ হবে ন্যায় যুদ্ধ।

ইরান মধ্যপ্রাচ্যে যা কিছু করেছে তা মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর স্বাধীনতা ও সর্বভৌমত্ব রক্ষার স্বার্থেই করেছে। ইরানের পদক্ষেপ হয়তো যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চাভিলাষ, ইসরাইলের জায়নবাদ এবং মধ্যপ্রাচ্যের প্রতিক্রিয়াশীল রাজতন্ত্রের স্বার্থে আঘাত হেনেছে। এ সবের জন্য ইরানকে অন্যায়কারী দেশ বলা যায় না।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প অন্য একটি দেশের বিদেশ সফররত অতি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাকে মিসাইল আক্রমণের সাহায্যে হত্যা করে আন্তর্জাতিক আইনের সব রীতি-নীতিকে অগ্রাহ্য করেছে। এক দেশের রাষ্ট্রীয় মেহমানকে অন্য একটি দেশের ড্রোন মিসাইল হামলার মাধ্যমে হত্যা করবে এমনটি মেনে নেয়া যায় না। পাঠক ভেবে দেখুন, পৃথিবীর যে কোনো দেশের সঙ্গে অন্য যে কোনো দেশের স্বার্থের সংঘাত থাকতে পারে।

কিন্তু এটাকে অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করে অপছন্দের দেশের কোনো গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে এভাবে হত্যার লাইসেন্স ব্যবহার করলে গোটা আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়বে। এক দেশের সঙ্গে অন্য দেশের ন্যূনতম আস্থার সম্পর্কের লেশমাত্র থাকবে না।

ফলে যে কোনো মুহূর্তে যুদ্ধের সূচনা হতে পারে। হতে পারে সেই যুদ্ধের চৌহদ্দি আঞ্চলিক কিংবা বিশ্ব পরিসরে ব্যাপ্ত। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এমন একটি পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে চরম উসকানি দিয়েছেন। এ উসকানি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিভাবান মানুষদের জ্ঞান ও প্রজ্ঞার সঙ্গে কোনোমতেই সঙ্গতিপূর্ণ নয়।

মধ্যপ্রাচ্যে ইরান-যুক্তরাষ্ট্র ছায়াযুদ্ধ কয়েক দশকের। ইরানের বিতর্কিত পারমাণবিক কর্মসূচিসহ বহু বিষয়ে দু’দেশ পরস্পরের প্রতি বৈরী। গত বছর জুনে উপসাগরীয় অঞ্চলে যুক্তরাজ্যের দুই তেলবাহী জাহাজে অন্তর্ঘাতমূলক হামলা হয়।

এর জন্য ইরানকে দায়ী করেছিল মার্কিন কর্তৃপক্ষ। যুক্তরাজ্যের জাহাজে হামলার জন্য যুক্তরাজ্য ইরানকে দায়ী করেনি। যুক্তরাষ্ট্র স্ব-আরোপিতভাবে অভিযোগ উত্থাপন করেছে। এ থেকেই বোঝা যায় যুক্তরাষ্ট্র ইরানের ওপর প্রতিশোধ গ্রহণে বদ্ধপরিকর।

ইরাকের বাগদাদে যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ইরানের প্রভাবশালী জেনারেল কাসেম সোলেমানিকে হত্যার ঘটনায় তীব্র মতভেদ দেখা দিয়েছে মার্কিন কংগ্রেসে। হামলার কথা প্রকাশের পরপরই ক্ষমতাসীন রিপাবলিকান সদস্যরা প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের এ পদক্ষেপের উচ্চ প্রশংসা করলেও প্রশ্ন তুলেছেন বিরোধী ডেমোক্রেটরা।

তারা বলেছেন, কংগ্রেসকে অন্ধকারে রেখেই এ হামলা চালানো হয়েছে। এটা মার্কিন জনগণের নিরাপত্তা ঝুঁকি আরও বাড়িয়ে দেবে। প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার ও ডেমোক্রেট নেতা ন্যান্সি পেলোসি বলেছেন, হামলা চালিয়ে সোলেমানিকে হত্যার ঘটনা ভয়াবহ সংঘাতকে উসকে দেবে।

তিনি আরও বলেন, এ উত্তেজনা এমন একটি পর্যায়ে পৌঁছতে পারে, যেখান থেকে যুক্তরাষ্ট্র ও বিশ্বকে ফিরে আসার আর কোনো সুযোগ থাকবে না। ফ্রান্সের ইউরোপবিষয়ক মন্ত্রী অ্যামেলি দি মন্তেচেলিন বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের হামলায় ইরানি জেনারেলের নিহত হওয়ার ঘটনা বিশ্বকে আরও বিপজ্জনক করে তুলবে। রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, কাসেম সোলেমানি হত্যাকাণ্ডে মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা বাড়াবে।

প্রতিদিনের প্রেস ব্রিফিংয়ে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র জেং শুয়াং বলেছেন, আন্তর্জাতিক সম্পর্কে বল প্রয়োগের সবসময় বিরোধী বেইজিং। আমরা সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে বিশেষত যুক্তরাষ্ট্রকে শান্ত থাকা এবং সংঘাত এড়িয়ে চলার আহ্বান জানাই।

জার্মানির চ্যান্সেলর এঙ্গেলা মার্কেলের মুখপাত্র উলরিক ডেমার বলেছেন, উত্তেজনা মারাত্মক অবস্থায় পৌঁছেছে। এখন সব পক্ষের সংযম প্রদর্শন ও সংঘাত এড়িয়ে চলা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। মোদ্দাকথায় বলা যায়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিমা মিত্ররা খুব সহজভাবে বিষয়টিকে গ্রহণ করতে পারেনি। ঘটনার ভয়াবহতা খুব খারাপের দিকে মোড় নিতে পারে এমন আশঙ্কা অনেকেরই।

একসময় ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সমালোচনা করে বলেছিলেন, ওবামা নির্বাচনে জেতার জন্য ইরানের সঙ্গে যুদ্ধে জড়াতে পারেন। সেটা ছিল ২০১২ সাল। আর ২০২০ সালে এসে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে ৩ জানুয়ারি শুক্রবার ইরানের মেজর জেনারেল কাসেম সোলেমানিকে হত্যার নির্দেশ দিলেন খোদ ট্রাম্প।

এমন এক সময় ট্রাম্প এ হত্যার নির্দেশ দিলেন যখন কংগ্রেসের নিুকক্ষ প্রতিনিধি পরিষদ তাকে অভিশংসিত করেছে। এ ছাড়া প্রেসিডেন্ট হিসেবে পুনর্নির্বাচিত হওয়ার ক্ষেত্রে এক ধরনের ঝুঁকিতে রয়েছেন তিনি। তাই কোনো কোনো বিশ্লষক এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির যোগসূত্র রয়েছে বলে মনে করেন।

বছরের পর বছর যুক্তরাষ্ট্রের অবরোধ খড়্গ মাথায় নিয়ে আর নতুন নতুন হুমকি, প্রবল আন্তর্জাতিক চাপ ও দরকষাকষির মধ্যে ২০১৫ সালে নমনীয় হয় ইরান। ৬ বিশ্বশক্তির সঙ্গে পারমাণবিক চুক্তি সই করে।

তবে ট্রাম্পের গোয়ার্তুমি এবং তার নির্দেশে জেনারেল কাসেমের হত্যাকাণ্ডে ক্ষুব্ধ ইরান এবার সেই ঐতিহাসিক চুক্তির শর্ত আর মানবে না বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছে। তবে চুক্তির অন্যতম তিন পক্ষ জার্মানি, ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্য ইরানের প্রতি ওই চুক্তিকে অবজ্ঞা না করার অনুরোধ জানিয়েছে।

অবশ্য প্রায় ২ বছর আগেই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মতামত ও ইচ্ছা অবজ্ঞা করে একতরফাভাবে ট্রাম্পের যুক্তরাষ্ট্র এ চুক্তি থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছে। সবশেষে ইরান হুমকি দিয়েছে হোয়াইট হাউসে হামলার।

তবে কি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ বেধে যাবে? ইরান ইতিমধ্যেই ইরাকে দুটি মার্কিন ঘাঁটিতে মিসাইল হামলা চালিয়েছে। তবে আমার কাছে মনে হয়, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ বাধার আশঙ্কা খুবই কম। এখনকার পরিস্থিতি প্রথম মহাযুদ্ধের সঙ্গে তুলনীয় নয়। ইরানের বন্ধুরাষ্ট্র রাশিয়া ও চীন অর্থনৈতিকভাবে যে পর্যায়ে রয়েছে সেখান থেকে তারা যুদ্ধে জড়ানোর চেয়ে যুদ্ধের আগুন নেভানোর জন্য তৎপরতা চালাবে। ইরানে ৫০ বিলিয়ন ব্যারেল অতিরিক্ত তেলের খনি আবিষ্কৃত হয়েছে।

ইরানের রয়েছে প্রচুর গ্যাসসম্পদ। এসব সম্পদ জাতীয় সমৃদ্ধি অর্জনের যে পূর্বশর্ত তৈরি করেছে তার প্রতি ইরানের প্রাজ্ঞ নেতৃত্ব অবহেলা করবে এমনটি মনে হয় না। তবে মধ্যপ্রাচ্যে প্রাধান্য বিস্তারের প্রশ্নে war of attrition আরও তীব্র আকার ধারণ করতে পারে।

ইরান ও ইরাক আরও কাছাকাছি আসবে। সব মিলিয়ে অর্থাৎ লেবানন, সিরিয়া, ইয়েমেন ও ইরাককে নিয়ে ইরানের চেষ্টা থাকবে তার শক্তিকে সংহত করার। সিয়া ঐতিহ্যে শোকের জন্য মাতমের রীতি আছে; কিন্তু প্রতিহিংসামূলক প্রতিরোধের তেমন কোনো দৃষ্টান্ত নেই। এখন দেখার বিষয় জাত্যাভিমান এবং আলোকিত আত্মস্বার্থের মধ্যে কোনটি বিজয়ী হয়।

বাংলানিউজসিএ/ঢাকা/ ০৯ জানুয়ারি ২০২০ /এমএম


Array