Menu

বাংলানিউজসিএ ডেস্ক :: আমাদের সমাজে বিয়ের আসরে একটা বিষয় নিয়ে সবসময় জটলা লেগেই থাকে; আর সেটা হল দেনমোহর। মূলত ‘দেনমোহর’ বিয়ের একটি অলঙ্ঘনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ বিধি। দেনমোহর ধার্য করা ছাড়া বিয়ে সম্পন্ন হয় না। এটা স্ত্রীর প্রাপ্য।বিয়েতে ধার্যকৃত দেনমোহর স্বামীকে অবশ্যই পরিশোধ করতে হবে। কোরআন ও হাদিসের আলোকে এটা বিয়ের একটি অপরিহার্য শর্ত বা নিয়ম, উপেক্ষা করার উপায় নেই। মোহরের পরিমাণ কম বেশি যাই হোক না কেন, এই নিয়ম অবশ্যই পালন করতে হয়। দেনমোহর ব্যতীত বিয়ে সুসম্পন্ন হয় না।

মোহরের অংকটা নির্ধারণ করা হয় পাত্রের আর্থিক সামর্থ্য অনুযায়ী এবং অবশ্যই পাত্রের সম্মতিক্রমে। পাত্রের নির্ধারিত সেই দেনমোহরে আবার পাত্রীর সম্মতি থাকতে হবে। তবেই পাত্র-পাত্রী একে অপরকে চিরসঙ্গী হিসেবে গ্রহণ করতে সম্মত হবে এবং কবুল বলবে, অন্যথায় নয়।অথচ আমাদের সমাজে দেখা যায়, দেনমোহর কত টাকা হবে, তা নির্ধারণ করে মুরব্বি বা অভিভাবকরা। পাত্রের সামর্থ্য থাকুক বা না থাকুক; তাতে কারও কিছু যায় আসে না। পাত্রীপক্ষ থেকে বিবেক-বিবেচনা ভুলে গিয়ে (বর্তমান প্রেক্ষাপটে নিরাপত্তার অজুহাত দেখিয়ে, কখনবা স্ট্যাটাস রক্ষার খাতিরে) ‘গাছে-মাছে’ একটা অংক নির্ধারণ করে সুইচ টিপে দেয়, ব্যস! এ নিয়ে উভয়পক্ষে তর্ক-বিতর্কও হয়, দরকষাকষিও চলে; কখনও কখনও বিয়ে ভেঙেও যায়।

পাত্রপক্ষ বলে, ‘ছেলের অত সামর্থ্য নেই, আরও কম ধরেন।’ কনেপক্ষ তিরস্কারসূচক মন্তব্য করে- ‘আপনারা কি ফকির নাকি, কম ধরবেন কেন?’ কেউ বলে, ‘এসব ক্ষেত্রে সামর্থ্য লাগে না, পরিশোধ করতে হবে; এমন কোনো কথা নেই।’ কেউ আবার গলা নামিয়ে বলে, ‘বাসরঘরে মাফ চেয়ে নিলেই হয়।’ কেউ বলে, ‘হ, তারা সুখে থাকলেই হল। ধরেন ধরেন, যা ধরার ধরেন; অসুবিধা নাই।’ কেউ আবার খোঁচা দেয়। ‘মান-সম্মান বজায় রাখেন।’

কেউ বলে, ‘এটা কোনো ব্যাপার না, জাস্ট ফর্মালিটি।’ এসব কথা বলে বলে লাখ লাখ টাকা নির্ধারণ করে বসে থাকে; কোনো কোনো পাত্রের পক্ষে যা আকাশকুসুম কল্পনা কিংবা বাপ-দাদা চৌদ্দপুরুষকে বিক্রি করলেও ওই পরিমাণ টাকা হবে না।ভদ্রতার খাতিরে বিয়ের মজলিশে সাধারণত কোনো বর প্রতিবাদ করে না। সুতরাং বিয়ে সম্পন্ন হয়ে যায় এবং ফুলশয্যায় গিয়ে লাজলজ্জার মাথা খেয়ে কাপুরুষের মতো মাফ চেয়ে নেয়। এ কাজটি করতে তার বিবেকে একটুও বাধে না। কারণ তখন তার সামনে থাকে অনাবিষ্কৃত এক পৃথিবী।

এ পৃথিবী বিজয়ে শুধু শুধু দেনমোহরের মতো তুচ্ছ বিষয়টিকে প্রাচীর বানিয়ে সামনে রেখে লাভ কী- ‘রেখো না ওই প্রাচীর, ভেঙে করো চৌচির;’ ‘কেউ দেখবেও না, জানবেও না;’ লজ্জা রেখেই বা কী লাভ, পুরোটাই এখন আমার দখলে, আমিই রাজা;’ ইত্যাদি ভাবতে ভাবতে নির্বোধ, নির্লজ্জ, বেহায়া কাপুরুষের মতো স্বামী ‘মাফের অনুরোধ উপস্থাপন করে। স্বামীর অনুরোধে করুণা করে হলেও নববধূ তাকে মৌখিকভাবে মাফ করে দিতে বাধ্য হয়। অবশ্য এছাড়া কোনো উপায়ও থাকে না। সুতরাং সহজেই প্রতিষ্ঠিত হয় স্বামীর অধিকার।তাহলে বিষয়টা কী দাঁড়াল? মুরব্বিদের দেনমোহর ধার্য করার দৃশ্য দেখে অবশ্যই ধরে নেয়া যায় যে, দেনমোহর ছেলের অভিভাবক নিজেই পরিশোধ করে দেবে; ছেলেকে আর কষ্ট করে শোধ করতে হবে না।

আর যদি ছেলেকেই সেই পাহাড়সম দেনমোহর পরিশোধ করতে হয় তাহলে ধরতে হবে, জোরপূর্বক তাকে দিয়ে কবুল পড়ানো হয়েছে; সুতরাং এই ‘কবুল’ কতটা সিদ্ধ, প্রশ্ন থেকে যায়। দ্বিতীয়ত, স্ত্রীর কাছে মাফ চেয়ে নিয়েছে। মাফ কি হয়েছে? যদি মাফ হয়ে থাকে তবে আরেকটা বিষয় স্পষ্ট হোক- যদি কোনো কারণে স্বামী-স্ত্রীর মাঝে বিচ্ছেদ ঘটে, তাহলে পঞ্চায়েত কিংবা আদালত বিয়েতে ধার্যকৃত দেনমোহর পরিশোধপূর্বক (আগে পরিশোধ হয়েছে কিনা; সাধারণত লেখা থাকে না। কখনও কখনও নগদ ‘উসুল’ হিসেবে কাবিননামায় কিছুটা লেখা থাকে)।

কোরআন-হাদিসের আলোকে একটা নির্দিষ্ট সময় বা পুনর্বিবাহ না হওয়া পর্যন্ত স্ত্রীর সমস্ত ব্যয়ভার বহন করতে হবে- এই মর্মে একটা রায় প্রদান করে থাকে। যদি তাই হয়, তাহলে কি মাফ হল? পবিত্র কোরআন মজিদে সূরা আন-নিসার চার নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে (যার অর্থ হল)- ‘আর তোমরা স্ত্রীদেরকে তাদের মোহর দিয়ে দাও খুশি মনে।

তারা যদি খুশি হয়ে তা থেকে অংশ ছেড়ে দেয়, তবে তা তোমরা স্বাচ্ছন্দ্যে ভোগ কর।’ এখানে অংশ মানে, কিয়দংশ ছাড় দেয়ার কথা বলা হয়েছে; পুরোটা নয়। তার মানে, পরিশোধ তাকে করতেই হবে, বাধ্যতামূলক; অংশ যাই হোক। পরিশোধ না করে মারা গেলে পিতার পক্ষ থেকে তার ছেলেও পরিশোধ করতে পারবে, তবুও করতেই হবে। এটা হেলাফেলার জিনিস না।

দেনমোহর পরিশোধ না করলে স্বামী চিরঋণী হয়ে থাকবে, আখেরাতে ব্যভিচারী হিসেবে তার বিচার হবে (তিরমিজি-২৪৬১)। সুতরাং দেনমোহর কোনো সাধারণ বিষয় নয়। এখন অভিভাবকরা সিদ্ধান্ত নিন- ছেলের ওপর চাপিয়ে দেয়া ঋণের দায়িত্ব কে নেবে? আপনি? নাকি মজলিশে উপস্থিত মেহমানরা? দেনমোহর ধার্য করার দায়িত্ব কার? নিজেরাই দায়িত্ব বহন করবেন, নাকি সম্পূর্ণ ছেলের (বর) ওপর ছেড়ে দেবেন?

এসব বিষয়ে আমাদের মসজিদগুলোয় তেমন একটা গুরুত্ব দিয়ে ওয়াজ করা হয় না; কিংবা যিনি বিবাহ পড়ান, সেই কাজীও কাউকে সচেতন করান না। কারণ দেনমোহর যত বেশি হবে; লোলুপ দৃষ্টিতে অপেক্ষা করতে থাকা কাজীর ‘কমিশনের পরিমাণ’ও তত বেড়ে যাবে। সুতরাং কাজী সাহেব ‘খোঁচা মেরে সাপ জাগানো’ থেকে বিরত থাকেন এবং মূল বিষয়টা অজ্ঞাতসারে লাগামহীন হয়ে পড়ে। মূলত দেনমোহর বিষয়টিকে প্রত্যেকের গুরুত্বসহকারে দেখা উচিত; এটা মোটেই হেলাফেলার কোনো জিনিস নয়।

বাংলানিউজসিএ/ঢাকা/ ০৮ জানুয়ারি ২০২০ /এমএম


Array