ড. ফাহ আনসারী :: দেশ-বিদেশে ঘুরে বেড়ানো নেশা থেকে এখন পেশা। মানে পেশাগত কাজেই প্রতিনিয়ত ঘুরে বেড়াতে হয় বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের কোনো পাড়া গাঁয়ে। কখনও বা আবার মেঠোপথের ধুলা ঝেড়েই উঠে বসতে হয় বিমানে, পৃথিবীর নতুন কোনো দেশের আধুনিক শহরের উদ্দেশে। যখন যেখানেই থাকি না কেন, অনুসন্ধানী চোখ খুঁজে ফেরে কৃষি উদ্ভাবনের নিত্যনতুন অনুষঙ্গে।
কয়েক মাস আগে মালয়েশিয়ায় গেলাম। কুয়ালালামপুরের হোটেল শেরাটন ইমপেরিয়ালে সকালের নাশতা, দুপুর কিংবা রাতের খাবারে নানারকম মেন্যুর সঙ্গে ফল একটি নিয়মিত অনুষঙ্গ। একটু খটকা লাগল। খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম, এটা মালয়েশিয়ার রীতি। বলতে গেলে, স্থানীয় ফলের প্রসারে বিদেশিদের সামনে পরিবেশনের এমন উদ্যোগ। যা সে দেশের স্থানীয় ফলের চাহিদা বাড়াচ্ছে, প্রসার ঘটছে স্থানীয় খাদ্যের। তেমনি তাদের অর্থনীতিও ফুলে ফেঁপে উঠছে।
এই যেমন, আমাদের দেশে জ্যৈষ্ঠ মাসের ফল কাঁঠাল, যা আমাদের জাতীয় ফলও। পাওয়া যায় কেবল বর্ষাকাল পর্যন্তই। তবে মালয়েশিয়ায় কাঁঠাল পাওয়া যায় সারা বছরই। আমরা দেশে কাঁঠাল কিনি কমপক্ষে একটা। আর মালয়েশিয়ানরা কাঁঠাল কেনে বড়জোর চার খোসা! এখানে শপিংমলে বা রাস্তার ধারে কাঁঠাল বিক্রি হয় চার, পাঁচ বা ছয় খোসা প্যাকেট করে। আস্ত কাঁঠাল মিলবে বড় কোনো বাজারে গেলে। মালয়েশিয়ার কৃষি বিভাগের তথ্যানুযায়ী, মালয়েশিয়ায় বছরে প্রায় ২৫ থেকে ৩০ হাজার টন কাঁঠাল উৎপাদন হয়। অধিকাংশ কাঁঠাল উৎপাদন হয় দেশটির পাহাং ও জহুর প্রদেশে।
মালয়েশিয়ানরা খাবারের সঙ্গে ফল পছন্দ করে। কেবল ফল দিয়েই আহার সেরে নেয় স্থানীয়দের অনেকে। এখানে কাঁঠালের মতো দেখতে ‘ডুরিয়ান’ ফলও বেশ জনপ্রিয়। এর আকারটা কাঁঠালের মতো বড় নয়, কিছুটা ছোটখাটো কাঁঠালের মতো। ডুরিয়ানের ওপরে কাঁটাগুলো কাঁঠালের কাঁটার চেয়ে একটু বড়। এটি মালয়েশিয়ার জাতীয় ফল। আবার, ‘লামবুতান’ নামে লিচুর মতো দেখতে একটা মজাদার ফল আছে। বাংলাদেশসহ এশিয়ার অন্যান্য দেশ থেকে মালয়েশিয়ায় ঘুরতে এসে লামবুতানের প্রেমে পড়ে যান অনেকে। শানতোল নামে আরেক রকম ফল আছে, যা খেতে সুস্বাদু। বাংলাদেশেই ইদানীং ফলটির দেখা মিলছে। আরও কিছু স্থানীয় ফলের সঙ্গে পরিচিত হলাম হোটেলে বসেই। মালয়েশিয়ার রীতি হল, হোটেল, রাষ্ট্রীয় কোনো অনুষ্ঠান, স্থানীয় কোনো আয়োজন, সব ক্ষেত্রেই দেশটির নিজস্ব ফলের পরিবেশন করা বাধ্যতামূলক। কোনো অবস্থাতেই, যত ভিন্নধর্মী বা গুরুত্বপূর্ণ প্রোগ্রামই হোক না কেন, সেসব অনুষ্ঠানে বিদেশি ফল পরিবেশন নিষিদ্ধ। আমরা প্রথমে মালয়েশিয়ান এসব ফলে অনভ্যস্ত হলেও পরে তার প্রেমে পড়ে যাই।
এমন রীতি কিন্তু আমাদের দেশেও করা সম্ভব। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন, বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার, বান্দরবানের নীলগিরি, নিঝুম দ্বীপ ও কুয়াকাটাসহ দেশে এমন অসংখ্য দর্শনীয় স্থান রয়েছে, যেখানে বছরজুড়েই বিদেশি পর্যটকরা ভ্রমণে আসে। ২০১৪ সালে করা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) এক জরিপে দেখা গেছে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে প্রতি বছর গড়ে ৯ লাখ পর্যটক বাংলাদেশের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন, সাংস্কৃতিক, ঐতিহাসিক ও দর্শনীয় স্থান দেখতে আসে। এর মধ্যে ছয় লাখ হল সরাসরি বিদেশি পর্যটক। আর বাকি তিন লাখ নন-রেসিডেন্ট বাংলাদেশি। সরাসরি পর্যটন খাত থেকে বছরে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) ১৬ হাজার ৪০৯ কোটি টাকা মূল্য সংযোজন হচ্ছে। যা জিডিপির দেড় শতাংশেরও বেশি।
এদিকে আবার আমাদের দেশীয় ফলের উৎপাদনও বেড়েছে আগের তুলনায়। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের (ডিএই) তথ্য বলছে, ২০১৬-১৭ অর্থবছর সারা দেশে প্রায় ৭ লাখ ১৫ হাজার ৯৪১ হেক্টর জমিতে ফলের আবাদ হয়। এসব জমিতে ফল উৎপাদন হয়েছে ১ কোটি ২১ লাখ টন। এর মধ্যে উৎপাদনে শীর্ষে রয়েছে তরমুজ। এ সময় ফলটির আবাদ হয় প্রায় ৪৫ হাজার ৭৪২ হেক্টর জমিতে আর উৎপাদন ২১ লাখ ৯৫ হাজার ৯৩৯ টন। অন্যান্য ফলের মধ্যে আম ১ লাখ ৭৪ হাজার ২০৮ হেক্টর জমিতে আবাদ হয়, উৎপাদন ২১ লাখ ৪৩ হাজার ৪৪৩ টন। কলা ৮৯ হাজার ৯০৮ হেক্টর জমিতে আবাদ হয়, উৎপাদন ১৭ লাখ ৬৬ হাজার ৯১৭ টন। যদিও উৎপাদিত ফল মাঠ থেকে ভোক্তা পর্যন্ত পৌঁছতে ৩৫-৪০ শতাংশ অপচয় ও বিনষ্ট হচ্ছে। সনাতন পদ্ধতিতে ফল সংগ্রহ, অসতর্ক ও অযত্ন-অবহেলায় নাড়াচাড়া, অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে পরিবহনজনিত কারণে এ অপচয় হচ্ছে। উন্নত বীজ, সেচ ও প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে মাঠ ফসলের উৎপাদন বেড়েছে। দেশে এখন সারা বছরই বিভিন্ন জাতের ফল উৎপাদন হচ্ছে। দেশের আবহাওয়া ও ভূ-প্রকৃতি গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ফল উৎপাদনের জন্য বেশি উপযোগী। গ্রীষ্মমণ্ডলীয় এসব ফলের মধ্যে তরমুজ একটি বিশেষ অবস্থান ধরে রেখেছে। সব মিলিয়ে ৭০টিরও বেশি প্রকারের ফল উৎপাদন হচ্ছে। এর মধ্যে উৎপাদনের দিক দিয়ে তরমুজ সবচেয়ে এগিয়ে।
ভোক্তাদের মাঝে বাড়ছে দেশীয় ফলের চাহিদা। পুষ্টিমানে বেশি, দামে কম ও তরতাজা পাওয়া যায় বলে মানুষের ফল খাওয়ার তালিকায় যুক্ত হচ্ছে নানা দেশীয় ফলের নাম। অপ্রচলিত নানা ফলের বাণিজ্যিক বিস্তারও বাড়ছে। এই যেমন লটকন। নরসিংদী অঞ্চলের বিখ্যাত এ ফলটিকে আগে ধরা হতো বুনো ফল হিসেবে। এখন দেশব্যাপী এ ফলের চাহিদা বাড়ছে। চাষও হচ্ছে নানা জায়গায়। বরিশাল অঞ্চলের পানিফলও পাওয়া যাচ্ছে বিভিন্ন কাঁচাবাজারে ও ফলের দোকানে। একইভাবে বেত ফল, ডেউয়া, চাপালিশ, কাউ, গাব, বক্স বাদাম জায়গা করে নিচ্ছে মানুষের প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায়। যদিও দেশীয় ফলের প্রচার না থাকা কিংবা সহজে না পাওয়ার কারণে শহরের বড় একটা শ্রেণী বিদেশি ফলে অভ্যস্ত। আসলে আমাদের নিজস্ব পরিবেশ ও নিজেদের অঞ্চলে যেসব ফলের উৎপাদন হয়, সেসব ফল খাওয়া উচিত। এতে আমরা বেশি পুষ্টি পাব। এসব ফলের অভ্যন্তরীণ প্রসারে আঞ্চলিক বাণিজ্য বাড়বে, কর্মসংস্থান তৈরি হবে বেকার যুবকদের। কিংবা গ্রামের কৃষকরা ফল চাষ ও বিপণনের মাধ্যমে আরও স্বাবলম্বী হয়ে গড়ে উঠতে পারবে।
একজন মানুষের যে পরিমাণ খাদ্যশক্তি ও পুষ্টি দরকার তার জন্য প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় একটি হলেও দেশীয় ফল রাখা দরকার। কেননা আমাদের দেশে তরমুজ, পেঁপে, আম, জাম, বাঙ্গি, টমেটোর মতো প্রচুর রঙিন ফল উৎপাদিত হয়। রঙিন ফল মানুষের দৃষ্টি ভালো রাখে, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তথা আয়ু বাড়ায়। আবার পুষ্টিগত বিবেচনাতেও দেশীয় ফল এগিয়ে। যদি একটা তুলনা করা হয়, দেখা যাবে প্রতি ১০০ গ্রাম আপেলে ভিটামিন-সি আছে মাত্র ৩.৫ মিলিগ্রাম, সেখানে পেয়ারায় আছে ২১০ মিলিগ্রাম। যা আপেলের তুলনায় ৬০ গুণ বেশি। অন্যদিকে ১০০ গ্রাম আঙ্গুরে খাদ্যশক্তি আছে ১৭ কিলোক্যালরি আর কুলে খাদ্যশক্তি আছে ১০৪ কিলোক্যালরি। আঙ্গুরে ভিটামিন সি আছে ২৮.৫ মিলিগ্রাম, যেখানে কুলে ভিটামিন সি আছে ৫১ মিলিগ্রাম। দেশীয় ফল পাকা আমে ক্যারোটিন থাকে ৮৩০০ মাইক্রোগ্রাম, পেঁপেতে ৮১০০ মাইক্রোগ্রাম, কাঁঠালে যা থাকে ৪৪০০ মাইক্রোগ্রাম। অন্যদিকে আঙুর, আপেল, নাশপাতিতে ক্যারোটিন নাই বললেই চলে। ক্যারোটিন দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে যা মানুষ এসব ফল খেয়ে পাবে।
বাংলাদেশে ব্যক্তিপর্যায়ে দেশীয় ফল চাষাবাদে সচেতনতা খানিকটা হলেও বাড়ছে। এ লক্ষ্যে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা উল্লেখ করার মতো। আবার কিছু কর্মসূচি রয়েছে বাংলাদেশ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরেরও। কৃষকদের নানারকম দেশীয় জাতের ফল চাষের ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগের মাধ্যমে। প্রতি বছর জুন-জুলাই মাসে সারা দেশে বৃক্ষমেলা আয়োজনের মধ্য দিয়ে মানুষকে ফলজ ও বনজ গাছ লাগানোর ব্যাপারে সচেতনতা বাড়ানোর কর্মসূচি রয়েছে। আগে দেশীয় ফলের মৌসুম বলতে সাধারণ আম-কাঁঠালের মৌসুমকে মনে করা হতো। এখন সারা বছরই নানা দেশীয় ফল চোখে পড়ে। এর বড় কারণ কিছু অপ্রচলিত ফল মূলধারায় চলে এসেছে। অনেক ফলেরই আগাম ও নাবী জাত আবিষ্কার করা হয়েছে। এগুলো সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে কৃষকদের মাঝে বিতরণ করা হচ্ছে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যেতে পারে, আগে আম সাধারণত জুলাই মাসেই শেষ হয়ে যেত। এখন কয়েকটি নাবী জাতের আম আবিষ্কার করার ফলে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আম থাকছে।
কাজেই দেশীয় ফলের প্রসারে আরেকটু মনোযোগ দিলে এ খাতটি কৃষি অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ খাত হয়ে গড়ে উঠবে। পাশাপাশি পুষ্টির দিক থেকেও এগিয়ে থাকব আমরা। কেননা আমদানি করা ফলের বেশির ভাগই ম্যাচিউর (পরিপক্ব) থাকে না। ওইসব ফলের উজ্জ্বলতা ও পচে যাওয়া রোধে যেসব উপকরণ ব্যবহার করা হয়, তা স্বাস্থ্যের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রাথমিকভাবে এসব ফল খেয়ে তাৎক্ষণিক কোনো প্রভাব দেখা না গেলেও পরবর্তী সময়ে তা লিভার সিরোসিস, কিডনি বিকল, মেমব্রেনসহ শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গের কার্যকারিতারোধ এবং কঠিন ও জটিল রোগের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাসেরও কারণ হতে পারে কেমিক্যাল মিশ্রিত ফল।
দেশীয় ফলের প্রসারে গ্রামীণ অর্থনীতির সমৃদ্ধি ঘটবে নানাভাবেই। এতে সরকারি কর্মসূচির সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে হবে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে। নিতে হবে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি নানা পদক্ষেপ। যা আমাদের গ্রামীণ অর্থনীতিকে চাঙ্গা করে তুলতে সাহায্য করবে। বাংলাদেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন লক্ষ্যও পূরণ করা সম্ভব হবে। দারিদ্র্যও কমে আসবে এবং দারিদ্র্য বিমোচন টেকসই হবে। এতে গ্রামভিত্তিক কৃষি, শিল্প ও সেবা খাত আরও বিকশিত হবে এবং জিডিপি প্রবৃদ্ধি নতুন মাত্রা লাভ করবে।
ড. ফা হ আনসারী : ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও, এসিআই এগ্রিবিজনেসেস
সূত্র: যুগান্তর
বাংলানিউজসিএ/ঢাকা/৪ মার্চ ২০১৯/ইএন