Menu

বাংলানিউজসিএ ডেস্ক :: এ বছরের (২০১৯-২০ অর্থবছরের) রাজস্ব আয় সংগ্রহের কর্মযজ্ঞ শুরু হয়েছে। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে অনুষ্ঠিত হচ্ছে করমেলা। নতুন নতুন করদাতা অত্যন্ত উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে করমেলায় ভিড় জমাচ্ছেন। সরকারের রাজস্ব আদায়ের এটাই উৎকৃষ্ট সময়।

করমেলা আয়োজনের মাধ্যমে দেশে রাজস্ব আয় বৃদ্ধির ক্ষেত্রে এক নতুন দিগন্তের সূচনা হয়েছে। এ মেলায় করদাতারা কোনোরকম হয়রানি ছাড়াই আয়কর জমা দিতে পারেন।মেলায় নতুন নতুন করদাতা, বিশেষ করে, নতুন প্রজন্ম অত্যন্ত আগ্রহ ভরে হাজির হচ্ছেন। ৫ লাখ ২৩ হাজার ১৯০ কোটি টাকা ব্যয় ধরে এবারের বাজেট ঘোষণা করা হয়েছে। এ ব্যয়ের বিপরীতে আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত হয়েছে ৩ লাখ ৮১ হাজার ৯৭৮ কোটি টাকা। আমাদের আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি। ঘাটতি বাজেট ধরা হয়েছে ১ লাখ ৪৫ হাজার ৩৮০ কোটি টাকা।

অর্থাৎ ২০১৯-২০ অর্থবছরটি শুরু হয়েছে একটি বিরাট অঙ্কের ঘাটতি মাথায় নিয়ে। আমাদের অভিজ্ঞতা থেকে দেখছি, বিরাট অঙ্কের বাজেট নিয়ে যাত্রা শুরু হলেও বছর শেষে তা বাস্তবায়ন করতে না পেরে বাজেটের লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে আনতে হয়।নতুন অর্থবছরে মোট দেশজ উৎপাদনের প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ৮ দশমিক ২০ শতাংশ। এ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হলে বেসরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে কর্মসংস্থানও বৃদ্ধি করতে হবে। কিন্তু বেসরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধির বিষয়ে বাজেটে কোনো দিকনির্দেশনা নেই।

আগামী অর্থবছরে উন্নয়ন বাজেট ধরা হয়েছে ২ লাখ ১১ হাজার ৬৮৩ কোটি টাকা। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বাজেট ছিল ৪ লাখ ৬৪ হাজার ৫৭৩ কোটি টাকা এবং রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ৩ লাখ ৪০ হাজার ৭৭৫ কোটি টাকা। সংশোধিত বাজেটে বছর শেষে তা ৩ লাখ ৪২ হাজার ৫৪০ কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়।

এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে সংগ্রহ করতে হবে ৩ লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকা। এনবিআরবহির্ভূত কর ব্যবস্থা থেকে ১৫ হাজার কোটি টাকা এবং বিভিন্ন সেবা থেকে ৩৮ হাজার কোটি টাকা আদায়ের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রতিবছর আমাদের ঘাটতি বাজেট হচ্ছে এবং হবে। কারণ, এনবিআরকে রাজস্ব আদায়ের যে লক্ষ্যমাত্রা দেয়া হয়েছে তা আদায় করা এনবিআরের একার পক্ষে সম্ভব হবে না।

এনবিআরের বর্তমান জনবল স্বল্পতা, লজিস্টিক সাপোর্ট দিয়ে সারা দেশের মানুষকে করজালের আওতায় আনা সম্ভব হবে না। ১৭ কোটি মানুষের দেশে ১ কোটি মানুষও আয়কর দেন না। বর্তমানে টিআইএনধারীর সংখ্যা ৪৪ লাখ ২৭ হাজার। আয়কর দেন মাত্র প্রায় ২২ লাখ মানুষ।

আমাদের ১ কোটি মানুষও যদি আয়কর দিতেন তাহলে সরকারকে ব্যাংক, সঞ্চয়পত্র বা বিভিন্ন উৎস থেকে ঋণ করতে হতো না বা ঘাটতি বাজেটের মুখোমুখি হতে হতো না। এমনকি বছর বছর নতুন করে করারোপ করতে হতো না।এ ছাড়াও কর আদায়ে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের হয়রানির কারণে মানুষ কর প্রদানে আগ্রহী হন না। দুর্নীতি কর আদায়ের ক্ষেত্রে বিরাট বাধা হিসেবে কাজ করে। অনেক কর কর্মকর্তা করদাতাদের অনৈতিক প্রস্তাব দেন, যার কারণে সার্বিকভাবে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয় না। উচ্চ করহারও ফাঁকির প্রবণতা বাড়ায়।

বেসরকারি চাকরিজীবীদের আয়কর প্রদান বাধ্যতামূলক করার ফলে রাজস্ব আয় কিছুটা হলেও বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১৭-১৮ সালে করমেলায় আগের বছরের চেয়ে রিটার্ন জমা পড়েছে ৭২ শতাংশ বেশি। আগের বছরের চেয়ে প্রায় দেড় লাখ বেশি করদাতা করমেলায় আয়কর জমা দিয়েছেন।

এ উদ্যোগের ফলে করদাতার সংখ্যা কিছুটা হলেও বৃদ্ধি পেয়ে বর্তমানে প্রায় ২২ লাখে উন্নীত হয়েছে; কিন্তু বাস্তবে এ সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য। কারণ, ১৭ কোটি মানুষের দেশে ২ কোটি মানুষও কর দেন না, এটি কোনো গ্রহণযোগ্য কথা নয়।

এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বাংলাদেশে ধনী মানুষের সংখ্যা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। মানুষের আয় বৃদ্ধি পেয়েছে। রাস্তায় নতুন নতুন মডেলের গাড়ি, শপিং মলের সংখ্যা, নতুন নতুন মডেলের ফ্ল্যাট বাড়ির সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে; কিন্তু যে হারে এসব বাড়ছে, সে তুলনায় করদাতার সংখ্যা বাড়ছে না।

বিশ্বব্যাংক ও প্রাইসওয়াটারহাউসকুপারসের (পিডব্লিউসির) ‘পেয়িং ট্যাক্স-২০১৭’-এর এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, সার্বিকভাবে করবান্ধব বা কর প্রদান সূচকে ১৮৯টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৫১তম। প্রতিবেদনে কোন দেশে গড় কর হার কত, কত সময় লাগে, কত ধরনের কর দিতে হয়- এসব বিষয়ের চিত্র উঠে এসেছে।প্রতিবেদনে বলা হয়েছে বাংলাদেশে একটি কোম্পানি করদাতাকে সব মিলিয়ে গড়ে ৩৪.৪ শতাংশ কর দিতে হয়। এর মধ্যে মুনাফা কর বা কর্পোরেট করের হার গড়ে সাড়ে ৩০ শতাংশ।

২০২১ সালে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালন করবে বাংলাদেশ। ২০২০ সালে বাংলাদেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক সূচকগুলো কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, তা সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় উল্লেখ করা হয়েছে। এখানে দেখানো হয়েছে দারিদ্র্য হার ২৪ দশমিক ৮ থেকে ১৮ দশমিক ৬ শতাংশে নেমে আসবে। ২০২০ সালে দেশের মোট জনসংখ্যার ২০ শতাংশ উচ্চশিক্ষিত হবে।

পাঁচ বছরে ১ কোটি ২৯ লাখ লোকের কর্মসংস্থান হবে ইত্যাদি। কিন্তু বাস্তবে যত পরিকল্পনা, যত রকম উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ কিংবা বাজেট বরাদ্দ করা হোক না কেন, আমাদের রাজস্ব আয় বৃদ্ধি করা না গেলে কোনো উন্নয়ন বা কোনো লক্ষ্যমাত্রাই যথাযথভাবে অর্জিত হবে না। এ জন্য সর্বাগ্রে সরকারকে রাজস্ব আয় বৃদ্ধির ওপর জোর দিতে হবে।

জনগণের মাঝে কর সচেতনতা বৃদ্ধি, দেশে কর শিক্ষা সম্প্রসারণ ও জনগণকে কর প্রদানের জন্য উৎসাহিত করে দেশের রাজস্ব আহরণ বৃদ্ধি করা যেতে পারে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বাংলাদেশের তিনটি খাতের সংস্কারের ওপর প্রাধান্য দিয়েছে। প্রথমত, ব্যাংক খাতের ক্রমাগত দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠা, সামাজিক চাহিদা, অবকাঠামো ও জলবায়ু পরিবর্তনে ঝুঁকিগ্রস্তদের গুরুত্ব দেয়া।

আইএমএফ ঘাটতি বাজেট পূরণে রাজস্ব সংগ্রহ বাড়ানোর তাগিদ দিয়েছে। নতুন ভ্যাট আইন কার্যকর করাকে স্বাগত জানালেও ভ্যাট হার সহজ করার ওপর গুরুত্বারোপ করেছে সংস্থাটি।নতুন নতুন করদাতার সন্ধানে ও জনগণের মাঝে কর সচেতনতা বৃদ্ধি এবং আয়কর সংগ্রহের বিষয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে সহযোগিতা করার জন্য বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর সাহায্য-সহযোগিতা গ্রহণ করা একান্ত প্রয়োজন।

দেশে বিদ্যুৎ, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, যোগাযোগ ইত্যাদি খাতে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের যৌথ প্রচেষ্টার মাধ্যমে উল্লেখযোগ্য অর্জন সম্ভব হয়েছে। তেমনিভাবে রাজস্ব আয় বৃদ্ধি এবং রাজস্ব আহরণের জন্য দেশে নিবন্ধিত বেসরকারি অলাভজনক প্রতিষ্ঠানগুলোকে এ ব্যাপারে কাজ করার জন্য সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে এগিয়ে আনতে হবে।

দেশে বেসরকারিভাবে নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠান ‘দ্য ফাউন্ডেশন অব চার্টার্ড ট্যাক্সেশন অব বাংলাদেশ’ (এফসিটিবি)-এর মতো যেসব প্রতিষ্ঠান রয়েছে, সেসব প্রতিষ্ঠানকে সরকার প্রণোদনা প্রদান করে কাজে লাগাতে পারে। জনগণের মাঝে কর সচেতনতা বৃদ্ধি, দেশে কর শিক্ষা সম্প্রসারণ ও দেশের রাজস্ব আহরণ বৃদ্ধি করার জন্য যুগোপযোগী ও বাস্তব জ্ঞানভিত্তিক গবেষণা ও কর সচেতনতা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে এফসিটিবি।

সরকারের সহযোগিতা পেলে এ প্রতিষ্ঠানটি জনগণের মাঝে কর সচেতনতা বৃদ্ধি, গবেষণা কার্যক্রমসহ দেশের প্রত্যন্ত এলাকায় রাজস্ব কার্যক্রম গ্রহণ ও আহরণে নতুন নতুন করদাতা সন্ধান করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে সার্বিকভাবে সহযোগিতা করতে পারে।জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কর প্রদানের নির্দেশিকা বা কর আইন সম্পর্কে জনগণকে অবহিত করা এবং এ আইন মানা না হলে আইনগত কী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হতে পারে, কারা কর প্রদানে উপযুক্ত সে সম্পর্কে ব্যাপক প্রচার ও প্রচারণা চালাতে হবে।

সরকারের নির্দেশনা পেলে স্থানীয় প্রশাসন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়াগুলো এ ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের বর্তমান জনবল, লজিস্টিক সাপোর্ট, কৌশল ইত্যাদির মাধ্যমে রাজস্ব আয় বৃদ্ধির জন্য সরকারের লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী আরও ৮০ লাখ নতুন করদাতাকে করজালের আওতায় আনা কঠিন হবে।এতে করে ঘাটতি বাজেটের বোঝা নিয়েই সরকারকে প্রতিবছর বাজেট ঘোষণা করতে হবে। তাই সরকার আয়কর বৃদ্ধির লক্ষ্যে উল্লিখিত কৌশল ও সুপারিশগুলো ভেবে দেখতে পারে।

বাংলানিউজসিএ/ঢাকা/ ১৮ নভেম্বর ২০১৯ /এমএম


Array