বাংলানিউজসিএ ডেস্ক :: অযোধ্যায় বাবরি মসজিদ-রাম মন্দির বিতর্কের ১৩৪ বছরের আইনি লড়াইয়ের অবসান হল শেষ পর্যন্ত। মহাকাব্যে বর্ণিত রাম জন্মভূমিতে আনুমানিক ১৫২৮ সালে মুঘল সম্রাট বাবরের আদেশে তার সেনাপতি মীর বাকী এ মসজিদ নির্মাণ করেন।
কিন্তু মুঘল যুগ শেষে ব্রিটিশরা ক্ষমতায় আসতেই আইনি লড়াই শুরু হয়ে যায় ফৈজাবাদের আদালতে, সম্প্রতি ভারতের সুপ্রিমকোর্টের রায়ের মাধ্যমে যার পরিসমাপ্তি ঘটে। তবে সুপ্রিমকোর্টের পর্যবেক্ষণে কিছু বিষয়ে স্ববিরোধিতা রয়েছে।হিন্দুরা বিশ্বাস করেন এখানেই রামের জন্মভূমি ছিল। আর আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার খননে যেসব জিনিসপত্র পাওয়া গেছে তাতে স্পষ্ট, সেগুলো নন-ইসলামিক। তবে সেগুলো মন্দিরের অংশ কিনা সেটা তারা নিশ্চিত করতে পারেনি।
ফাঁকা জায়গায় যেমন মসজিদ তৈরি হয়নি, তেমনি সেটা যে মন্দিরই ছিল তা-ও নিশ্চিত নয়। সুন্নি ওয়াকফ বোর্ডের দাবি খারিজ করে দিয়ে শীর্ষ আদালত বলেছেন, ‘শুধু বিশ্বাসের ভিত্তিতে কোনো অধিকার দাবি করা যায় না।জমির মালিকানা আইনি ভিত্তিতেই ঠিক করা উচিত।’ কোর্ট এটাও বলেছেন, ‘কারও বিশ্বাস যেন অন্যের অধিকার হরণ না করে।’ রায়ের এ অংশগুলো স্ববিরোধী। কারণ কোন্ স্থাপনার ওপর বাবরি মসজিদ নির্মিত হয়েছে, তার অকাট্য প্রমাণ ছাড়াই শুধু আংশিক বিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করে আদালত বিতর্কিত স্থানে মন্দির নির্মাণের পক্ষে রায় দেন।
আবার অধিকার হরণ না করার বিষয়েও কোর্ট নিশ্চয়তা দিতে পারেননি। অথচ এ ভূমিতে উন্নততর মানবকল্যাণে কোনো স্থাপনা স্থাপনই সুবিবেচনাপ্রসূত হতো।শতাব্দীরও অধিককাল থেকে মানুষে মানুষে সংঘাত-বিদ্বেষ, দাঙ্গা, হত্যাকাণ্ডের মতো ঘটনাগুলো ঘটেই চলেছে কিছুটা সত্য, কিছুটা অস্পষ্ট আর কিছুটা মিথের ওপর ভিত্তি করেই এবং তা ঘটেছে ধর্মের মতো অতি সংবেদনশীল বিষয়কে কেন্দ্র করে, কুটিল রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির জন্য। চতুর রাজনীতিকরা এমন একটি সুবিধাজনক বিষয়কে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে জিইয়ে রেখেছে শতাব্দীর পর শতাব্দী।
ধর্মের সাধনা অন্তরের গভীরেই থাকা উচিত। উন্নত রাষ্ট্রে ধর্মের প্রভাব একেবারেই গৌণ। ধর্ম যদি রাষ্ট্র পরিচালনায় নিয়ামক হিসেবে কাজ করে, তাহলে সেই রাষ্ট্র আর সুসভ্য থাকে না। সুপ্রিমকোর্টের রায়ের পর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছেন, ‘এই রায়কে কারও জয় বা পরাজয় হিসেবে দেখা উচিত নয়, আমাদের সবার ভারতভক্তির চেতনাকে শক্তিশালী করা উচিত।’দেশবাসীর কাছে শান্তি, সম্প্রীতি ও ঐক্য বজায় রাখার আহ্বানও জানিয়েছেন তিনি। কিন্তু রায়টি মোদিবাবুর ইচ্ছের বিরুদ্ধে গেলে নিশ্চয়ই তার অভিব্যক্তি এমন হতো না। কারণ অযোধ্যা বিতর্কে নরেন্দ্র মোদির গায়ে আছে সাম্প্রদায়িকতার দুর্গন্ধ, হাতে আছে সহিংসতায় নিহত হাজার হাজার মানুষের রক্তের দাগ। ভিন্ন রকমের রায় হলে মোদিবাবুর সেই পুরনো কদর্য রূপটিই বেরিয়ে আসত হয়তোবা।
অযোধ্যাকেন্দ্রিক সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পে আক্রান্ত হয়েছে এ পর্যন্ত অসংখ্য মানুষ। উন্নত সংস্কৃতির বিকাশে, আধুনিক সমাজ বিনির্মাণে এসবের আদৌ কোনো ভূমিকা নেই। অথচ মসজিদ-মন্দির বিতর্ক পেছনে ফেলে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, জলবায়ু পরিবর্তন, চিকিৎসা বিজ্ঞানের নব নব আবিষ্কারের মাধ্যমে মানুষের প্রাণ বাঁচানোর মতো বিষয়গুলো এখন বড় চ্যালেঞ্জ।যে ভারত জন্ম দিয়েছে কল্পনা চাওলা, সুনীতা উইলিয়ামসের মতো মানুষকে, সেই ভারতই জন্ম দিয়েছে অমিত শাহ, যোগী আদিত্যনাথ, মোহন ভগবতের মতো মানুষদেরও। যতদিন এমন মানুষ রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রক থাকবে, ততদিন অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র কাঠামোর ভাবনা বিকশিত হবে না।
খানিকটা স্বস্তির বিষয়, এ রায়ের কারণে মানুষের উগ্রতা প্রকাশ পায়নি। পাঁচশ’ বছরের পুরনো এ বিতর্কের প্রভাব মানুষের ব্যক্তি জীবনে একেবারেই গৌণ। শিক্ষা, রুচি ও সংস্কৃতির বাস্তব অভিব্যক্তি ঘটে মানুষের আচরণে।এ আচরণ মানুষকে ধর্মনিরপেক্ষ অসাম্প্রদায়িক কল্যাণকর সহাবস্থান তৈরিতে সহায়তা করে। আর এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না, ধর্মনিরপেক্ষ অসাম্প্রদায়িক চেতনাই একটি আধুনিক রাষ্ট্রের উন্নতির সোপান।মসজিদ-মন্দির-গির্জা-প্যাগোডা যার যার অন্তরে থাকুক, অন্ধকার ভেদ করে আলোকিত হোক মানবাত্মা, গভীর মায়ার বন্ধনে আবদ্ধ হোক পৃথিবীর সব মানুষ।
বাংলানিউজসিএ/ঢাকা/ ১২ নভেম্বর ২০১৯ /এমএম