বাংলানিউজসিএ ডেস্ক :: এই মহাবিশ্বে পৃথিবী একমাত্র গ্রহ, যেখানে প্রাণের বিন্যাস দেখা যায়। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন অনেক ঘটনা ঘটেছে, যার ফলে অনেক প্রাণী বিলুপ্ত হয়েছে। আমরা ডাইনোসর যুগের ঘটনাগুলো জানি।
আমরা দেখেছি, কালের বিবর্তনে বিভিন্ন প্রজাতির ডাইনোসর কিভাবে অস্তিত্ব হারাল। পরবর্তী সময়ে আমরা পৃথিবীতে মানবজাতির অস্তিত্ব দেখতে পাই। সমস্ত প্রাণিকুলের মধ্যে মানুষজাতি সবচেয়ে বুদ্ধিমান; এর কারণ হল, মানুষ তার বুদ্ধি এবং চিন্তাশক্তিকে কাজে লাগিয়ে যে কোনো সমস্যা সমাধান করার ক্ষমতা রাখে।
যে মানবজাতি একসময় পাহাড়ের গুহায় বসবাস করত, সেই মানবজাতি এখন শততলা ভবন নির্মাণ করে তাতে বসবাস করছে। যে মানুষজাতির আগুন আবিষ্কার করতে কয়েকশ’ বছরের প্রয়োজন হয়েছিল, আজ তারা খুব অল্প সময়ে মরণাস্ত্র উদ্ভাবন করছে; একইসঙ্গে চাঁদ-মঙ্গলসহ অন্যান্য গ্রহে মানুষ পাঠিয়ে বিভিন্ন অনুসন্ধানধর্মী কাজ করে যাচ্ছে।
এখন মানুষকে আর বনে বনে ফলমূল খুঁজে অথবা পশুপাখি শিকার করে খাবার জোগাড় করতে হয় না। মানুষ প্রযুক্তির উন্নয়ন ঘটিয়ে অথবা প্রযুক্তির ব্যবহার করে নিজেদের চাহিদা মিটিয়েছে; পাশাপাশি অনেক সমস্যার সমাধানও করতে পারছে।
মানুষ সভ্যতা ও জীবনমান উন্নয়ন এবং চাহিদা মেটানোর জন্য প্রচুর পরিমাণে কারখানা স্থাপন এবং বন উজাড় করে বসতি স্থাপনের মাধ্যমে পৃথিবীর পরিবেশের যে অপূরণীয় ক্ষতি করেছে, সেসব ক্ষতি হতে পারে মানুষের অস্তিত্ব সংকটের অন্যতম কারণ। গ্লোবাল ওয়ার্মিং পৃথিবীর অন্যতম প্রধান সমস্যা। বর্তমান পৃথিবীতে প্রায় ২৩০টি দেশ রয়েছে এবং এসব দেশ অর্থনৈতিক উন্নয়ন করতে গিয়ে প্রচুর পরিমাণে কারখানা স্থাপন করেছে। কারখানাগুলো থেকে নির্গত বিষাক্ত গ্যাস, রাসায়নিক দ্রব্য ও অধিকমাত্রায় জ্বালানি পোড়ানোর ফল স্বরূপ পৃথিবীর তাপমাত্রা ক্রমশ বেড়েই চলছে এবং জলবায়ুর পরিবর্তন হচ্ছে।
আমরা বিশ্ব উষ্ণায়ন বা গ্লোবাল ওয়ার্মিং সমস্যার পেছনের কারণগুলো আরও বিস্তারিত জানার চেষ্টা করব। কারণগুলো জানার পূর্বে আমাদের জানতে হবে, বিশ্ব উষ্ণায়ন বা গ্লোবাল ওয়ার্মিং ধারণা আসার প্রেক্ষাপট সম্পর্কে।
সহজে বুঝতে গেলে আমরা দেখি বন উজাড়, কারখানা বা যানবাহন হতে নির্গত বিষাক্ত গ্যাস পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা ক্রমাগত বৃদ্ধি করে চলছে। বিগত ৮০০ বছর ধরে এই তাপমাত্রা প্রায় স্থির ছিল। কিন্তু গত ১০০ বছরের হিসাবে প্রমাণিত যে, এই তাপমাত্রা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
গবেষণা করে দেখা গেছে, বিগত ১০০ বছরে পৃথিবীর তাপমাত্রা ০.৫০ঈ বৃদ্ধি পেয়েছে। বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন, ২০৫০ সালের মধ্যে পৃথিবী পৃষ্ঠের তাপমাত্রা ১.৫০-২.০০ঈ পর্যন্ত এবং ২১০০ সালের মধ্যে ১.৮০ঈ থেকে ৬.৩০ঈ-এর মতো বৃদ্ধি পেতে পারে।
সারা পৃথিবীজুড়ে উষ্ণতার এই ক্রমবর্ধমান বৃদ্ধিকেই বিজ্ঞানীরা বিশ্ব উষ্ণায়ন বা গ্লোবাল ওয়ার্মিং নামে অভিহিত করেছেন। গ্লোবাল ওয়ার্মিং-এর কারণগুলোর মধ্যে প্রথমেই আমরা যে কারণটি খুঁজে পাই তা হল, জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বৃদ্ধি। সভ্যতা গড়তে বা আধুনিক বিশ্বে টিকে থাকতে প্রয়োজন শক্তি। কল-কারখানা, যানবাহন, বিদ্যুৎ উৎপাদন সবকিছুতেই ব্যবহার করা হয় জীবাশ্ম জ্বালানি। জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহারের ফলে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের নির্গমনের পরিমাণ ও আনুপাতিক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
দিন শেষে এই কার্বন-ডাই-অক্সাইডকে আমাদের পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধির অন্যতম কারণ হিসেবে দেখা হয়। এর পরেই যে কারণটিকে দায়ী করা হয়, তা হল- ক্লোরোফ্লোরোকার্বনের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার। ক্লোরোফ্লোরোকার্বন (CFC11,CFC12) বা ফ্রেয়ন একটি বিশেষ যৌগ, যা ওজোন স্তর বিনাশের জন্য বিশেষভাবে দায়ী। উক্ত ঈঋঈ প্রধানত ফোম শিল্প, রং শিল্প, প্লাষ্টিক শিল্প, রেফ্রিজারেটর, এয়ারকন্ডিশনার, সুগন্ধি শিল্প, কম্পিউটার ও অন্যান্য যন্ত্রের সার্কিট পরিষ্কার প্রভৃতি থেকে নির্গত হয়। যার ফল হিসেবে ওজোন স্তর ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে সূর্যের অতি বেগুনি রশ্মি সরাসরি পৃথিবীতে প্রবেশ করে পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের চর্মরোগসহ মরণব্যাধি ক্যান্সারের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এছাড়া কৃষিক্ষেত্রে রাসায়নিক সারের ব্যবহার, ট্যানারি শিল্প-কারখানার বর্জ্য, অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র প্রভৃতি থেকে নাইট্রাস অক্সাইড, নাইট্রোজেন, অক্সাইড এবং সালফারের কণা পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধির ক্ষেত্রেও অনুকূল ভূমিকা পালন করছে। পাশাপাশি বাসস্থানের চাহিদা মেটানোর জন্য অথবা নগরায়নে যে প্রচুর গাছপালা উজাড় করা হচ্ছে, এর ফলে বায়ুমণ্ডলের কার্বন-ডাই-অক্সাইড শুষে নেয়ার ক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে। ফলে ক্রমেই উষ্ণতা বেড়ে চলেছে। বিশ্ব উষ্ণায়ন বা গ্লোবাল ওয়ার্মিং-এর প্রভাব পৃথিবী ধ্বংসের অন্যতম কারণ হয়ে দাড়িয়েছে। আমরা পৃথিবীতে বিশ্ব উষ্ণায়নের প্রভাব দেখতে শুরু করেছি।
নাসার গোদার্দ ইন্সটিটিউট ফর স্পেস গবেষণার হিসাব অনুযায়ী, ২০০৫ সাল ছিল পৃথিবীর ইতিহাসের উষ্ণতম বছর। কিন্তু ওয়ার্ল্ড মিটিয়েরোলজিক্যাল ইন্সটিটিউট ও ক্লাইমেট রিসার্চ ইন্সটিটিউটের মতে, উষ্ণতম বছর হল ১৯৯৮ সাল এবং দ্বিতীয় উষ্ণতম বছর হল ২০০৫ সাল। এভাবে তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে বিষুবীয় ও মেরু অঞ্চলের তাপমাত্রা দ্রুত বাড়ছে।
বর্তমানে মেরু অঞ্চলের বরফ গলতে শুরু করেছে। ধারণা করা হয়, আর ১০০ বছরের মধ্যে হিমশৈলসহ সুমেরু-কুমেরুতে জমে থাকা সমস্ত বরফ পানিতে পরিণত হবে; যার ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ৩০-৪০ সেন্টিমিটার বেড়ে যাবে। এর ফলে পৃথিবীর উপকূলবর্তী এলাকার একটি বিরাট অংশ সমুদ্রের নিচে তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
ভয়ানক তথ্য হচ্ছে, পৃথিবীর সঞ্চিত সমস্ত বরফ গলে গেলে সমুদ্রপৃষ্ঠের প্রায় ৫০ মিটার বেড়ে যাবে, যা পৃথিবীর সব মানব সভ্যতাকে ধ্বংস করতে যথেষ্ট। বরফ গলার সঙ্গে সঙ্গে সমুদ্রে ক্ষারের পরিমাণ কমবে; ফলে ক্ষারে বেঁচে থাকা জীবের অস্তিত্ব লোপ পেয়ে বাস্তুতন্ত্রের বিনাশ ঘটবে। প্রবাল প্রাচীর ধ্বংসসহ জীববৈচিত্র্যের বিনাশ ঘটবে। উষ্ণতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে অধোক্ষেপণের পরিমাণ ও ঝড়ঝঞ্ঝার প্রকোপ বৃদ্ধি পাবে।
এছাড়া যে কোনো ধরনের ফসল উৎপাদনের পরিমাণ হ্রাস পাবে গ্লোবাল ওয়ার্মিং-এর প্রভাবে। একটা সময় পর পৃথিবীতে দুর্ভিক্ষ, মহামারী, খরা ও বন্যার পরিমাণ বৃদ্ধিসহ সামাজিক-অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক সমস্যা প্রকট থেকে প্রকটতর হবে।
বিজ্ঞানীরা এবং বিশ্ব নেতারা বিশ্ব উষ্ণায়ন সমস্যা দূর করার চেষ্টা করছেন। উন্নত বিশ্বের অবহেলা রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক স্বার্থের কারণে এ সমস্যার সঠিক ও কার্যকর সমাধান হচ্ছে না। যেহেতু মানবজাতির কয়েকশ’ বছরের কাজের ফসল এই গ্লোবাল ওয়ার্মিং; তাই এর সমাধানও সহজে এবং অল্প সময়ের মধ্যে আসার সুযোগ নেই। এজন্য প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি ও কার্যকর পকিল্পনা।
এ পরিকল্পনার অংশ হিসেবে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার হ্রাস করতে হবে; যাতে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের নির্গমনের পরিমাণ যথাসম্ভব কমানো যায়। জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহারে গ্রিন হাউস গ্যাসের পরিমাণ ক্রমাগত বাড়ছে, যার ফলে পরিবেশের ক্ষতি বেশি হচ্ছে। প্রচলিত জীবাশ্ম জ্বালানির পরিবর্তে বিকল্প জ্বালানি ব্যবহার করলে বায়ুমণ্ডলে কার্বন-ডাই-অক্সাইড, নাইট্রাস অক্সাইড ও মিথেনের পরিমাণ কমে আসবে; ফলে পরিবেশের দূষণও অনেকটাই কমে আসবে।
বিকল্প জ্বালানি হিসেবে সৌরশক্তি, বায়ুশক্তি, জলবিদ্যুৎ, বায়োগ্যাস, বায়োডিজেল, জোয়ারভাটা শক্তি, ভূ-তাপীয় শক্তি, নিউক্লিয়ার এনার্জি প্রভৃতি জীবাশ্ম জ্বালানির উপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে আনতে পারে। পাশাপাশি পরিকল্পিত বনায়ন বিশ্ব উষ্ণায়ন বা গ্লোবাল ওয়ার্মিং সমস্যার সমাধানে প্রতিষেধকের মতো কাজ করবে। একইসঙ্গে তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ব্যবহৃত উপাদান পরিবর্তন ও কার্বন-ডাই-অক্সাইড পৃথকীকরণ প্রযুক্তি উদ্ভাবনের মাধ্যমে দূষণের মাত্রা কমিয়ে আনা সম্ভব।
বিশ্বের দেশগুলোর মধ্যে ক্রমবর্ধমান বিশ্ব উষ্ণায়ন বা গ্লোবাল ওয়ার্মিং নিয়ে চুক্তিগুলোর দ্রুত বাস্তব রূপায়ণ দরকার। এ বিষয়ে শুধু আলোচনার মধ্যে ঘুরপাক না খেয়ে ইতিমধ্যে গৃহীত সিদ্ধান্তগুলোর দ্রুত বাস্তবায়নও প্রয়োজন।
পরিবেশ রক্ষার ক্ষেত্রে বিশ্ব উষ্ণায়ন বা গ্লোবাল ওয়ার্মিং সৃষ্টিকারী উপাদানগুলো যাতে পরিবেশে কম পরিমাণে ছড়ায়, এ বিষয়ে পৃথিবীর প্রতিটি দেশের সাধারণ নাগরিকরা সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারেন। পরিবেশ রক্ষা বা বিশ্ব উষ্ণায়ন রোধ করে পৃথিবীকে ধ্বংসের মুখ থেকে ফিরিয়ে আনতে ধর্ম, বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। আর তাহলে আমরা পারব ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সুন্দর সবুজ একটি পৃথিবী রেখে যেতে।
বাংলানিউজসিএ/ঢাকা/ ০৬ নভেম্বর ২০১৯ /এমএম