বাংলানিউজসিএ ডেস্ক :: ভালোবাসা আর স্নেহের পরশে অনেক শিক্ষক-শিক্ষিকার ক্লাসে উপস্থিত থাকলেও ভয়ে ক্লাসে উপস্থিত থাকতাম মাত্র কয়েকজন শিক্ষকের জন্য।একজন কুলাউড়ার নবীন চন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়ের হামিদ স্যার, অপরজন মুরারী চাঁদ কলেজের ধীরেশ স্যার আর সর্বশেষ হলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক ডিপার্টমেন্টের ডা. মিজান স্যার।
মাঝেমধ্যে মনে হয় গুরুদের এ ভালোবাসা, স্নেহ আর ভয় শিক্ষাজীবনে প্রয়োজন ছিল। না হলে হয়তো এতদূর আসা হতো না। যাঁরা শিক্ষা গুরুদের ভালোবাসা আর শাসন পায় না বা অবজ্ঞা করে তারা বেশি দূর এগুতে পারে না। শিক্ষাই একসময় তাদের ছেড়ে চলে যায়।
এক.
স্কুলের হামিদ স্যারকে ভয় পেতাম কারন স্যার কথা বলতেন কম, হাসতেন না। স্যারকে আমরা খুব কম হাসতে দেখেছি। যেদিন স্যার
হাসতেন সেদিন মনে হতো পুরো স্কুলটি হা হা করে হাসছে। স্যারকে পুরো স্কুল ভয় করতো।
হামিদ স্যার পড়াতেন ক্লাস নাইনের ভূগোল। স্যারের ভয়ে শুধু ছাত্র নয় পুরো স্কুল যেনো প্রতিদিন পুরো ‘আলিফ’ এর মতো সোজা থাকতো।
একদিন স্যার ভূগোলের ‘চাপবলয়’ ভালো করে পড়িয়ে দিয়ে বললেন, “কাল সবাই পড়ে আসবা, আমি পড়া ধরবো, আর না আসলে কী হবে
জানি না”
পরদিন স্যার ঠিক ঘড়ির কাঁটায় কাঁটায় ক্লাসে হাজির। হাতে ভূগোল বই। স্যারের হাতে সেদিন কোন বেত ছিল না, কখনো থাকতোও না।
তবুও সেদিন সবাই ভয়ে অস্থির।
স্যার বললেন, ‘পড়ে আসছো? পড়া ধরবো। যারা যারা পড়া দেবে তারা বসে থাকো আর যারা দেবে না তারা সবাই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চিল্লায়
চিল্লায় ‘চাপবলয়’ মুখস্থ করতে থাকো..’
পড়ে আসলেও সেদিন সবাই ভয়ে স্যারের সে সুযোগের সদ্ব্যবহার করলো। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ‘চাপবলয়’ জপতে থাকলো।
আমি কী করবো বুঝতে পারছি না। আমি তো পড়ে আসছি। ভালো করেই পড়ে আসছিলাম। ইতোস্তত হয়ে পাশের জনকে জিজ্ঞাস করলাম,
‘আমিতো পারি, পড়ে আসছি, কী করবো’?
সে চমকে বললো, ‘চুপচাপ দাঁড়ায়া যা, স্যার এখনো খেয়াল করেননি, তুই বসা। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পড়া জপ”।
আমি দাঁড়ালাম না। বসে রইলাম দুরু দুরু বুকে। ক্লাসে সম্ভবত একমাত্র আমিই চুপচাপ বসা। হাত-পা কাঁপছে তবুও বসে আছি, সামান্য
সাহস নিয়ে।
দূর থেকে দেখে স্যার মুচকি হেসে ঈশারায় ডাকলেন, ‘আসো’। এ যেনো সিংহের ডাক, সামনে খরগোশ। আমি ভয়ে থরো থরো।
আমার এমন কান্ডে সবাই পড়া বন্ধ করে দিয়েছে। স্যার আস্তে করে বললেন, ‘এই, পড়া বন্ধ ক্যান’। আবার হাউমাউ চিৎকারে করে সবাই
‘চাপবলয়’ জপতে থাকলো।
স্যার বললেন, “পড়ে আসছিস?”। বললাম ‘জ্বী স্যার’।
স্যার বললেন, ‘সাহসতো কম না’।
আমার কাঁপাকাঁপি আরো বেড়ে গেল। তারপরও সমস্ত শক্তি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকার চেষ্টা করলাম। আমি ছিলাম কনফিডেন্ট।
স্যার কী একটা প্রশ্ন করলেন। আমি দুরুদুর বুকে উত্তর অর্ধেক বলে আর বলতে পারলাম না, খেই হারিয়ে ফেললাম।
স্যার বললেন, ‘মাত্র একটা, যাও বসো গিয়ে’।
সেদিনের একা বসে থাকার মুহূর্ত আজও ভুলতে পারিনি। মনে হয় পারবো না কোনদিন।
দুই.
কলেজে ধীরেশ স্যারকে আমি বা আমরা কোনদিন হাসতে দেখিনি। প্রচণ্ড ভয় পেতাম সবাই। সেটা সেই ক্লাসের প্রথম দিন থেকেই। আমার
একেবারে প্রথম দিনের স্যারের ক্লাসে স্যারের ‘ব্যাঘ্র গর্জন’ আজো কানে বাজে।
ক্লাসে ফিসফিস করায় কোন এক সহপাঠীকে পেছনের বেঞ্চ থেকে ডায়েসে ডেকে নিয়ে চিৎকার করে বললেন, ‘কাল যদি তোমার চুল লম্বা
দেখি তাহলে কেয়ামত হয়ে যাবে। আমার ক্লাসে সাইড টক বন্ধ আর ক্লাসের সবার চুল থাকবে ছোট, শার্টের বোতাম থাকবে লাগানো,
ওকে…?”
ক্লাসে পিনপতন নিরবতা….!
তারপর থেকে অসুস্থ হলেও স্যারের ক্লাসে সবাই সুস্থ, সুবোধ বালকের মতো- উপস্থিত, ‘প্রেজেন্ট স্যার’।
উচ্চমাধ্যমিকে আমাদের গণিতে প্রথম হাতেখড়ি ধীরেস স্যারের নিয়মিত ক্লাসের মধ্যে দিয়েই। স্যারের ক্লাস নিয়মিত করেছি তাই গণিতে
ধীরেস স্যারের কাছে আমাদের কয়েকজনের প্রাইভেট পড়তে হয়নি।
স্যার প্রথমদিন আরেকটি কথা বলেছিলেন, “আমার ক্লাসে উপস্থিত থাকলে কাউকে প্রাইভেট পড়তে হবে না, আর আমিও প্রাইভেট পড়ানো
পছন্দ করি না”।
ধীরেস স্যারের মৃত্যু সংবাদ শুনে স্যারের কথাগুলো খুব মনে পড়লো। শেষদিকে স্যার এম. সি কলেজ সিলেটের প্রিন্সিপাল ও ছিলেন।
সেই তিনজন মহান শিক্ষক আজ দূর আকাশের তারা। তাদের ভালোবাসা স্নেহ মমতা শাসন না থাকলে আমরা হয়তো এতদূর আসতে
পারতাম না।
বাংলানিউজসিএ/ঢাকা/ ০৪ নভেম্বর ২০১৯ /এমএম