বাংলানিউজসিএ ডেস্ক :: বিচারহীনতার সংস্কৃতির বিপরীত একটা আবহ ফেনীর নুসরাত হত্যার রায়ে। মাস ছয়েকের মধ্যে এ হত্যার রায় হয়েছে। স্বাভাবিক বোধ-বুদ্ধির অনেকেই বলছেন, বিচারকাজ এমনই হওয়া উচিত। ‘এমনই’ বলতে তারা ‘অল্প সময়কে’ বুঝিয়েছেন। নানা সমালোচনা ও অসন্তুষ্টির পরও এটা বিচার বিভাগের জন্য বিরাট সার্থকতা। একটা মাইলফলক। রাষ্ট্র চাইলে স্বল্প সময়ে যে কোনো জটিল মামলার বিচার কাজ শেষ করতে বিচার বিভাগকে সহায়তা করতে পারে। নুসরাতের মামলা তার প্রমাণ। কিন্তু রাষ্ট্র কেন সবক্ষেত্রে সেটা চায় না- প্রশ্নটা সেখানেই।
সব বিচারকাজ বিশেষ করে খুনের মামলাগুলোর রায় এভাবে ত্বরিতগতিতে দেখার একটি অভিপ্রায়ই এখানে মূল কথা। কুমিল্লার তনু, চট্টগ্রামের মিতু, নারায়ণগঞ্জের ত্বকী, বরগুনার রিফাত হত্যা মামলার ক্ষেত্রে এখন পর্যন্ত উল্টা চিত্র। সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের বিচারও ঝুলছে বছরের পর বছর। চার্জশিটও তৈরি হয়নি এখনো।
নির্জলা সত্য হচ্ছে, দায়িত্বশীল মহল আন্তরিক হলে দ্রুত বিচার পাওয়া সম্ভব এটিই হলো বাস্তবতা। কোনো কোনো ঘটনা মানুষের আস্থায় একটু নাড়া দেয়। আশাবাদী করে। সমাজের প্রতি, জীবনের প্রতি সর্বোপরি নিজের প্রতি শ্রদ্ধাবোধকে ফিরে আসবে বলে আশা জাগায়। নুসরাত হত্যার রায়ও সেই ধরনের একটি ঘটনা। স্বল্পতম সময়ে বিচার সম্পন্ন এবং সব অপরাধীকে একই দণ্ড দেয়া ব্যতিক্রমী ঘটনা।
ক’দিন আগে বুয়েটে ছাত্রলীগের পিটিয়ে হত্যা করা আবরারের খুনিদের বিচারের আশা জাগতেও বাধা থাকার কথা নয়।অনেকেই মনে করছে, ফেনীর নুসরাত হত্যার অপরাধীরাও যথেষ্ট প্রভাবশালী, নানা ধরনের সামাজিক প্রভাব এই মামলায় ছিল। তা সত্ত্বেও অপরাধীদের সর্বোচ্চ সাজা হয়েছে। তনু, মিতু, ত্বকী, রিফাত, সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের বিচারও তাই সম্ভব। একইসঙ্গে সেটা নির্ভর করে অনেক যদি, তবে কিন্তুর ওপর। মোটকথা সরকারের ওপর।
নুসরাত হত্যার ঘটনায় বাড়তি কয়েকটি দিক আছে। পুলিশ প্রশাসনের ভূমিকা ছিল খুনিদের পক্ষে। পুলিশের যে গাফিলতি নিয়ে আদালত পর্যবেক্ষণ দিয়েছে তার নিষ্পত্তি হওয়া উচিত। স্থানীয় কোনো কোনো সাংবাদিক খুনিদের পক্ষ নিয়ে ঘটনাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার অপচেষ্টা করেছিলেন- এমন অভিযোগও এসেছে গণমাধ্যমে। নুসরাত হত্যার রায় ঘোষিত হওয়ার পর এরও আগের সাগর-রুনি, তনু, মিতু, ত্বকি, রিফাত, আবরারসহ সব আলোচিত হত্যার বিচার নিয়ে মানুষের স্বপ্ন দেখার মধ্যে একটা বিশেষত্ব অবশ্যই রয়েছে।
নুসরাতের ঘটনাটি সবার জানা, গত ২৭ মার্চ সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল (ডিগ্রি) মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজউদ্দৌলা নিজ রুমে ডেকে নিয়ে নুসরাতের সঙ্গে অসৌজন্যমুলক আচরন করেন। অসম্মানজনক প্রস্তাব দেন। এ ঘটনায় নুসরাতের মা শিরিনা আক্তার বাদী হয়ে সোনাগাজী থানায় মামলা করলে অধ্যক্ষকে গ্রেফতার করে পুলিশ।
মামলা তুলে না নেয়ায় ৬ এপ্রিল মাদ্রাসার প্রশাসনিক ভবনের ছাদে ডেকে নিয়ে নুসরাতের হাত-পা বেঁধে গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন লাগিয়ে দেয় বোরকা পরা পাঁচ দুর্বৃত্ত। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১০ এপ্রিল নুসরাতের মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় নুসরাতের বড় ভাই মাহমুদুল হাসান ওরফে নোমান বাদী হয়ে সোনাগাজী থানায় মামলা করেন। পরে মামলাটি হত্যা মামলায় রূপান্তরিত হয়। পরে এই মামলা তদন্ত করে পিবিআই।
গত ২৮ মে পিবিআই তদন্ত শেষে মাদ্রাসার অধ্যক্ষসহ ১৬ জনের বিরুদ্ধে আদালতে ৮৬৯ পৃষ্ঠার অভিযোগপত্র দাখিল করে। মাত্র ৬১ কার্যদিবসে মামলার কার্যক্রম শেষ হয়। আর মামলার তদন্ত কার্যক্রম শেষ করতে পিবিআইয়ের লাগে ৩৩ কার্যদিবস। বিচারক নুসরাত হত্যা মামলার রায়ে অধ্যক্ষ সিরাজউদ্দৌলাসহ ১৬ জনকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দিয়েছেন। একই সঙ্গে তাদের প্রত্যেককে এক লাখ টাকা করে জরিমানা করা হয়েছে।
এছাড়াও রায়ে চারজন পুলিশের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। দেশের বিচার বিভাগের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো এ মামলার রায়ে সচিত্র ঘটনাপ্রবাহ ব্যবহার করা হয়। রায় পড়ার শুরুতেই এই হত্যা মামলায় গণমাধ্যমের ভূমিকার প্রশংসা করেন আদালত। আদালত বলেন, গণমাধ্যমের কারণেই এই ভয়াবহ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা দেশবাসী জানতে পারে।
আদালতের পর্যবেক্ষণে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন-পিবিআইর ভূমিকার প্রশংসা রয়েছে। এদিকে রায়ের পরও নুসরাতের বাড়ির ডিশ লাইন কেটে দেয়া, বাড়ির আশপাশে ঘোরাফেরা, হুমকি-ধমকির মতো ইতরামি করেই যাচ্ছে সাজাপ্রাপ্তদের অনুসারীরা। নুসরাতের পরিবারের সদস্যরা সরকারের কাছে নিরাপত্তা চেয়ে আসছে আগে থেকেই। রায়ের পর আরো কাবু তারা।
বিশ্ব গণমাধ্যমে বিশেষ নিউজ ভ্যালু পেয়েছে বাংলাদেশের একটি মাদরাসার ছাদে নিয়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে একজন নারীকে পুড়িয়ে মারার নির্দয়-নিষ্ঠুর ঘটনার খবরটি। প্রশংসাও হয়েছে বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থার। রায়ের আদেশের খবরকে টপ নিউজ করেছে আন্তর্জাতিক ও ব্রিটিশ প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যম বিবিসি। রায় ঘোষণার পরপরই অনলাইন সংস্করণে প্রধান সংবাদ করেছে তারা।
সেই সঙ্গে করেছে কিছু মন্তব্যও। বিবিসির মন্তব্যে বলা হয়েছে, এ ধরনের হত্যা মামলা যে দেশটিতে বছরের পর বছর ধরে চলতে থাকে সেখানে নুসরাত হত্যার মামলার রায় খুব অল্পদিনের মধ্যে দেয়া হয়েছে। প্রায়োরিটি দিয়েছে ফরাসি বার্তাসংস্থা এএফপি, ব্রিটিশ বার্তাসংস্থা রয়টার্স, যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক টাইমস, ওয়াশিংটন পোস্ট, ভারতের এনডিটিভি, ইন্ডিয়া টুডে, টাইমস অব ইন্ডিয়া, সিঙ্গাপুরের দৈনিক স্ট্রেইট টাইমস, কানাডার সিটিভি নিউজ, পাকিস্তানের এক্সপ্রেস ট্রিবিউনসহ বিশ্বের অনেক গণমাধ্যমই।
নুসরাত হত্যার ঘটনায় গাফিলতির অভিযোগে সাবেক ওসি মোয়াজ্জেমকে তিরস্কার করেছে আদালত। ভবিষ্যতে যেন এ ধরনের কর্মকাণ্ড আর না ঘটে, সে ব্যাপারে সবাইকে সতর্ক করেছেন ফেনীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক। এটি রায়ের পর্যবেক্ষণমূলক অংশ। নুসরাতকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনায় তৎকালীন এই ওসির বিরুদ্ধে দায়িত্ব পালনে অবহেলার অভিযোগ উঠলে প্রথমে তাকে বরখাস্ত করা হয়।
বর্তমানে তিনি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অন্য একটি মামলায় কারাগারে। আসলে তিনি শুধু গাফিলতি করেননি। খুনিদের সহায়তা করেছেন। এ ব্যাপারে যথাযথ ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টো নুসরাতকে হয়রানি করেছেন। থানায় নুসরাতের কথাবার্তা তিনি ভিডিও করেন। পরে সেটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়েও দেয়া হয়। তাই তাকে শুধু তিরস্কার ‘কম’ হয়ে গেছে কিনা, এটা নিয়েও নানা মত ও মন্তব্য রয়েছে সচেতনসমাজে। বিষয়টার সঙ্গে আবেগের বিষয়ও রয়েছে।
যে কারণে সিরাজউদ্দৌলাসহ ঘাতকদের মৃত্যুদণ্ডের চেয়েও ভয়াবহ কোনো শাস্তি হলে স্বস্তি পেতেন- এমন বোধও কারো কারো। নুসরাতের অন্যতম হত্যাকারী মাদরাসার অধ্যক্ষ সিরাজের আস্ফালনের কিছু তথ্য গণমাধ্যমে আগেও এসেছে। গ্রেফতারের সময়, আগে-পরে, জেলখানায়, হাজিরার দিন তার ভাবভঙ্গি সংবাদ মাধ্যমের শিরোনাম হয়েছে।
রায়ের দিনও তিনি হাসতে হাসতে আয়েশে আদালতে এসেছেন। প্রিজনভ্যান থেকে নামার সময় তিনি বেশ হাসিখুশি ছিলেন। হাসতে হাসতে ড্যামকেয়ারে তিনি এজলাসে যান। রায় ঘোষণার আগ পর্যন্ত তিনি খোশমেজাজে ছিলেন। রায়ের পর এক চিলতে কেঁদেছেন। তার হাসি ও আচরণের মাঝে এক বিশাল ঔদ্ধত্য কাজ করছে সবসময়। সংশয়-সন্দেহ ওই কারণেই।
যে কারণে ফাঁসি কার্যকর না হওয়া পর্যন্ত স্বস্তির সুযোগ কম। কারণ রায়টি নিম্ন আদালতের। এটা চূড়ান্ত হবে উচ্চ আদালতে। এই মামলায় কতজনের ফাঁসি বহাল থাকবে, তা নির্ধারণ হবে হাইকোর্ট বিভাগ যখন ডেথ রেফারেন্স নিষ্পত্তি করবে। উচ্চ আদালতে আপীল করে মুক্ত হয়ে এই হায়েনারা আবারো হাসে কিনা, হাসতে হাসতে বের হবে কিনা, সেই শঙ্কা কিন্তু থেকেই যায়।
নুসরাত হত্যার বিচারের বিষয়টি উচ্চ আদালতে অবশ্যই যাবে। সেখানেই আরো মনোযোগী হওয়ার ব্যাপার আছে। পুলিশের কাগজপত্র মামলার নথিপত্রের কোনো ফাঁক দিয়ে উচ্চ আদালত থেকে যেন খুনিরা বেরিয়ে আসতে না পারে সেদিকে এখন থেকেই মনোযোগী হতে হবে। মানুষের এই স্বপ্ন, এই প্রত্যাশার দিকে সরকার, রাষ্ট্র কতটা মনোযোগী হবে- সেটার ওপর সরকার ছাড়া কারো হাত নেই।
আলোচিত খুনের বিচার না হলে রাষ্ট্র এবং সরকারের দিকে নাগরিকরা বরাবরই সন্দেহেরে চোখে তাকায়। সেই সন্দেহ থেকে নিজেদের মুক্ত রাখা তো সরকারেরই দায়িত্ব। সঙ্গে স্বার্থও থাকে। আবার লাভ-লসসহ স্বার্থের ব্যাপার রয়েছে খুনিদেরও। যে কারণে মৃত্যুদণ্ডসহ গুরুতর শাস্তির রায়ের পরও দমছে না আসামিদের সাঙ্গোপাঙ্গরা। পরিবারকে অশান্তিতে রাখার একটি সঙ্কল্প যেন ওরা নিয়েই রেখেছে।
ফেনীর নুসরাতকে নিয়ে আলোচনার তোড়ে বরগুনার মিন্নির কথা আমরা মোটামুটি ভুলে যেতে বসেছি। কী না হয়েছে মেয়েটিকে নিয়ে? স্বামীকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যার সময় তাকে বাঁচানোর সর্বসাধ্য চেষ্টা সে করেছে অথচ আসল ঘটনা জানার আগেই মূল আসামির ক্রসফায়ারে মৃত্যুর পরে তাকেই করা হলো আসামি।
নুসরাত আর মিন্নির ঘটনা অবশ্য ভিন্ন। একজন মরে গেছেন। আরেকজন বেঁচে থাকলেও জীবন্তমৃত। নুসরাত হত্যার দ্রুত বিচার আর মিন্নির পরিণতির মধ্যে ওপর মহলের চাওয়া-পাওয়ার প্রশ্নে একটি মিল রয়েছে। পুলিশের অ্যাকশন, ক্ষমতাসীন দলের পরাক্রমশালী নেতা শম্ভু বাবুদের দাপট, নানা নাটকীয় হেনস্তার পর আইন-আদালত মাড়িয়ে মিন্নি জেল থেকে ছাড়া পেয়েছে গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা না বলার শর্তে।
এটিও একটি ব্যতিক্রমী রায়। গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলা যাবে না- এমন শর্তে কারামুক্তি অবশ্যই আরেকটি অনন্য দৃষ্টান্ত। মিন্নি শর্ত মেনে চলছেন। গণমাধ্যম কেন, পাড়া-পড়শিদের সঙ্গেও কথা বলছেন না। গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বললে অসুবিধা কোথায়? আর কথা না বললেই কি সব কিছু গোপন থাকবে বা থাকছে? মানুষ কি কিছুই বোঝে না ?
কয়দিন মানুষের মুখ বন্ধ রাখা যায়? অমানুষিক শারীরিক আর মানসিক নির্যাতন চালিয়ে যে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি আদায় করা হয়েছে তা এখন কম-বেশি সবাই বুঝতে পেরেছে। শম্ভু বাবুদের হাত ঢের লম্বা। দেশের বিভিন্ন এলাকায় এই রকম বহু শম্ভু প্রশাসনকে হাতের মুঠোয় নিয়ে রাতকে দিন আর দিনকে রাত বানিয়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী, এর একটা শেষ থাকে। এটা প্রকৃতিরও নিয়ম। যার উদাহরণ সাম্প্রতিক অভিযানে বেশকিছু প্রভাবশালীর পতন এবং অনেকের ভয়ে পালিয়ে বেড়ানোর আতঙ্ক।
বাংলানিউজসিএ/ঢাকা/ ২৯ অক্টোবর ২০১৯/এমএম