Menu

নীলুফা আলমগীর :: পৃথিবীর সর্বত্রই নারী নির্যাতন, যৌন হয়রানি, সাইবার অপরাধ, গৃহ নির্যাতন এবং অন্যান্য অপরাধমূলক ক্রিয়াকলাপ নারীর জীবনকে প্রতিনিয়ত বিপন্ন করে তুলছে। কর্মস্থল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, পরিবার, রাস্তা কিংবা অনলাইন—সব ক্ষেত্রেই নারীরা নিরাপত্তাহীনতায় দিন কাটাচ্ছে। ইদানিং নারীর নিরাপত্তাহীনতার বিষয়টি শুধুমাত্র নারীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই, সচেতন পুরুষদের মধ্যেও আলোচিত হচ্ছে। নারীরা কি কখনোই নিরাপদ জীবন যাপন করতে পারবে না? লাশ কাটা ঘরেও নারী মৃতদেহের নিরাপত্তা অসংরক্ষিত?

গত ২০ অক্টোবর, ২০২৫ ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে আত্মহত্যার পর রাখা ২০ বছর বয়সি তরুণীকে ধর্ষণের অভিযোগে এক যুবকের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে। এই মামলায় অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। অভিযোগ স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছে মরদেহ আনা-নেওয়ার দায়িত্বে থাকা লাশবাহক।

গ্রেপ্তারকৃত যুবকের নাম আবু সাঈদ। বয়স ১৯ বছর। সে হালুয়াঘাট উপজেলার খন্দকপাড়া গ্রামের বাসিন্দা। প্রায় তিন বছর ধরে হালুয়াঘাট থানা থেকে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের মর্গে মরদেহ আনা–নেওয়ার কাজ করতো আবু সাঈদ।

তবে এমন ঘটনা বাংলাদেশে এবারই প্রথম নয়। এর আগে, ২০২০ সালে ঢাকা সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে পাঁচটি মরদেহে একই পুরুষের বীর্যের উপস্থিতি পেয়ে তদন্ত শুরু করে সিআইডি। অস্বাভাবিক এই যৌন অপরাধের ঘটনা তুমুল আলোড়ন তুলেছিল দেশে। মৃতদেহের সঙ্গে যৌন সংসর্গের অপরাধে ঢাকার সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল মর্গের ডোমের সহযোগী মুন্না ভক্তকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে।

এই ঘটনায় দায়ের করা মামলার একটি ধারায় মুন্নার সাজা হলেও আরেক ধারায় তাকে খালাস দেয়া হয়। প্রতিটি মামলায় মুন্নার বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ২৯৭ ও ৩৭৭ ধারায় অভিযোগ আনা হয়। ২০২১ সালের ৩১ জানুয়ারি ঢাকার মহনগর হাকিম আদালতে ধর্ষণের দায় স্বীকার করে জবানবন্দি দেয় মুন্না ভক্ত।

দণ্ডবিধির ৪৫ ও ৪৬ ধারায় জীবন ও মৃত্যু বলতে মানুষের জীবন ও মৃত্যুকে বোঝানো হয়। ‘মৃতদেহ’ শব্দটি দণ্ডবিধির ৩৭৭ ধারায় ব্যবহৃত হয়নি, সুতরাং আসামির বিরুদ্ধে ৩৭৭ ধারার অভিযোগ ‘আইনসম্মত নয়’ বলে মুন্নার আইনজীবী যুক্তি দিয়েছিলেন আদালতে। এই কারণের ভিত্তিতে মুন্না খালাস পায়।

২০২২ সালে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজে মরদেহের সঙ্গে বিকৃত যৌনাচারের অভিযোগে গ্রেফতার হয় মর্গের পাহারাদার ৩৮ বছর বয়সী মো. সেলিম। চট্টগ্রাম নগরের চান্দগাঁও থানার বহদ্দারহাট খাজা রোড এলাকায় একটি বাসায় বসবাস করতো সেলিম এবং অস্থায়ী ভিত্তিতে হাসপাতাল মর্গের পাহারাদার হিসেবে কাজ করতো।

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের লাশঘরে দুই কিশোরীর মরদেহে ধর্ষণের প্রমাণ পাওয়ার পর তাদের মরদেহ থেকে নেওয়া নমুনা পরীক্ষায় একজন পুরুষের বীর্য পাওয়া যায়। এর আগে ১২ বছর বয়সী আরেক কিশোরী এবং ৩২ বছর বয়সী এক নারীর মরদেহের সঙ্গেও এমন ঘটনা ঘটে লাশঘরে।

প্রতিটি ঘটনার সঙ্গে লাশঘরের পাহারাদার সেলিমের সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়। ময়নাতদন্তের আগে হাসপাতালের লাশঘরে মরদেহ রাখার সময় সে ধর্ষণ করেছিলো বলে পুলিশের কাছে স্বীকার করে। নারী ও একাধিক শিশু-কিশোরীর লাশের সঙ্গে শারীরিক সংসর্গ করেছিলো সেলিম।

সে আগেও একটি সংঘবদ্ধ ধর্ষণ মামলায় অভিযুক্ত আসামী ছিলো। থানা পুলিশ তদন্ত করে তার বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দিলেও যথাযথ সাক্ষ্য প্রমাণের অভাবে বিচারিক প্রক্রিয়া শেষে আদালত থেকে খালাস পেয়ে যায়।

গত সাত বছরে প্রকাশ্যে আসা তিনটি ঘটনাতেই ভুক্তভোগী হলো নারীর মৃতদেহ। ধর্ষকের হাতে কোথাও কোনো নারী নিরাপদ নয়। আর এই ধরনের ধর্ষণের কোনো নির্দিষ্ট কারণ নেই, যাকে সুনির্দিষ্ট করে এই অপরাধে উদ্বুদ্ধ হয়েছে

বলা যেতে পারে। এর পেছনে বিভিন্ন কারণ থাকতে পারে যেমন- রাগ, ক্ষমতা প্রদর্শন, ধর্ষকাম, যৌন তৃপ্তি বা বিবর্তনগত কারণ। এ ছাড়াও বলা যায় নৈতিকতা ও সুশিক্ষার অভাবে কিছু মানুষরূপী পশু এ ধরনের নৃশংসতামূলক জঘন্য কাজ করে থাকে।

মৃত ব্যক্তির সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক তৈরী, মৃতদেহ ধর্ষণ বা অন্যান্য যৌনাচারের প্রবণতাকে বলা হয়

“নেক্রোফিলিয়া”(Necrophilia)

মনোবিজ্ঞানীদের মতে, মৃতদেহ ধর্ষণ একটি গুরুতর মানসিক ব্যাধি, যা মূলত ব্যক্তির মানসিক বিকাশের সমস্যা, যৌন আকাঙ্ক্ষার অস্বাভাবিক প্রকাশ এবং নিয়ন্ত্রণহীন মানসিক অবস্থার ফল।বহু বছর পূর্বে যুক্তরাজ্যে এমন একজনকে পাওয়া গিয়েছিল, যে একশ তরুণী-কিশোরীর লাশ ধর্ষণ করে। ১৮৬০ সালে পেনাল কোডে একসময় এই অপরাধের সাজা ছিল কোনো নির্জন দ্বীপে অপরাধীকে নির্বাসনে পাঠানো।

বাংলাদেশের প্রচলিত আইনে ধর্ষণ একটি গুরুতর ফৌজদারি অপরাধ। তবে, এই আইন শুধুমাত্র জীবিত ব্যক্তিদের সুরক্ষা দিতে পারে।দণ্ডবিধির ৩৭৫ ও ৩৭৬ ধারা অনুযায়ী ধর্ষণের শাস্তি নির্ধারিত হলেও, মৃতদেহ ধর্ষণ, যৌন নির্যাতন বা ‘নেক্রোফিলিয়া’ (মৃতদেহের সঙ্গে যৌনাচার) নিয়ে সরাসরি কোনো শাস্তির কথা সেখানে উল্লেখ নেই।২৯৭ ধারায় কবরস্থান বা মৃতদেহ রাখার জায়গায় অবৈধভাবে প্রবেশ করা এবং এর শাস্তির বিধান রয়েছে, যার শাস্তি অনধিক এক বছর কারাদণ্ড বা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড। কিন্তু মৃতদেহ ধর্ষণের শাস্তির কথা কোথাও লিখিত নেই।

৩৭৭ ধারায় কোনো পুরুষ, নারী বা পশুর সাথে প্রকৃতির নিয়মের বিরুদ্ধে স্বেচ্ছায় কামজ কার্য করার শাস্তির বিধান রয়েছে। ‘প্রকৃতির নিয়মের বিরুদ্ধে কামজ কার্য’ কথাটি ব্যাপক অর্থ বহন করে, এবং মৃতদেহের সাথে যৌন কার্যকলাপ এই ধারার অধীনে আসতে পারে কিনা তা নিয়ে আইনি ব্যাখ্যা ও মতভেদ রয়েছে। এর শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা দশ বছর পর্যন্ত যেকোনো মেয়াদের কারাদণ্ড এবং অর্থদণ্ড।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মৃতদেহের প্রতি যৌন নির্যাতন বা ধর্ষণের জন্য সুনির্দিষ্ট আইন রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে -কানাডায়, নেক্রোফিলিয়া ফৌজদারি আইনের ১৮২ ধারার আওতায় আসে, যা মৃত মানুষের দেহ বা দেহাবশেষের সাথে অনুপযুক্তভাবে বা অশ্লীলভাবে হস্তক্ষেপ করা, অথবা কাউকে অসম্মান করাকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য করে। এই অপরাধের ফলে পাঁচ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড হতে পারে।

ভারতীয় দণ্ডবিধিতে ৩৭৫ ধারা অনুযায়ী মৃতদেহের প্রতি যৌন নির্যাতন বা ধর্ষণ একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়।যুক্তরাষ্ট্রে মৃতদেহ ধর্ষণ বা মৃতদেহের প্রতি যৌন সহিংসতা আইনত একটি গুরুতর অপরাধ। ক্যালিফোর্নিয়া, নিউ ইয়র্কসহ অধিকাংশ রাজ্যে এটি দণ্ডনীয় অপরাধ।

ক্যালিফোর্নিয়া পেনাল কোড ৭০৫২ অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি যদি মৃতদেহের সঙ্গে যৌন সংসর্গ করে বা কোনোভাবে মৃতদেহের সম্মানহানি করে, তবে এটি অপরাধ হিসেবে গণ্য। মৃতদেহের কোনো অংশ বা অঙ্গ অপব্যবহার করাও অপরাধ। এজন্য সর্বোচ্চ ৮ বছর কারাদণ্ড, পাশাপাশি অর্থদণ্ডের বিধান রয়েছে।মৃতদেহ ধর্ষণ বা নেক্রোফিলিয়া বিষয়টি জার্মান ক্রিমিনাল কোড ১৬৮ অধীনে শাস্তিযোগ্য অপরাধ এবং এতে ১ থেকে ৩ বছরের কারাদণ্ড এবং অর্থদণ্ডের বিধান রয়েছে।কিন্তু মৃতদেহ ধর্ষণের মতো অপরাধের জন্য বাংলাদেশের আইনে সুনির্দিষ্টভাবে কোনো ধারা না থাকায়, এই ধরনের অপরাধের বিচার একটি জটিল প্রক্রিয়া এবং আসামীও আইনের ফাঁক গলিয়ে সহজেই বের হয়ে যায়।

মর্গ-সংশ্নিষ্টদের বক্তব্য থেকে জানা যায়, দেশের অধিকাংশ মর্গে মৃত কিশোরী ও তরুণীদের শরীর থেকে নানা ধরণের আলামত নেয় পুরুষ মর্গ সহকারীরা। তাদের এ ব্যাপারে নূ্ন্যতম প্রশিক্ষণও নেই। বংশের ধারাবাহিকতায় মর্গে লাশ কাটার দায়িত্ব তারা পায়। কোথাও নারী মর্গ সহকারী নেই। কয়েকটি মর্গে দু-তিনজন নারী কর্মী থাকলেও তারা লাশঘরের ধোয়ামোছার কাজ করে। দেশের মর্গের ব্যবস্থাপনা চলছে সম্পূর্ণ অবৈজ্ঞানিক উপায়ে। ধর্ষণ, খুন ও অস্বাভাবিক মৃত্যুর প্রকৃত কারণ খুঁজতে লাশ থেকে আধুনিক উপায়ে আলামত সংগ্রহ করা জরুরি। সঠিকভাবে আলামত সংরক্ষণ ও পরীক্ষা করা না হলে বড় বড় অপরাধীদের বিরুদ্ধে অপরাধ প্রমাণ করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। আবার যারা মর্গে ডোম বা মর্গ সহকারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করে, তাদের অধিকাংশই থাকে নেশাগ্রস্ত।

আশাকরি সাম্প্রতিক ঘটনার প্রেক্ষিতে লাশকাটা ঘরে নারী কর্মচারীর নিয়োগ দান, সি সি ক্যামেরা স্থাপন এবং বর্তমান আইন সংশোধনের মাধ্যমে বাংলাদেশ দণ্ডবিধিতে নেক্রোফিলিয়ার মতো জঘন্য বিষয়কে অপরাধ হিসেবে অন্তর্ভুক্তকরে এই ধরনের অপরাধের জন্য নির্দিষ্ট শাস্তির বিধান নিশ্চিত পূর্বক অপরাধীদের বিরুদ্ধে যথোপযুক্ত শাস্তির ব্যাবস্থা করা হবে।

প্রবাস বাংলা ভয়েস /ঢাকা/ ০৩ নভেম্বর  ২০২৫ /এমএম


Array