আশরাফুর রহমান চৌধুরী, ক্যালগেরি, কানাডা :: যশোর জেলার কালিগঞ্জে এক বোবা-কালা সন্তানের মা এর ঘরে আশ্রয় নেয় দুই মুক্তিযাদ্ধা। তাদেরকে তাড়া করে ঐ বাড়ী পর্যন্ত চলে আসে মিলিটারি। কালিগঞ্জের গরীব ঘরের মা আর ঢাকা শহরের এলিফ্যান্ট রোডের মুক্তিযোদ্ধা রুমীর মা-চিরন্তন বাংলার মা।
নিজের বোবা-কালা সন্তান যাকে তিলে তিলে নিজের আঁচলে পরম আশ্রয়ে বড় করে তুলেছেন, সেই আদরের সন্তানকে বুকে পাথর বেঁধে তুলে দিলেন মিলিটারির হাতে। পরাজিত মায়ের ভালোবাসার কাছে ছেলেটির নিষ্পলক চাহনী আর বুক ভরা নিশ্বাস নিয়ে গিয়েছিল মিলিটারির সাথে-অজানা সেই পথ-হয়ত না ফেরার দেশ । হতবিহ্বল মায়ের চোখ, তিলে তিলে বড় করা সন্তানের দিক তাকিয়ে! মায়ের অপলক দৃষ্টিতে মুক্তিযোদ্ধার নির্বাক ছুটে চলা।
এরকমই একটি ঘটনা সেলিনা হোসেন তার গল্পে ফুটিয়েছিলেন ‘দীপাননিতা’ নামে, তা প্রকাশিত হয়েছিল তৎকালিন এক পত্রিকায়। পরবর্তীতে যেটি পরিপূর্ন উপন্যাসে রুপ নেয় ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’।
ঘটনাক্রমে ঐ পত্রিকার একটি কপি সত্যজিৎ রায় এর হাতে পড়ে। তিনি ’দীপাননিতা‘ গল্পটি পড়ে নির্বাচিত করেন ছবি করার জন্য। পরের ঘটনা আরো চমকপুর্ন। পুর্বপরিচিত আব্দুল গাফফার চৌধুরীর সত্যজিৎ রায়ের সাথে দেখা কলকাতাতে। কথা প্রসঙ্গে সত্যজিৎ রায় আব্দুল গাফফার চৌধুরী কে বললেন ঢাকাতে সেলিনা হোসেন নামে এক লেখিকার গল্প পড়েছি, গল্পটি বেশ ভাল, ছবি করতে চাই। আপনি কি তার খোঁজ দিতে পারবেন। উত্তরে তিনি বললেন নিশচয়ই! গাফ্ফার চৌধুরী ঢাকা এলেন।
তিনি লেখিকা কে চেনেন না। সেলিনা হোসেন তখনও পরিচিত লেখক হয়ে ওঠেননি, বাংলা একাডেমীতে চাকরি করেন। ১৯৭৩ এর ডিসেম্বরে কোন এক অনুষ্ঠানে সেলিনা হোসেনের সাক্ষাত পেলেন গাফ্ফার চৌধুরী। সত্যজিৎ রায়ের ইচ্ছার কথা জানালেন। সেলিনা হোসেন অবাক বিস্মিত হলেন আর মনের অজান্তে আহ্লাদিত হলেন। ইতিমধ্যে সত্যজিৎ রায়ের সাথে তাঁর সংযোগ হলো। ছবি তৈরির প্রাথমিক পরিকল্পনাও শুরু হয়েছে। পরিকল্পনা অনুযায়ী বাংলাদেশ-ভারত যৌথ উদ্যোগে ছবিটি হবে।
একটি চরিত্র ভারত থেকে আর বাকি চরিত্র বাংলাদেশের শিল্পীরা করবেন। ছবির চিত্রায়ন হবে বাংলাদেশে। গাফ্ফার চৌধুরী সার্বিক যোগাযোগ রাখছেন সত্যজিৎ রায় এবং দুই দেশের সরকারি বেসরকারি সকল পক্ষের সাথে। সব কিছুই যেন সোনার কাঠি রুপার কাঠির ছোঁয়ায় স্বপ্নের মত ঘটে চলেছিল।
হঠাৎ গাফ্ফার চৌধুরী অসুস্থ স্ত্রীকে নিয়ে লন্ডন চলে গেলেন, এর মধ্য দেশেরও রাজনৈতিক পট পরিবর্তন ঘটলো, সত্যজিৎ রায় ও অসুস্থ হয়ে পড়লেন- সব মিলিয়ে দৃশ্যপট কেমন যেন বদলে গেলো। ছবিটি আর হয়ে উঠল না। সম্ভাবনাময় স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে গেল।
কঠিন এক অগ্নিপরীক্ষার মধ্য দিয়ে আমরা পথ চলছি। জীবনে অনেক অজানা স্বপ্নের কথা অনেক ক্ষেত্রে অজানাই থেকে যায়। করোনা কালীন এই সময়ে হাজার ও স্বপ্নের অপমৃত্যু ঘটেছে। প্রকৃতিই হয়তো তার নিজের এই বিচার থেকে এক সময় থেমে যাবে। শুধুমাত্র সম্ভাবনাময় কিছু স্বপ্নের অপমৃত্যু ঘটবে।
প্রবাস বাংলা ভয়েস/ঢাকা/ ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২০/এমএম






