Menu

রকিব হাসান ও মিশন পেপারব্যাক

বাংলানিউজসিএ ডেস্ক :: পেপারব্যাকের সঙ্গে আমার পরিচয় তিন গোয়েন্দা দিয়ে। রকিব হাসানকেও চিনি পেপারব্যাক দিয়ে। ছোটবেলায় টাকা জমিয়ে ইস্টিশনে যেতাম, তিন গোয়েন্দার নতুন বইয়ের জন্য। রকিব হাসানের নতুন অনুবাদের জন্য। ইস্টিশনের খুপড়ি দোকানগুলোতে ওগুলো পাওয়া যেতো। একটা পাতলা খামে ভরে হাতে ধরিয়ে দিতো। খামটা হাতে নিয়েই প্লাটফরম ছেড়ে রেল লাইনে নেমে যেতাম। হাঁটা শুরু করতাম বাসার দিকে। হাঁটতে হাঁটতেই খামের পিন খুলতাম। তারপর বইটার পাতা খুলে গন্ধ নিতাম। প্রচ্ছদ দেখে একটা কল্পনা বানাতাম। প্রথম দু’এক পৃষ্ঠা পড়া হয়ে যেতো হাঁটতে হাঁটতেই।

রকিব হাসানকে নিয়ে ছোটবেলার সেই ঘোর বড়বেলায়ও কাটেনি। তবে বড়বেলায় এসে ভীষণরকম ধাক্কা খেতে হলো। দেখলাম রকিব হাসান পেপারব্যাক ছেড়ে চলে গেছেন হার্ডকভারে। হার্ডকভারের বইগুলো গায়ে-গতরে দশাসই। ওজনদার। ডাকসাইটে কয়েকটা প্রকাশনা সংস্থা থেকে ঝকঝকে তকতকে করে বেশ কিছু বই বাজারে এলো। ওগুলো উল্টে-পাল্টে দেখলাম। ভালো লাগলো। কিন্তু কেন যেন কিনতে ইচ্ছে হলো না। পড়তেও ইচ্ছে হলো না। অথচ দেখলাম অন্যরা রীতিমতো শোরগোল করে কিনছেন।

পাঠকদের সঙ্গে আলাপ করলাম। প্রকাশকদের সঙ্গে কথা হলো। সবাই জানালেন হার্ডকভারের কাটতি ভালো। পাঠকরা কেন হার্ডকভার পছন্দ করেন?
জবাব অনেক। হার্ডকভারের বইগুলো তাকে সাজিয়ে রাখতে সুবিধা। দূর থেকে ‘পুট’ দেখে কোনটা কোন বই আন্দাজ করা যায়। তাছাড়া এতে জ্যাকেট থাকে। বইয়ের নিরাপত্তা বেশি, ওজন বেশি। ইত্যাদি ইত্যাদি।

প্রকাশকরা জানালেন, পেপারব্যাক বাংলাদেশের পাঠকরা পছন্দ করে না। কিন্তু অন্যান্য দেশে তো পেপারব্যাক জনপ্রিয়। পেপারব্যাকের বই-ই বিক্রি হয় বেশি। যে বইগুলোর কাটতি বেশি, সেগুলো পেপারব্যাকেই ছাপা হয়। পেপারব্যাকে বই করতে সময় কম নেয়। বহন করতে পাঠকের সুবিধা হয়। বাড়িতে, গাড়িতে, দীর্ঘ অপেক্ষার জন্য পেপারব্যাক ভালো। অনেকে ছোট ছোট পেপারব্যাক কিনে একবসায় পড়া শেষ করে বইটা রেখে যান। সংগ্রহে রাখার মতো হলে বাড়িতে নিয়ে যান। পেপারব্যাক বই রাখার মতো করে তাদের বইয়ের তাকও আছে। সেখানেই রেখে দেন। বাড়ি পাল্টানোর সময়ও পেপারব্যাক টানতে সুবিধা, বাড়তি হার্ডকভারের ওজন বইতে হয় না।

এতসব সুবিধার কথা বলার পরও প্রকাশকরা জানালেন, ওগুলো তাদের জানা। কিন্তু পাঠক পেপারব্যাক বই কিনতে না চাইলে তারা ছাপবেন কেন? পাঠকের চাহিদার কথাই আগে বিবেচনা করতে হবে। কোনো প্রকাশক যদি পেপারব্যাকের ঝুঁকি নিয়ে এগিয়ে আসেন, তাহলে? তাহলে নিশ্চিত ধরা খেতে হবে। নিশ্চিত!
হ্যাঁ, মোটামোটি নিশ্চিত। এর আগে অনেকেই এই সাহস দেখাতে চেয়েছেন। কিন্তু ধরা খেয়েছেন। কেউ প্রকাশনা বন্ধ করে দিয়েছেন, কেউ নীতি পাল্টেছেন।
আমি হতাশ হলাম। অভিমান হলো। তাহলে কি বাংলাদেশে পেপারব্যাকের দরজা বন্ধ? বিষয়টা নিয়ে আলাপ করলাম রকিব হাসানের সঙ্গে। তিনি নিরস মানুষ। সোজাসাপটা কথা বলেন। আমাকেও সোজা জানিয়ে দিলেন, পাঠক এখন পেপারব্যাক কিনতে চায় না। কিন্তু আমিও তো একজন পাঠক। আমি পেপারব্যাক কিনতে চাই। তুমি একা কিনতে চাইলে তো হবে না। কথা সত্য। কিন্তু আমার বিশ্বাস পাঠক এখনো পেপারব্যাক চায়। অন্যদের ক্ষেত্রে জানি না। আপনার বইগুলো পেপারব্যাকে চায়।

তুমি কি কোনো জরিপ চালিয়েছো? প্রশ্ন শুনে চুপ করে যেতে বাধ্য হলাম। কয়েক সেকেন্ড পর মিন মিন করে আবার বললাম, এটা আমার বিশ্বাস। আমার মনে হয়, আমার যেহেতু পেপারব্যাক ভালো লাগে, আমার মতো এমন অনেকেই আছেন আপনাকে পেপারব্যাকেই চায়।
তুমি মনে করলেই তো হবে না। বিশ্বাস আর বাস্তবতা ভিন্ন। প্রকাশকরা আমাকে হার্ডকভারে চায়।
আর পাঠকরা?
প্রকাশকদের চাওয়া মানে তো পাঠকদের চাওয়াই। পাঠকদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ আমার নেই, প্রকাশকদের আছে। বইয়ের বাজারের ব্যাপারে ওদের ধারণা আছে।
ওইদিন রকিব হাসানের বক্তব্য মোটামুটি এমন-ই।
অন্য আরেকদিন। আবার সেই পেপারব্যাকের প্রসঙ্গ তুললাম। তিনি হাসলেন। জিজ্ঞেস করলেন, তুমি পেপারব্যাকের পেছনে এতো লেগেছো কেন?
আমি জবাব খুঁজে পেলাম না। একটু থামলাম। জিজ্ঞেস করলাম, আপনার পছন্দ কোনটি?
তিনিও থামলেন। তারপর যা বললেন, তাতে অভিভ‚ত হলাম। রকিব হাসান জানালেন, তার পছন্দ পেপারব্যাক।
তাহলে?
তাহলে আর কি, পাঠকের পছন্দ সবার আগে।
পাঠক আপনার সঙ্গে পরিচিত পেপারব্যাক দিয়ে, হার্ডকভার দিয়ে নয়।
সেটা ঠিক। তবে এখন পাঠকের রুচি পাল্টেছে?
এটা কি আপনার কথা?
না, প্রকাশকদের কথা। পাঠকের রুচির ব্যাপারে প্রকাশকদের ধারণা আছে।
হ্যাঁ, ধারণা থাকাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু প্রকাশক চাইলে তাদের ধারণার বাইরে গিয়েও রিস্ক নিতে পারেন।
কীসের ভিত্তিতে রিস্ক নিতে বলছো?
আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাসের ভিত্তিতে।
রকিব হাসান কিছুটা অবাক হলেন। তবে খানিকটা স্মৃতিকাতরও হলেন।
এরপর থেকে রকিব হাসানের সঙ্গে ‘পেপারব্যাক আলাপ’ নিয়মিতই চলতে থাকল। তিনি অতুলনীয়, আলাদা। আমার কাছে রকিব হাসান, লেখক, ইস্টিশনের স্মৃতি। আর আমার কৈশোর।
একদিন প্রকাশকের খাতায় নাম লেখালাম আমিও। ‘কালো’ নামে একটা প্রকাশনা সংস্থা দাঁড় করালাম। খবরটা জানালাম তাকে। তিনি শুভ কামনা করলেন। পরামর্শ দিলেন নতুন নতুন লেখক তৈরি করতে, শক্তিশালী লেখক। আগেই বলেছি, রকিব হাসান সোজাসাপটা মানুষ। মুখের ওপর বলে দেন। আমাকেও বলে দিলেন, ‘কালো’ নামটা ভালো লাগেনি। এমন অদ্ভুত নাম, সুযোগ থাকলে এখনি পাল্টে নাও।
আমি মিন মিন করে এর পক্ষে যুক্তি দেখাতে চেষ্টা করলাম। কিন্তু কোনোটাই ধোপে টিকল না। তবে শেষ পর্যন্ত তিনি বলতে বাধ্য হলেন, শুনতে শুনতে অদ্ভুত নামও ভালো লেগে যায়। তোমরা ভালো কিছু করতে পারলে ব্র্যান্ড হিসেবে দাঁড়িয়ে যাবে।
না পাওয়ার মধ্যে এতটুকু সমর্থন পেয়ে আমি খুশি। কালো’তেই অটল রইলাম। বছর দু’য়েক গেল, রকিব হাসানকে বই দেয়ার জন্য কখনো চাপাচাপি করিনি। শুধু কালোর খবরগুলো জানাচ্ছিলাম। আর তার বই পাওয়ার একটা লোভ আছে, সেটাও হালকা করে জানিয়ে দিচ্ছিলাম।
এ বছর রকিব হাসানকে চেপে ধরলাম। তিনি বাধ্য হলেন ‘কালো’ নামের এই প্রকাশনা সংস্থাটিকে একটি বই দিতে। সম্পূর্ণ নতুন বই। কিশোর, মুসা ও রবিন এই বইটির নায়ক। তারা কিভাবে গোয়েন্দা হয়ে উঠলো, সেই রহস্য আছে এতে।
বইটির ফরমেট নিয়ে চললো আলাপ। আমি পেপারব্যাকে চাই। কালো’র অধিকাংশ বই-ই পেপারব্যাক। আমি ঝুঁকি নিয়েছি। পেপারব্যাক বইয়ের ফেরি করছি। এই সড়কে অনেকে পা দিয়ে ফেরত গেছেন, সেটাও শুনেছি। তারপরও ঝুঁকিটা নিয়েছি আত্মবিশ্বাস থেকে। দরকার হলে অন্যরা যেভাবে ফেরত গেছেন, আমিও সেভাবে যাবো। তারপরও সড়কটা চিনে যাবো। এই সড়কে এসে কেন ফিরতে হয়, সেটা জেনে যাবো। দেখে যাবো পেপারব্যাকের ব্যাপারে পাঠক কতটা কঠোর হতে পারে।
রকিব হাসান বললেন, ভেবে দেখো এতো বড় ঝুঁকি নেবে কি না!
আমি জানালাম, আমার অন্য বইগুলোর কথা। প্রায় সবগুলোই পেপারব্যাক। ‘দুর্গম-গিরি কান্তার মরু’পথ যেহেতু বেছে নিয়েছি, ঝুঁকি না নিয়ে পাড়ি দেওয়া যাবে না।
রকিব হাসান হাসলেন। আমাকে বইটা দিলেন। বইয়ের নাম ‘পার্টি রহস্য’। পেপারব্যাকেই ছাপতে বললেন। সেইসঙ্গে জানিয়ে দিলেন, এবার তোমার পারফরম্যান্সের ওপর নির্ভর করছে ‘পেপারব্যাক মিশন’ এর ভবিষ্যৎ। ভালো বুঝলে থাকবো। নাহলে হার্ডকভারে ফেরত।
আমি বইটা নিয়ে কাজ শুরু করে দিলাম। ছাপাখানার ধাপগুলো শেষে বই হাতে এলো মেলা শুরু হওয়ার কয়েকদিন আগে। ওইদিন-ই ছুটে গেলাম রকিব হাসানের বাড়িতে।
দরজা খুলে গেলো। রকিব হাসান উঁকি দিলেন। দরজা সরিয়ে আমাকে ভেতরে যেতে বললেন। বসার ঘরে বসলাম। তিনিও আমার কাছাকাছি।
ব্যাগ থেকে এক কপি বই বের করলাম। তাঁর হাতে দিলাম। তিনি হাত বাড়ালেন। বইটা নিলেন। কয়েক মিনিট চুপ।
তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
আমি ভড়কে গেলাম। সম্ভবত বড় ধরনের কোনো ভুল হয়েছে!
কিন্তু না। রকিব হাসান স্মৃতিকাতর হয়ে বললেন, ‘অনেক দিন পর আমি পেপারব্যাকে ফিরে গেলাম।’
তিনি বললেন, ‘মনে হচ্ছে, আগের সময়টা ফিরে পেয়েছি।’
আমাকে বললেন, ‘তুমি কাজটা করলে, কিন্তু সময় হারিয়ে।’
আমি আবারো ভড়কে গেলাম। রকিব হাসান বললেন, ‘আর কতদিন-ই বা বাঁচবো বলো!’
আমি বললাম, ‘আগামীকাল আমিও মারা যেতে পারি।’
তিনি বললেন, ‘তুমি মারা গেলে সেটা হবে অকালমৃত্যু। আর আমার মৃত্যুর সময় ঘনিয়ে এসেছে। এখন মৃত্যুটাই আমার জন্য স্বাভাবিক, অকাল নয়।’
এরপর বইমেলা শুরু হলো। রকিব হাসানের ‘পার্টি রহস্য’ স্টলে উঠে গেলো প্রথম দিন থেকেই। প্রতি রাতেই আমি তাকে মেলার খবরাখবর জানাই।
খবর শুনে রকিব হাসান অবাক হন। উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন। সেই উচ্ছ্বাসে আমি খুঁজে পাই পেপারব্যাক নিয়ে আমার ব্যক্তিগত আবেগ। সেই ইস্টিশন, রেল লাইন।

বাংলানিউজসিএ/ঢাকা/২ মে ২০১৯/ইএন


Array