বাংলানিউজসিএ ডেস্ক :: শাহেদ পত্রিকার অনলাইন ভার্সনগুলো দেখছিল মোবাইলে। প্রায় সব পত্রিকার খবর একই রকমের। দেশজুড়ে ক্রমেই করোনা আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে আশঙ্কাজনকভাবে। এ কারণে লকডাউন করা হয়েছে বিভিন্ন জেলা, উপজেলা, শহর এমনকি গ্রাম পর্যন্ত। করোনা রোগ সন্দেহে অসুস্থ এক মহিলাকে জঙ্গলে ফেলে রেখে আপন সন্তান স্বামীসহ আত্মীয়স্বজনদের সটকে পড়ার খবরটি দেখে মনটা আরো খারাপ হয়ে যায় শাহেদের।
দুঃসময়ে, অসুস্থতায় যখন কেউ বিপর্যস্ত অসহায় হয় তখন তো তার পাশে থাকার কথা পরিবারের লোকজন, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, পাড়া প্রতিবেশীদের। যদি নিজে তেমনিভাবে করোনায় আক্রান্ত হয়, কিংবা তার পরিবারের অন্য কেউ তাহলেও কী একই ব্যাপার ঘটবে? আর ভাবতে পারে না শাহেদ। এভাবে যতই দিন যাবে অবস্থা আরো শোচনীয় হবে। তখন আমরা কোথায় গিয়ে দাঁড়াব, নিজেকে প্রশ্ন করে শাহেদ। তখনই বিছানায় পাশে রাখা মোবাইল ফোনটা বেজে ওঠে। হাতে নিয়ে দেখতেই আফসানার নামটা ভেসে উঠতে দেখে সে।
‘শাহেদ ভাই, কেমন আছেন?’
‘এই তো। এখন কেমন থাকতে পারি, তুমিই বলো। তুমি কেমন আছ?
তোমার কী অবস্থা বলো। কোনো প্রবলেম ট্রবলেম হয়নি তো?
‘আমি জানি বাসায় থেকে ফোনে আমার সঙ্গে কথা বলতে আপনার সমস্যা হতে পারে। তবুও আমি বাধ্য হয়ে, অনেকটা নিরূপায় হয়ে আপনাকে ফোন করেছি।’ বলতে গিয়ে আফসানার গলাটা ধরে আসে কিছুটা।’
‘কেন, কী হয়েছে?’
‘আমি অনেক বিপদে পড়ে গেছি। কাউকে বলতে পারছি না নিজের সমস্যাটার কথা। ঘরে আমার কাছে একটা টাকাও নেই। চাল-ডাল, বাজার সদাই কিছু নেই। বেতন যা পেয়েছিলাম,খরচ হয়ে গেছে। এখন কার কাছে গিয়ে টাকা চাইবো। আশপাশে যারা আছে সবারই একই অবস্থা।
আমার ছেলে মেয়ে দুটি সকাল থেকে নাস্তা না খেয়ে আছে। ঘরে চাল আটা কিছুই নেই। এই সময়ে দোকানে বাকি চাইলেও দিতে রাজি হবে না কেউ। এরকম বিপদে আমি আগে কোনো সময়ে পড়ি নাই। কেন জানি মনে হলো, আপনাকে জানাই ব্যাপারটা। এই দুঃসময়ে সবাই বিপদের মধ্যে রয়েছে। তবুও যদি কিছুটা সাহায্য করতে পারেন, বলতে গিয়ে কেঁদে ফেলে আফসানা।
তার সমস্যার কথা শুনে হঠাৎ কেমন নির্বাক হয়ে যায় শাহেদ। কী বলবে সে এখন আফসানাকে?
তার হাতে এই মুহূর্তে একটি টাকাও নেই। ঘরে চাল-ডাল-আটা কিছুই নেই। ছেলে-মেয়েসহ সে না খেয়ে আছে। এখন বেশি কথা বলতে পারছি না। এখন তোমার কত টাকা দরকার, জানি না। এখন তোমার জন্য ১০ হাজার টাকা পাঠাতে পারব। এ
টাকা দিয়ে কোনোভাবে ম্যানেজ করে চল।’ দ্রুত অস্থির গলায় ফিস ফিস করে বলে সে।
‘অনেক উপকার হবে আমার। শাহেদ ভাই, আপনার এই সাহায্য আমার যে কত উপকারে আসবে বলে বোঝাতে পারবো না। কথাগুলো বলতে গিয়ে উল্লাসে আবার কেঁদে ফেরে আফসানা।
দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর শাহেদ রিমিকে বলে- অফিস কলিগ মুনির সাহেবের ১০ হাজার টাকা দরকার। ফোন করে জানিয়েছে। ব্যাংকে যেতে পারছে না লোকটা শরীর অসুস্থ থাকায়। তার হাতে নাকি একদম টাকা পয়সা নেই। আফসানাকে টাকা দেয়ার কথাটা লুকিয়ে রেখে মিথ্যে করে অফিস কলিগ মুনিরের কথা বলতে হয় শাহেদকে। আফসানাকে টাকা পাঠানোর কথা বাসায় জানাজানি হলে কেলেঙ্কারি বেধে যাবে।
টাকাটা পেয়েই আফসানা ফোন দেয় তাকে। এই মহা সংকটের মধ্যে একজন অসহায় বিদপগ্রস্ত মানুষকে কিছুটা হলেও সাধ্যমতো সাহায্য করতে পারায় শাহেদের মনে স্বস্তি ছড়িয়ে পড়েছে। যাক, এই টাকায় বেচারি কিছুদিন তো চলতে পারবে।
তার আত্মীয় কিংবা আপনজনদের কেউ না হলেও আফসানা যখন তার বিপদের সময় অনেকটা ভরসা করে, প্রত্যাশা নিয়ে সাহায্যের অনুরোধ জানালো তখন কেন জানি বুকের ভেতর এক ধরনের তোলপাড় অনুভব করেছিল শাহেদ। আফসানা তো তার কেউ নয়। কিন্তু অল্প সময়ের পরিচয় এবং ঘনিষ্ঠতার কারণে তার অনেকটাই কাছাকাছি চলে এসেছে সে।
সন্ধ্যায় চায়ের টেবিলে বসে রিমি জানতে চায়, ‘তুমি যে দারোয়ানকে দিয়ে তোমার অফিসের মুনির সাহেবকে ১০ হাজার টাকা পাঠালে সে কি টাকাটা পেয়েছে, ফোন করে জানিয়েছে?’
হঠাৎ রিমির এমন প্রশ্নে কিছুটা চমকে ওঠে শাহেদ। থতোমতো খেলেও নিজেকে সামলে নিয়ে বলে, ‘হ্যাঁ, টাকাটা পেয়েছে মুনির সাহেব। আমাকে ফোন করে জানিয়েছে। টাকাটা পেয়ে তার অনেক উপকার হয়েছে বলেছে। এই মহাসংকটের দিনে কার কাছে পাবে টাকা বলো। সবারই তো কারবালা অবস্থা, সবাই খুব কষ্টে আছে।’
শাহেদের তেমন কথায় কিছুটা তির্যক ঠাট্টার সুরে রিমি বলে, ‘মনে হয় তুমি অনেক ভালো অবস্থায় আছ। অন্য কারো কাছে টাকা পয়সা না থাকলেও তোমার কাছে মনে হয় যথেষ্ট টাকা পয়সা রয়েছে। কেউ চাইলেই তাকে হাজার হাজার টাকা পাঠিয়ে দিচ্ছ। নিজের ভবিষ্যৎ দিনগুলোর কথা মোটেও ভাবছো না। আর কিছুদিন গেলে তোমারও অন্যের কাছে হাত পাততে হবে না, টাকা চাইতে হবে নাক্স তার কী কোনো নিশ্চয়তা রয়েছে?
রিমির তির্যক কথাবার্তাগুলো অযৌক্তিক কিংবা অবান্তর নয় এই সময়ে। আগামী দিনগুলো আরো বেশি সংকটপূর্ণ হতে পারে, অবস্থাদৃষ্টে তাই মনে হচ্ছে।
রিমির কথায় যুক্তি থাকলেও আফসানার অসহায় অবস্থায় তাকে ১০ হাজার টাকা পাঠানোটা নিশ্চয়ই অন্যায় হয়নি। শাহেদ মনে মনে তার কৃত কাজের স্বপক্ষে যুক্তি খাড়া করতে চেষ্টা করে। আফসানার হাতে একটি টাকা ছিল না। ছেলে মেয়ে দুটিকে নিয়ে না খেয়ে ছিল সকাল থেকে। কারো কাছে হাত পাতার মতো অবস্থা ছিল না বেচারির। তাকে টাকা পাঠিয়ে সাহায্য করে মোটেও ভুল করেনি সে, শাহেদ ভাবে। যদিও রিমির কাছে আফসানার কথা বলার সাহস হয়নি তার। মিথ্যে করে সহকর্মী মুনির সাহেবের কথা বলতে হয়েছে। সত্যি কথাটা জানতে পারলে ঘরে চরম অশান্তি হবে।
রিমি তাকে ভুল বুঝবে। আপসানার সঙ্গে তাকে জড়িয়ে উল্টোপাল্টা নানা কথা ভাবতে পারে। এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হোক, শাহেদ কোনোভাবে চায় না। এখন এমনিতেই ঘরবন্দি জীবনযাপনে মানসিক নানা টানাপড়েনের মধ্যে সময় কাটছে। এর মধ্যে অহেতুক ঝামেলা সৃষ্টি করতে চায় না শাহেদ। আফসানার মতো দুই সন্তানের জননী স্বামীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে যাওয়া একজন নারীর সঙ্গে তার স্বামীর পরিচয়, জানাশোনা এবং বিশেষ সম্পর্ক গড়ে ওঠার বিষয়টি রিমিকে জানতে এবং বুঝতে দেয়নি শাহেদ। অনেক সতর্কতায় পুরো ব্যাপারটি আড়ালে রাখতে সক্ষম হয়েছে। এমন একটি ব্যাপার গোপন রাখার জন্য এক ধরনের অপরাধবোধ তাকে তাড়া করে ফিরে।
বাংলানিউজসিএ/ঢাকা/ ১৬ জুলাই ২০২০/এমএম




