Menu

বাংলানিউজসিএ ডেস্ক :: শীত শেষ হতে না হতে রাজধানীতে বেড়েছে মশার উপদ্রব। আসছে বর্ষা, উঁকি দিচ্ছে ডেঙ্গু আতঙ্ক। এরই মধ্যে মশার এমন উৎপাত ভাবিয়ে তুলছে নগরবাসীকে। মশক নিধনে নানা কার্যক্রম চলমান থাকলেও পরিকল্পনার ঘাটতি দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। তাই কালক্ষেপণ না করে এখনই সমন্বিত, দীর্ঘমেয়াদি উদ্যোগ গ্রহণের তাগিদ তাদের। জানা গেছে, ডেঙ্গু মোকাবিলায় এবারই প্রথম ঢাকার বাইরের চিকিৎসকদের আনা হয়েছে প্রশিক্ষণের আওতায়।

তবে এডিস মশা নিধনে মাঠপর্যায়ে চোখে পড়ছে না তেমন কোনো তৎপরতা। দ্রুত কর্মপরিকল্পনা ঠিক না করলে আসছে মৌসুমে গতবারের ভয়াবহতা ছাড়িয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ভিআইপি গেটের সামনে ঘিরে ধরলো হাজার হাজার মশা। এ যেন ঝাঁক বেঁধে পঙ্গপালের হামলা। মানুষের রক্তের ঘ্রাণে মুহূর্তেই হাজির লাখ লাখ মশা। অনাবৃত কোনো মানুষের দেহ থেকে সব রক্ত চুষে নিতে বুভুক্ষু এ মশক দলের হয়তো খুব বেশি সময় লাগার কথা নয়। মশার হুল থেকে নিস্তার নেই কয়েল জ্বালিয়ে এমনকি হাত-পা ঢেকেও। এ দৃশ্য দেখে কে বলবে কিছুদিন আগেই ডেঙ্গুর মতো বড় একটি বিপর্যয় কাটিয়ে উঠেছে নগরবাসী।

বিমানবন্দরে দুবাই প্রবাসী অপেক্ষমান পারভীন বেগম জানান, এখানে মশার উৎপাতে থাকাটাই যেন দায় হয়েছে। ঘরে ও বাইরে সব জায়গায় মশার উপদ্রব। মধু পোকার মতো আঁকড়ে ধরে। এ মশা সবার জন্য সমস্যা। বিশেষ করে বাচ্চা ও শিশুদের নিয়ে বেশি আতঙ্কে থাকি। কেননা ডেঙ্গুর-তো ভয় আছে?ডেঙ্গুবাহক এডিস নিয়ে জরিপ শেষ হওয়ার পর প্রায় দুই মাস পেরিয়ে গেলেও এখনো তার রিপোর্ট দিতে পারেনি স্বাস্থ্য অধিদফতর। যেহেতু এ জরিপের ভিত্তিতেই এলাকাভিত্তিক এডিস নিধনে অভিযান চালানোর কথা দুই সিটি কর্পোরেশনের। তাই রিপোর্ট না পাওয়ায় ব্যাহত হচ্ছে কাজ। এরই মধ্য নিজেরাই জরিপ শুরু করেছে সিটি কর্পোরেশন। অধিদফতর বলছে, নানা সীমাবদ্ধতার কথা। তবে শুরুতেই এমন সমন্বয়ের অভাব বড় বিপদের আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।

এডিস নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের বছরের তিন দফায় জরিপের ভিত্তিতে এলাকা ভিত্তিক নিজেদের কর্মপরিকল্পনা সাজায় সিটি কর্পোরেশন। অথচ বর্ষা পরবর্তী জরিপ গত ডিসেম্বরে শেষ হলেও দুই সিটি কর্পোরেশন এ রিপোর্ট পায় ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে। স্বাস্থ্য অধিদফতর জরিপ রিপোর্ট দিতে কালক্ষেপন করায় উপায়ন্ত না পেয়ে এরই মধ্যে আলাদা জরিপ করেছে দক্ষিণ সিটি, উত্তরও হাঁটছে একই পথে।

ডিএনসিসির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোমিনুর রহমান মামুন বলেন, অবশ্যই এই রিপোর্ট আগে পেলে আমাদের কাজের সুবিধা হতো। বুঝতে পারতাম আমাদের কোন জায়গাগুলোতে জোর দিতে হবে। গত ২৩ ফেব্রæয়ারি তারা একটি জরিপ প্রতিবেদন দিয়েছেন, এখন আমরা তাদের জরিপ ও আমাদের নিজস্ব কার্যক্রমের সমন্বয় করে মশক নিধন কর্মপরিকল্পনা আরো জোরদার করব।

ডিএসসিসির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. শরীফ আহমেদ বলেন, স্বাস্থ্য অধিদফতরের এবারের জরিপের রিপোর্ট পাওয়ার অপেক্ষা না করেই আমরা নিজের থেকে ডিএসসিসি জরিপ করেছি এবং সে অনুযায়ী কাজ শুরু করেছি। স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বেনজির আহমদ বলেন, এ ধরনের রোগে সমন্বয়ের কোনো বিকল্প নেই। আমরা যদি সমন্বয়ের জায়গাটাতে জোর না দেই, তাহলে তার ফল ভালো হবে না।

মশা মারতে কম হয়নি কামান দাগানো। প্রচলিত ওষুধ বদলে আনা হয়েছে নতুন ওষুধ। নেয়া হয়েছে প্রতিবেশী দেশের অভিজ্ঞতাও। কিন্তু ডেঙ্গু মৌসুম কাটতেই যেন হাল ছেড়েছে নগর কর্তৃপক্ষ। বহাল তবিয়তে রয়ে যাওয়া মশার প্রজনন ক্ষেত্রগুলোই তার জ্বলন্ত প্রমাণ। বিশেষ মৌসুম আর বিশেষ মশা চিহ্নিত করে মশক নিধন সম্ভব নয় জানিয়ে নগরবিদরা বলছেন, কার্যক্রম চালাতে হবে বছরব্যাপী সব মশাকে সমান গুরুত্ব দিয়ে। বাসা-বাড়ি, অফিস ও নির্মাণাধীন ভবনে জমে থাকা পানি পরিষ্কারেও সচেতন থাকার পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের।নগর পরিকল্পনাবিদ স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন বলেন, আমাদের যদি মশা ও ডেঙ্গু মুক্ত ঢাকা শহর করতে চাই; তাহলে আমাকে একটানা ৪-৫ বছর মশা মুক্ত করার জন্য ২৪ ঘণ্টা ৩৬৫ দিনের একটা প্রকল্প করতে হবে।

মশক নিয়ন্ত্রণে একদিকে কর্তৃপক্ষের নানা পরিকল্পনা আর প্রতিশ্রুতি অন্যদিকে রাজধানী জুড়ে ছড়িয়ে-ছিঁটিয়ে থাকা মৃতপ্রায় এমন খালে এক প্রকার অভয়ারণ্য গড়ে তুলেছে মশা। সাধারণত বংশ বিস্তারের জন্য এডিস স্বচ্ছ পানিকেই বেছে নেয়। পানি শুকিয়ে গেলেও লার্ভা বেঁচে থাকে এক থেকে তিন বছর পর্যন্ত। সেক্ষেত্রে এডিস নিধনে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় তেমন কোনো তৎপরতা না থাকায় আসছে মৌসুম নিয়ে শঙ্কায় সাধারণ মানুষ।

ডিএসসিসির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. শরীফ আহমেদ বলেন, এডিস মশার উৎস নির্মূলের লক্ষ্যে এরই মধ্যে গত ২৫ ফেব্রুয়ারি থেকে ডিএসসিসি সপ্তাহব্যাপী স্পেশাল ক্র্যাশ প্রোগ্রাম শুরু করেছে। মশার উৎপাত নিয়ন্ত্রণে আসার পূর্ব পর্যন্ত এর ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকবে বলে জানান তিনি।

ডিএনসিসির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মোমিনুর রহমান মামুন বলেন, আমরা এখন জানি কোথায় এডিস মশা বংশবিস্তার করে, কোথায় এদের ঘনত্ব বেশি, কোন বয়সের মানুষ বেশি আক্রান্ত হয় ইত্যাদি। তাই এসব তথ্য-উপাত্ত কাজে লাগিয়ে আমরা বছরের শুরু থেকেই পুরোদমে কাজে নেমেছি।

তিনি বলেন, ২০২০ সাল বিভিন্নভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে এ বছরকে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনে ‘মুজিববর্ষ’ ঘোষণা করা হয়েছে। মানুষ যাতে এডিস মশার উপদ্রব ছাড়াই বছরব্যাপী এ উৎসব নির্বিঘেœ উদযাপন করতে পারে সেজন্য আমরা নিরলস কাজ করে যাচ্ছি। নগরবাসী বলছেন, ময়লা-আবর্জনার ভাগাড়ে পরিণত হওয়া এসব খাল পরিষ্কার করে পানি প্রবাহ নিশ্চিত করা না গেলে বিফলে যাবে সব আয়োজন।

২০২০ সালে চলমান ও আসন্ন এডিস মশার উপদ্রব নিয়ন্ত্রণে ডিএনসিসির পরিকল্পনা তুলে ধরে উপ-প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা লে. কর্নেল মো. গোলাম মোস্তফা সারওয়ার বলেন, গত বছর শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অভ‚তপূর্ব সাড়া পাওয়া যায়। আমরা এবারো শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে একই কার্যক্রম প্রত্যাশা করছি। মশক নিধন কার্যক্রম আরো বেগবান করতে এরই মধ্যে ২শ’ টি ফগার মেশিন, ২৩৮টি পালস ফগমেশিন, ১৫০টি হার্টসন হস্তচালিত মেশিন, ৩৪০টি প্লাস্টিক হস্তচালিত মেশিন, ২টি ভেহিকল মাউন্টিং ফগার মেশিন, ১০টি মোটরসাইকেল ফগার ও হস্তচালিত মেশিন, ২০টি মিস্ট বেøায়ার/পাওয়ার স্প্রে মেশিন ক্রয়পূর্বক কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে।

এদিকে স্বাস্থ্য বিভাগ বেশকিছু পদক্ষেপের কথা বললেও সবই ডেঙ্গু মোকাবিলায়। এডিস নিয়ন্ত্রণে এখনো মাঠপর্যায়ে নিজেদের কর্মপরিকল্পনা ঠিক করতে পারেনি স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়।স্থানীয় সরকার মন্ত্রী তাজুল ইসলাম বলেন, এখনো তো মশার প্রাদুর্ভাব দেখা যায়নি, বৃষ্টি তো হয়নি, কিন্তু এরমধ্যে আমরা ৫ থেকে ৬টি বৈঠক করেছি। সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা সবার সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ রয়েছে।

কীটতত্ত¡বিদ তৌহিদ উদ্দিন আহমেদ বলছেন, মশা নিয়ন্ত্রণে এমন সমন্বয়হীনতা অশনি সংকেত। এখনই জেলাভিত্তিক পরিকল্পনা না নিলে এবার ভয়াবহতা হবে আরো বেশি। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষক ও দেশের প্রথম কীটতত্ত¡ গবেষণাগার আইআরইএসের সার্বিক তত্ত্ববধায়ক অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার। মশা বিষয়ে জাপানের কানাজোয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করেছেন তিনি। দীর্ঘদিনের গবেষণার ফল হিসেবে পর্যবেক্ষণ করেছেন এডিস মশার জীবনচক্র। দীর্ঘদিন ধরে এডিস মশার জীবনচক্র নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন তিনি। তিনি বলেন, ‘ঢাকায় প্রথম ডেঙ্গুর দেখা মেলে ১৯৬৪ সালে। তখন এই অসুখের নাম ছিল ঢাকা ফিভার। ২০০০ সালে এটির মাত্রা ব্যাপক বেড়ে যায়। তারপর থেকে প্রতিবছরই কমবেশি ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব দেখা গেছে। তবে গত বছর এর মাত্রা আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ে।’

ড. বাশার জানালেন, দেশে থাকা মশার ১২৩টি প্রজাতির মধ্যে ঢাকায় আছে ১২টি। এর মধ্যে এখানে এডিস ও কিউলেক্স বেশি প্রভাবশালী। এডিস মশার ডিম ছয় মাস পর্যন্ত শুকনো অবস্থায় ভালো থাকে। এবার ডেঙ্গুর এমন প্রাদুর্ভাবের অন্যতম কারণ, ১৯৫৩ সালের পর গত বছরই ফেব্রুয়ারি মাসে অনেক বেশি বৃষ্টি হয়েছে। তাই পানি পেয়ে শুকনো ডিমগুলো এবার আগেভাগেই বংশবিস্তার করেছে। তাই শুধু কোনো নির্দিষ্ট সময়ই নয়, সারা বছরই চারপাশ পরিষ্কার রাখা, ঘরের কোথাও পানি জমতে না দেয়া দরকার।

গত বছর ছিল ডেঙ্গুর জন্য ভয়াবহ একটি বছর। অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে হাসপাতালে রোগী ভর্তির সংখ্যা ছাপিয়েছিল একলাখ। দুই দশকের ইতিহাসে গতবারই প্রথম ৬৪ জেলাতেই মিলেছিল ডেঙ্গু রোগী। ১৫টি জেলায় রোগীর সংখ্যা ছিল এক হাজারের বেশি। কিশোরগঞ্জ ১৩শ’, মুন্সিগঞ্জ ১৮শ’ ৩৮ জন, ফরিদপুর ১১শ’ ৪২ জন, ময়মনসিংহে ১৬শ’ ৪৪ জন, কুমিল্লায় ১২শ’ ৬৩ জন, চাঁদপুরে ১৩শ’ ৮৯ জন, চট্টগ্রামে ১৭শ’ ০৬ জন, কুষ্টিয়ায় ১৫শ’ ৭১ জন, যশোরে ৪ হাজার ৬৮ জন, মেহেরপুরে ১৮শ’ ১৭ জন, বগুড়ায় ১ হাজার ৭৯ জন, সিরাজগঞ্জে ১ হাজার ৯৪ জন, পিরোজপুরে ১২শ’ ০৭ জন, বরিশালে ৩ হাজার ৪৪ জন, সিলেটে ১ হাজার ১১ জন। উল্লেখ্য, ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে গত মৌসুমে ঢাকার বাইরে মৃতের সংখ্যা ছিল ৩৫ জন।

বাংলানিউজসিএ/ঢাকা/ ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২০ /এমএম


Array

এই বিভাগের আরও সংবাদ