Menu

নারীর অগ্রযাত্রা বনাম সহিংসতা

মনজু আরা বেগম :: বাংলাদেশে নারীরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে এগিয়ে গেছেন। পরিবার, সমাজ ও দেশের উন্নয়নে নারীরা সমানভাবে অবদান রাখছেন। দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। দেশের উন্নয়নে নারীরাও সমভাবে অংশীদার। দেশে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের যতগুলো খাত আছে তার প্রায় সবক’টিতেই নারীর অবদান রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য তৈরি পোশাক শিল্প।

ফুটবল, ক্রিকেট, সাঁতার, কাবাডি, ভার উত্তোলনে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখা থেকে শুরু করে বিশ্বের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ পর্যন্ত জয় করছে নারীরা। ২০১৮ সালে ২০ লাখের বেশি ছাত্রছাত্রী মাধ্যমিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছিল।

ছাত্র ও ছাত্রীর অনুপাত ছিল সমান। উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছিল প্রায় ১৩ লাখ। এদের মধ্যে উত্তীর্ণ হয় ৮ লাখ ৫৮ হাজারের বেশি। ছাত্র ৪ লাখ ৩৫ হাজার এবং ছাত্রী ৪ লাখ ২৪ হাজার। অর্থাৎ ছাত্র ও ছাত্রী প্রায় সমান সমান। এ পরিসংখ্যান থেকে বোঝা যায় আমাদের নারীরা এগিয়ে যাচ্ছেন পুরুষের সঙ্গে সমানতালে।

গবেষণায় দেখা গেছে, শিক্ষা, চিকিৎসাসেবাসহ কিছু পেশায় পুরুষদের ছাড়িয়ে গেছেন নারীরা। শুধু বাংলাদেশে নয়, সারা বিশ্বে নারী নেতৃত্বের জয়জয়কার। বিভিন্ন দেশে রেকর্ডসংখ্যক নারী এখন নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছেন, যা বৈশ্বিক রাজনীতির চেহারা পাল্টে দিচ্ছে। মেক্সিকোর সাম্প্রতিক নির্বাচনে দেশটির পার্লামেন্টে দুই কক্ষেই সমানসংখ্যক নারী ও পুরুষ এমপি নির্বাচিত হয়েছেন, যে ঘটনাকে একটি বড় মাইলফলক হিসেবে দেখা হচ্ছে। স্পেনের মন্ত্রিসভায় পুরুষের চেয়ে বেশি নারীকে মনোনীত করা হয়েছে।

এসব তথ্য থেকে বোঝা যাচ্ছে, নারীরা আর চার দেয়ালের মধ্যে আবদ্ধ নেই। এরপরও দুঃখজনক হলেও বলতে হয়, যে দেশে মোট জনসংখ্যার অর্ধেকেরও বেশি নারী, যে দেশে খোদ প্রধানমন্ত্রী টানা তিনটি মেয়াদে প্রধানমন্ত্রিত্ব করছেন, সংসদের স্পিকার নারী; মন্ত্রিসভা, সংসদ, সচিবালয়, পুলিশ প্রশাসনসহ উচ্চপর্যায়ে নারীরা অধিষ্ঠিত, সেদেশে নারী ও কন্যাশিশুর প্রতি সহিংসতা বাড়ছে বৈ কমছে না। এর একটা বড় কারণ হিসেবে বলা যায় সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং পারিবারিক আচরণ। নারীকে এখনও দেখা হয় সংসারের ভার বহনকারী একজন মানুষ হিসেবে। সংসারের দায়িত্ব ভাগ করে নেয়ার মতো মানসিকতা এখনও আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজে গড়ে ওঠেনি। সন্তান উৎপাদন ও গৃহস্থালির কাজে নিয়োজিত থাকার জন্যই নারীর জন্ম হয়েছে, এ ধরনের মানসিকতা অনেক প্রগতিশীল ব্যক্তিও পোষণ করেন! তাই সমাজে নারী নির্যাতন বাড়ছে বৈ কমছে না। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, ২০১৮ সালে সারা দেশে ধর্ষণ ও গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৭৩২ জন নারী। ধর্ষণ-পরবর্তী হত্যার শিকার ৬৩ জন এবং ধর্ষণের পর আত্মহত্যা করেছেন ৭ জন। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ প্রকাশিত এক তথ্যে জানা গেছে, ২০১৮ সালে অর্থাৎ বিগত বছরে ৩ হাজার ৯১৮ জন নারী নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।

জাতিসংঘের মাদক ও অপরাধ বিষয়ক দফতরের (ইউএনওডিসি) এক গবেষণা এবং অ্যাকশন এইড বাংলাদেশ ও জাতীয় নারী নির্যাতন প্রতিরোধ ফোরামের এক যৌথ গবেষণায় নারীর প্রতি সহিংসতাবিষয়ক যেসব তথ্য পাওয়া গেছে তা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। উভয় গবেষণায় জানা গেছে, নারীরা নিজ ঘরেই সবচেয়ে বেশি সহিংসতার শিকার হয়ে থাকেন। ইউএনওডিসির গবেষণার ফলাফলে দেখা যায়, ২০১৭ সালে বিশ্বে মোট ৮৭ হাজার নারীকে হত্যা করা হয়েছে। এর মধ্যে ৫৮ শতাংশ খুন হয়েছেন একান্ত সঙ্গী অথবা পরিবারের সদস্যদের হাতে। অ্যাকশন এইড ও জাতীয় নারী নির্যাতন ফোরামের গবেষণায় নারীর প্রতি সহিংসতার দুই-তৃতীয়াংশই হয় পারিবারিক পরিমণ্ডলে।

মানুষের সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয় হল তার পরিবার। সারাদিনের কর্মক্লান্তি শেষে মানুষ এই নিরাপদ আশ্রয়ে ফেরে একটু শান্তির জন্য। সুখ-দুঃখ তার পরিবারের সঙ্গে ভাগাভাগি করার জন্য। কিন্তু এ সংক্রান্ত তথ্য অত্যন্ত উদ্বেগজনকই শুধু নয়, বলা যায় ভয়াবহ। নারীর প্রতি সহিংসতা বিষয়ে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী, দেশে বিবাহিত নারীর ৮০ শতাংশই কোনো না কোনোভাবে নির্যাতনের শিকার হন। সবচেয়ে বেশি নির্যাতনের শিকার হন স্বামী দ্বারা।

দুঃখের বিষয়, আমাদের দেশে আইন আছে; কিন্তু তার যথাযথ প্রয়োগ নেই। আইনের প্রয়োগ বা বাস্তবায়নের অভাবে অপরাধীরা আরও বেশি অপরাধপ্রবণ হয়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, কর্মজীবী নারীর জন্য আবাসন, অনিরাপদ রাস্তাঘাট, প্রতিকূল কর্মপরিবেশ, অনিরাপদ ও অপর্যাপ্ত পরিবহন ব্যবস্থা, কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তার অভাব, সামগ্রিকভাবে নারীশিক্ষার অভাব, অপুষ্টি, বাল্যবিয়ে ইত্যাদি নানা কারণে নারীরা প্রতিনিয়ত নির্যাতিত হচ্ছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য প্রথমেই প্রয়োজন পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার পরিবর্তন। নারীর অগ্রযাত্রাকে ব্যাহত করার পেছনে যেসব বাধা কাজ করছে সেগুলোকে চিহ্নিত করে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ। এছাড়া নারী নির্যাতন ও ধর্ষণের জন্য যেসব আইন ও নীতিমালা আছে সেগুলো দ্রুত বাস্তবায়ন করা। অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করতে হবে। প্রচার ও গণমাধ্যমগুলো সচেতনতামূলক কার্যক্রম গ্রহণের পাশাপাশি অপরাধের শাস্তিগুলো তুলে ধরে জনগণকে সচেতন করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। নারীর প্রতি সহিংসতা রোধ করা না গেলে আমাদের উন্নয়ন-অগ্রযাত্রা ব্যাহত হবে।

আন্তর্জাতিক নারী দিবস প্রতি বছর ঘটা করে পালন করা হয়। নারীদের জন্য এটি একটি প্রতীকী দিন। নারীর অধিকার আদায়ের লড়াই আসলে নিত্যদিনের। এবার নারী দিবসের অঙ্গীকার হোক- নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা রোধ করা হবে।

মনজু আরা বেগম : গবেষক; সাবেক মহাব্যবস্থাপক, বিসিক
monjuara2006@yahoo.com

বাংলানিউজসিএ/ঢাকা/৮ মার্চ ২০১৯/ইএন