বাংলানিউজসিএ ডেস্ক :: আমাদের অন্ধকার সময়ে একমুঠো অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী মানুষ ছিলেন। তাদের সবার ছিল অপার্থিব গুণাবলি। কেউ কবিতা লিখতেন, গান বাঁধতেন, সুর তুলতেন, গান গাইতেন, সংবাদ কুড়াতেন, চিকিৎসা করতেন, শিক্ষা বিলাতেন, ঘর বানাতেন, নাটক লিখতেন, চলচ্চিত্র নির্মাণ করতেন, সবুজ ভালোবাসতেন, রাজনীতি করতেন।
সেই সময়ে এরা সবাই একটা বিষয়ে দৃঢ় ঐক্যবদ্ধ ছিলেন- দেশকে ভালোবেসে দেশ স্বাধীন করার সংকল্পের বিশ্বাসে অনড় অবস্থান। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু হয়েছিল তাদের আনাগোনা। ষাটের দশকের আন্দোলন ও যুদ্ধ চলাকালীন তারা এক হয়ে শত্রুর সঙ্গে লড়াই করার জন্য অদৃশ্য শক্তিশালী ঢাল সৃষ্টি করেছিলেন।
যে যার পথে থেকেই তারা এক ধারায় প্রবাহিত হয়েছিলেন, দেশকে স্বাধীন করার প্রত্যয় জলের নদীতে। যে যার মতো দায়িত্ব পালন করে, এক দৃঢ় লক্ষ্যে সফল হওয়ার পরই আমাদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন একটি স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ।
বীরের বেশে তারা অদৃশ্য ঢালের আড়ালে আমাদের বাঁচিয়ে রেখে, চলে গিয়েছিলেন। বেদনার ঘন কুয়াশায় ভর করে তারা নিজেদের জীবন বিলিয়ে দিয়েছিলেন, বাংলাদেশের জন্য, আমাদের জন্য।
সেই অন্ধকার সময়ে আলো ছড়িয়ে দিয়ে গেছেন যারা, তাদের মাঝে কয়েকজনের কথা আজ বলতে এসেছি।
আনোয়ার পাশা
কবি, ভাষাবিদ, ঔপন্যাসিক ও প্রাবন্ধিক। তার সাহিত্যকর্মে ফুটে উঠেছিল দেশাত্মবোধ, মননশীলতা এবং প্রগতিশীল ও অসাম্প্রদায়িক চিন্তা-চেতনা। আনোয়ার পাশার সাহিত্যজীবনের সূচনা ছাত্রাবস্থায়। রাজশাহী কলেজে বিএ পড়ার সময় তিনি ‘হাসনাহেনা’ শিরোনামে একটি রম্যরচনা প্রকাশ করতেন।
বাংলাদেশের স্বাধিকার নিয়ে রচিত প্রথম উপন্যাস ‘রাইফেল রোটি আওরাত’ রচনা করেছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অস্থায়ী প্রভাষক ছিলেন তিনি। পুরো নয় মাস নিজের অবস্থান থেকে একটুও নড়েননি, ভীত হননি।
১৪ ডিসেম্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সাহায্যকারী আলবদরের একটি দল তাকে তার নিজ বিশ্ববিদ্যালয় আবাসন থেকে চোখ বেঁধে নিয়ে যায়। এরপর তুলে দেয় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে। বর্তমান মিরপুর বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় শহীদ অধ্যাপক আনোয়ার পাশাকে।
শহীদুল্লা কায়সার
লেখক, সাংবাদিক, কমিউনিস্ট নেতা। তিনি ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে সরাসরি যোগ দেন এবং ভাষা আন্দোলনে তার রাজনৈতিক ভূমিকার কারণে ১৯৫২ সালের ৩ জুন তিনি গ্রেফতার হন। এ সময় তাকে সাড়ে তিন বছর কারাদণ্ড দেয়া হয়।
১৯৫৫ সালে কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পরপরই পুনরায় গ্রেফতার হন। পরবর্তী সময়ে ছাড়া পেলেও ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর জেনারেল আইয়ুব খান কর্তৃক সামরিক আইন জারি হওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যে ১৪ অক্টোবর তাকে গ্রেফতার করা হয়।
জননিরাপত্তা আইনে তাকে এ পর্যায়ে ১৯৬২ সালের অক্টোবর পর্যন্ত আটক রাখা হয়। শহীদুল্লা কায়সার সমসাময়িক রাজনৈতিক আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছিলেন। ১৯৪৭ সালে তিনি পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগদানের মাধ্যমে রাজনীতিতে প্রবেশ করেন ও ১৯৫১ সালে পার্টির সদস্য হন।
পরবর্তী সময়ে পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন। তিনি ‘দেশপ্রেমিক’ ছদ্মনামে ‘রাজনৈতিক পরিক্রমা’ ও ‘বিশ্বকর্মা’ ছদ্মনামে ‘বিচিত্রা কথা’ শীর্ষক উপসম্পাদকীয় লিখতেন। সংসপ্তক, সারেং বউসহ অনেক উপন্যাস, গল্প-কবিতা লিখে রেখে গেছেন তিনি।
১৪ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় আলবদর বাহিনীর কজন সদস্য তাকে তার বাসা ২৯, বিকে গাঙ্গুলী লেন থেকে ধরে নিয়ে যায়। তারপর তিনি আর আমাদের মাঝে ফিরে আসেননি।
মেহেরুন্নেসা
বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতির জন্য তিনি ভাষা আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। তার কবিতার মধ্য দিয়ে এর পক্ষে মতামত ব্যক্ত করতেন। ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের সঙ্গে তিনি জড়িত হয়ে পড়েন এবং মিরপুরের অ্যাকশন কমিটির সদস্য হন।
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ কবির হৃদয়ে তুলেছিল প্রতিবাদের ঝড়। তাই জয় বাংলা স্লোগান দিতে দিতে ২৩ মার্চ ’৭১ নিজ বাড়িতে তিনি এবং তার দুই ভাইয়ের সহযোগিতায় স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেছিলেন।
২৭ মার্চ ঢাকার মিরপুরে তার বাড়িতে বিহারিদের সঙ্গে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর স্থানীয় সহযোগীরা আক্রমণ করে। কবি মেহেরুন্নেসা, তার দুই ভাই এবং মাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। কবি মেহেরুন্নেসার খণ্ডিত মাথাটি দিয়ে ওরা ফুটবল খেলেছিল।
খেলা শেষে দীর্ঘ কালো কেশগুলো দিয়ে কাপড় শুকানো তারে তার মাথাটি ঝুলিয়ে রেখে গিয়েছিল তারা। সাপ্তাহিক বেগম পত্রিকায় তার মৃত্যুর ঠিক ৪ দিন আগে, ২৩ মার্চ প্রকাশিত হয়েছিল তার লেখা কবিতা, ‘জনতা জেগেছে’।
সিরাজুদ্দীন হোসেন
তিনি ছিলেন দৈনিক ইত্তেফাকের কার্যনির্বাহী ও বার্তা সম্পাদক। এ দেশে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার জনক তিনি। ক্ষুরধার লেখনীর মাধ্যমে দেশের বঞ্চিত মানুষের কথা সংবাদপত্রের পাতায় ফুটিয়ে তুলেছিলেন। মহান ভাষা আন্দোলন, যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন, ছয় দফা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন ও একাত্তরে অবরুদ্ধ নগরী ঢাকায় তার ক্ষুরধার লেখনী তাকে বিশিষ্ট করেছে।
মুক্তিযুদ্ধের সময় ইত্তেফাকের পাতায় তার সাহসিকতাপূর্ণ সম্পাদকীয় ও রিপোর্টের কারণে জামায়াতে ইসলামীর মুখপত্র দৈনিক সংগ্রাম তাকে হুমকিও দিয়েছিল। ‘ঠগ বাছিতে গা উজাড়’, ‘অধুনা রাজনীতির কয়েকটি অধ্যায়’, ‘এতদিনে’ ইত্যাদি তার প্রকাশিত প্রবন্ধ ও সম্পাদকীয়, যা পাকিস্তান রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎহীনতার ইঙ্গিত দেয়।
১৯৪৭ সালের দেশভাগ নিয়ে লেখা তার বই ‘ইতিহাস কথা কও’ বা ‘লুক ইন টু দ্য মিরর’ আমাদের ইতিহাসের এক উল্লেখযোগ্য সংযোজন। ‘চিনিল কেমনে’ কিংবা ‘সুকুইজ্জ্যা কডে’ ধরনের অসংখ্য শিরোনাম তিনি করেছেন, যেগুলো এখনও আলোচনার বিষয় হয়ে আছে।
১০ ডিসেম্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসর আলবদর ও রাজাকার বাহিনীর সদস্যরা সিরাজুদ্দীন হোসেনকে রাজধানীর চামেলীবাগের বাড়ি থেকে অপহরণ করে। তার আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। তিনি ছিলেন একাত্তরের ডিসেম্বরে শত্রুর তালিকাভুক্ত বুদ্ধিজীবী নিধনযজ্ঞের প্রথম শিকার।
ফজলে রাব্বী
তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জয়েন্ট প্রফেসর কার্ডিওলজিস্ট এবং মেডিকেল রিসার্চার ছিলেন। তিনি প্রগতিশীল চিন্তা এবং আধুনিক বাংলা জাতিতে বিশ্বাস করতেন। ২৭ মার্চ ’৭১ ঢাকা মেডিকেলে পাকিস্তানিদের বর্বর অত্যাচারে শত শত নিপীড়িত সাধারণ মানুষ তাকে এবং তার স্ত্রীকে মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করতে সাহায্য করে।
পুরো নয় মাস তারা দুজন অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধা এবং তাদের পরিবার, ধর্ষিতা নারীদের আশ্রয়, চিকিৎসা, সাহায্য করেছেন। তারা ধর্মনিরপেক্ষ ছিলেন, সে কারণে বন্ধুদের মাঝে যারা মুসলিম ছিলেন না, তাদের নিজের মতো করে শত্রু থেকে বাঁচার জন্য ঘিরে রাখতেন। ডাক্তার রাব্বী স্বপ্ন দেখতেন এক স্বাধীন বাংলাদেশের, যেখানে ধর্মনিরপেক্ষতায়, সহ্যসীমায়, সম্মানে, মর্যাদায়, শ্রেণি সমতায়, লিঙ্গ সমতায় মানুষ বসবাস করবে।
১৫ ডিসেম্বর তাকে তার নিজ বাসা থেকে ধরে নিয়ে যায় আলবদর বাহিনীর সদস্যরা। প্রথমে মোহাম্মদপুর ফিজিক্যাল ট্রেনিং ইন্সটিটিউটে রাখা হয়েছিল তাকে। পরবর্তী সময়ে রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে নির্মম অত্যাচারে শহীদ হওয়া তার লাশ পাওয়া যায়।
ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত
বাঙালি আইনজীবী, সমাজকর্মী, ভাষাসৈনিক। তার পরিচিতি মূলত একজন রাজনীতিবিদ হিসেবে। দেশ বিভাগের আগে ভারতীয় উপমহাদেশের ভারত অংশে এবং পরে পূর্ব পাকিস্তানে তিনি রাজনীতিবিদ হিসেবে সক্রিয় ছিলেন।
১৯৪৭ সালের পর অসাম্প্রদায়িক রাজনীতিক হিসেবে পাকিস্তানের রাজনীতিতে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। ১৯৪৮ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদে তিনি সর্বপ্রথম অধিবেশনের সব কার্যবিবরণী ইংরেজি ও উর্দুর পাশাপাশি বাংলাতেও রাখার দাবি উত্থাপন করেন।
পাকিস্তানে পূর্ব পাকিস্তানের জনসংখ্যাই বেশি এবং তারা বাঙালি, সেহেতু অবশ্যই বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তানের সব কার্যাবলির জন্য ব্যবহার করা উচিত এবং পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া উচিত বলে দাবি তোলেন। কিন্তু লিয়াকত আলী খান সাম্প্রদায়িক বক্তব্যের ভিত্তিতে এ দাবি নাকচ করে দেন।
পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি হওয়ার পর ১৯৬০ সালে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের ওপর ‘এবডো’ প্রয়োগ করা হয়। ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় তাকে গৃহবন্দি করে রাখা হয় এবং তখন থেকে তিনি সক্রিয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করা থেকে বিরত থাকেন।
এতৎসত্ত্বেও বাঙালি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত গুরুত্বপূর্ণ বাঙালি নেতাদের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক বজায় রাখতেন। ১৯৭১ সালের ২৯ মার্চ রাতে কুমিল্লার কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী অ্যাডভোকেট আবদুল করিমের তত্ত্বাবধানে ছোট ছেলে দিলীপকুমার দত্তসহ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে গ্রেফতার করা হয় এবং তাদের ময়নামতী সেনানিবাসে নিয়ে নির্মম নির্যাতন করে হত্যা করা হয়।
জহির রায়হান
প্রখ্যাত বাংলাদেশি চলচ্চিত্র পরিচালক, ঔপন্যাসিক এবং গল্পকার। জহির রায়হান ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন এবং ২১ ফেব্রুয়ারির ঐতিহাসিক আমতলা সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন।
ভাষা আন্দোলন তার ওপর গভীর প্রভাব ফেলেছিল, যার ছাপ দেখতে পাওয়া যায় তার বিখ্যাত চলচ্চিত্র ‘জীবন থেকে নেয়া’তে। তার রচিত প্রথম উপন্যাস শেষ বিকেলের মেয়ে ১৯৬০ সালে প্রকাশিত হয়।
অন্য উল্লেখযোগ্য উপন্যাস হল হাজার বছর ধরে ও আরেক ফাল্গুন। তার উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র হল কাচের দেয়াল, বেহুলা, সঙ্গম, আনোয়ারা ও জীবন থেকে নেয়া। তিনি ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানে অংশ নেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি কলকাতায় চলে যান এবং সেখানে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে প্রচারাভিযান ও তথ্যচিত্র নির্মাণ শুরু করেন।
জহির রায়হানের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ‘স্টপ জেনোসাইড’ প্রামাণ্যচিত্রটি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ভয়াবহতার চিত্র তুলে ধরে পৃথিবীর সব দেশে। তার নির্মিত চলচ্চিত্র ‘জীবন থেকে নেয়া’র বেশ কয়েকটি প্রদর্শনী হয় এবং চলচ্চিত্রটি দেখে সত্যজিত রায়, মৃণাল সেন, তপন সিনহা এবং ঋত্বিক ঘটক প্রমুখ ভূয়সী প্রশংসা করেন। সেসময়ে তিনি চরম অর্থনৈতিক দৈন্যের মধ্যে থাকা সত্ত্বেও তার চলচ্চিত্র প্রদর্শনী হতে প্রাপ্ত সমুদয় অর্থ মুক্তিযোদ্ধা তহবিলে দান করে দেন।
জহির রায়হান দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭১-এর ১৭ ডিসেম্বর ঢাকা ফিরে আসেন এবং তার নিখোঁজ ভাই শহীদুল্লা কায়সারকে খুঁজতে শুরু করেন, যিনি স্বাধীনতার ঠিক আগ মুহূর্তে পাকিস্তানি আর্মির এ দেশীয় দোসর আলবদর বাহিনী কর্তৃক অপহৃত হয়েছিলেন।
১৯৭২-এর ৩০ জানুয়ারি জহির রায়হান মিরপুরে গিয়েছিলেন, তার ভাই এবং আলতাফ মাহমুদকে খুঁজতে। এরপর থেকে তার আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি।
আলতাফ মাহমুদ
সঙ্গীতপরিচালক, ভাষাসৈনিক, সংস্কৃতিকর্মী ও মুক্তিযুদ্ধে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা। ভাষা দিবস নিয়ে রচিত আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো গানটির সুরশ্রষ্ঠা তিনি। ১৯৫০ সালে আলতাফ মাহমুদ ঢাকায় আসেন এবং ধূমকেতু শিল্পী সংঘে যোগ দেন।
পরবর্তীকালে তিনি এ সংস্থাটির ‘সঙ্গীত পরিচালক’ পদে আসীন হন। ১৯৫৪ সালে ভিয়েনা শান্তি সম্মেলনে মাহমুদ আমন্ত্রিত হন; কিন্তু করাচিতে পাকিস্তানি সরকার তার পাসপোর্ট আটকে দেয়ায় তিনি সেখানে যোগ দিতে পারেননি। ১৯৬৩ সাল পর্যন্ত করাচিতে ছিলেন এবং ওস্তাদ আবদুল কাদের খাঁর কাছে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতবিষয়ক তালিম নিয়েছিলেন।
এছাড়া তিনি নৃত্যপরিচালক ঘনশ্যাম এবং সঙ্গীতপরিচালক দেবু ভট্টাচার্যের সহকারী হিসেবেও কাজ করেছেন। করাচি থেকে ঢাকা ফেরার পর মাহমুদ ১৯টি বিভিন্ন চলচ্চিত্রে কাজ করেছেন।
এর মধ্যে রয়েছে বিখ্যাত চলচ্চিত্র জীবন থেকে নেয়া, ক্যায়সে কাহু, কার বউ, তানহা, বেহুলা, আগুন নিয়ে খেলা, দুই ভাই, সংসার, আঁকাবাঁকা, আদর্শ ছাপাখানা, নয়নতারা, শপথ নিলাম, প্রতিশোধ, কখগঘঙ, কুচবরণ কন্যা, সুয়োরাণী দুয়োরাণী, আপন দুলাল, সপ্তডিঙ্গা ইত্যাদি।
এছাড়া তিনি রাজনীতি এবং বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংস্থার সঙ্গেও জড়িত ছিলেন। সঙ্গীতে প্রতিভার পাশাপাশি মাহমুদ ছবিও আঁকতে পারতেন। জাতীয় কবি নজরুল ইসলামকে নিয়ে রচিত বর্তমান সময় পর্যন্ত একমাত্র গীতিকাব্য হাজার তারের বীণার সঙ্গীত পরিচালনা করে গিয়েছিলেন।
১৯৫০ সালের পর থেকে ’৭১ পর্যন্ত তিনি দেশ আন্দোলনের পক্ষে সমর্থন আদায়ের জন্য বিভিন্ন জায়গায় গণসঙ্গীত গাইতে যেতেন। গান গাওয়ার মাধ্যমে মাহমুদ গণমানুষের আন্দোলনকে সর্বদাই সমর্থন জুগিয়েছেন।
১৯৭১ সালে আলতাফ মাহমুদ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তিনি ক্র্যাক প্লাটুন গেরিলাদের নিয়ে তার ৩৭০ আউটার সার্কুলার রোড, রাজারবাগ বাসায় গোপন ক্যাম্প স্থাপন করেন। এ বাসাটি যুদ্ধচলাকালীন একাত্তরে দুর্গ হিসেবে পরিচিত হয়।
কিন্তু ক্যাম্পের কথা ফাঁস হয়ে গেলে ১৯৭১ সালের ৩০ আগস্ট পাকিস্তানি বাহিনী তাকে আটক করে। সেসময় তার বাসার পেছনে মাটিচাপা দেয়া দুই ট্রাঙ্ক অস্ত্রসহ তিনি ধরা পড়েন। নাখালপাড়া এমপি হোস্টেলের টর্চার সেলে তার ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালানো হতো, রাতে রমনা থানায় আসামি হিসেবে রাখত। সেই বাসা থেকে আরও অনেক গেরিলাযোদ্ধা আটক হন।
তাদের বাঁচিয়ে এবং বাইরে থাকা পলাতক গেরিলাদের নাম বুকে নিয়ে আরও অনেকের সঙ্গে তিনিও চিরতরে হারিয়ে গেছেন। পরবর্তীকালে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে তার দেশাত্মবোধক গান প্রচারিত হতে থাকে, যা অগণিত মুক্তিযোদ্ধাকে অনুপ্রাণিত করেছিল। এখনও আলতাফ মাহমুদ একুশের সুরে স্বাধীন বাংলাদেশ ছাড়িয়ে বিশ্বজুড়ে ঘুরে বেড়ান প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম আর বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষের হৃদয় মাজারে।
সেলিনা পারভীন
তিনি সাপ্তাহিক বেগম, সাপ্তাহিক ললনা ও শিলালিপি পত্রিকায় সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৪৫ সাল থেকেই তিনি লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৯৫৮ সালে তিনি ঢাকা আসেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলের হল পরিচালক হিসেবে চাকরি নেন।
পরবর্তী সময়ে ললনায় কাজ করার সময় ১৯৬৯ সালে বন্ধু ও শুভানুধ্যায়ীদের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে বের করেন ‘শিলালিপি’ নামে একটি পত্রিকা। তিনি নিজেই এটি সম্পাদনা ও প্রকাশনার দায়িত্ব পালন করতেন। শিলালিপি ছিল সেলিনার নিজের সন্তানের মতো। দেশের প্রায় সব বুদ্ধিজীবীর লেখা নিয়ে প্রকাশিত শিলালিপি সবারই নজর কেড়েছিল। স্বাধীনতার পক্ষের পত্রিকা শিলালিপি।
এই সুবাদে ঢাকার বুদ্ধিজীবী মহলে অনেকের সঙ্গেই ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেন তিনি। ১৯৬৯-এর রাজনৈতিক আন্দোলনে উত্তাল বাংলাদেশ। নিজেও শরিক হন গণঅভ্যুত্থানের আন্দোলনে। ছেলেকে সঙ্গে নিয়েই বেরিয়ে পড়তেন ’৬৯-এর ২১ ফেব্রুয়ারি পল্টনের জনসভায় বা শহীদ মিনার থেকে বের হওয়া নারীদের মিছিলে যোগ দিতে। শরিক হতেন বুদ্ধিজীবীদের প্রতিবাদসভায়ও। অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, শহীদুল্লা কায়সার প্রমুখদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার সুবাদে সমাজতন্ত্রের প্রতিও আগ্রহী হয়ে ওঠেন তিনি।
এরই মধ্যে শুরু হয় ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধের সময় সেলিনা পারভীন ঢাকায় ছিলেন। তার বাসায় মাঝে মাঝে রাত হলে কয়েকজন তরুণ আসতেন। এ তরুণদের সবাই ছিলেন স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা। খাওয়া-দাওয়া করে চলে যাওয়ার আগে এরা সেলিনা পারভীনের কাছ থেকে সংগৃহীত ওষুধ, কাপড় আর অর্থ নিয়ে যেতেন।
শিলালিপির বিক্রয়লব্ধ অর্থ দিয়েই তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করতেন। চারদিকে তখন চলছে আক্রমণ, পাল্টা আক্রমণ, প্রতিরোধ। চারপাশে শুধু বুলেটের শব্দ আর বারুদের গন্ধ, চিৎকার, গোঙানি, রক্তস্রোত আর মৃত্যু। এরই মাঝে ললনা প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম। শিলালিপির ওপরও নেমে আসে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর খড়্গ।
হাশেম খানের প্রচ্ছদ করা একটি শিলালিপির প্রকাশিতব্য সংখ্যা নিষিদ্ধ করে দেয় পাকিস্তান সরকার। পরে প্রকাশের অনুমতি মিললেও নতুনভাবে সাজানোর শর্ত দেয়া হয়। সেলিনা পারভীন বরাবরের মতো প্রচ্ছদ না নিয়ে তার ভাইয়ের ছেলের ছবি দিয়ে প্রচ্ছদ করে আগস্ট-সেপ্টেম্বরের দিকে শিলালিপির সর্বশেষ সংখ্যা বের করেন। কিন্তু এর আগের সংখ্যার জন্যই সেলিনা পারভীন পাকিস্তানি ও তাদের দালালদের নজরে পড়ে যান- যেটাতে ছিল দেশবরেণ্য বুদ্ধিজীবীদের লেখা এবং স্বাধীনতার পক্ষের লেখা। তা-ই কাল হল।
শিলালিপির আরেকটি সংখ্যা বের করার আগে নিজেই হারিয়ে গেলেন। ১৩ ডিসেম্বর ১১৫নং নিউসার্কুলার রোডে তার বাড়িতে থাকত তিনজন মানুষ- তার মা, পুত্র সুমন আর ভাই জনাব উজির। শহরে তখন কারফিউ। রাস্তায় মিলিটারি।
পাকিস্তানি বাহিনীকে আত্মসমর্পণের জন্য বিমান থেকে চিঠি ফেলা হচ্ছে। হঠাৎ দূরে একটা গাড়ির আওয়াজ হল। সেলিনার বাড়ি এসে কড়া নাড়ে তারা। তিনি নিজে দরজা খুলে দেন। লোকগুলো তার পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হয় এবং তারা সেলিনা পারভীনকে তাদের সঙ্গে ধরে নিয়ে যায়। ১৮ ডিসেম্বর সেলিনা পারভীনের ক্ষতবিক্ষত মৃতদেহ পাওয়া যায় রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে। খুব শীতকাতুরে সেলিনার পায়ে তখনও পরা ছিল সাদা মোজা। এটি দেখেই তাকে শনাক্ত করা হয়।
আরও কত শত অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী মানুষের কথা বলা বাকি রয়ে গেল। সবার কথা বলতে গেলে এক মহাকাব্য রচনা হয়ে যাবে জানি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ঝাপসা হলেও তাদের অপার্থিব কাজগুলো বাংলাদেশের ইতিহাসের পাতা ঝলমলে আলোয় আলোকিত করে রেখেছে।
আপনাদের জন্য বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ভালোবাসাময় ঝুড়ি নিয়ে অপেক্ষায় থাকি, আপনাদের সঙ্গে দেখা হলে সব সঞ্চিত ভালোবাসাগুলো তুলে দেব সবার হাতে। অলৌকিক ক্ষমতার মানুষ আলতাফকন্যা আমি, আলোকিত হই সদা, আপনাদের অপার্থিব ভালোবাসায়।
বাংলানিউজসিএ/ঢাকা/ ১৪ ডিসেম্বর ২০১৯ /এমএম