Menu

ভাষা বিলুপ্ত হওয়া মানে পরিচয় হারিয়ে যাওয়া

পিডিশন প্রধান:

ভাষা মানুষের জন্মগত অধিকার, যা সাংস্কৃতিক ও আত্মপরিচয়ের স্বাক্ষর বহন করে। আদিবাসীদের জন্য ভাষা আত্মপরিচয়ের মৌলিক উপাদান হিসেবে ভূমিকা পালন করে। ‘আন্তর্জাতিক আদিবাসী ভাষাবর্ষ ২০১৯’ আদিবাসী ভাষা সংরক্ষণের ক্ষেত্রে একটি স্বীকৃতি।

বলা হয়ে থাকে, এখনই যদি পদক্ষেপ নেয়া না হয় তবে পৃথিবীর এই সাত সহস্রাধিক ভাষার অর্ধেকই হারিয়ে যাবে বা বিলুপ্ত হয়ে পড়বে। এর ফলে মানবসভ্যতা শুধু যে সাংস্কৃতিক সম্পদ হারাবে তাই নয়, এর সঙ্গে সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ লোকায়ত জ্ঞান, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ইত্যাদি হারিয়ে যাবে। আদিবাসী ভাষার ক্ষেত্রে যা পরিণত হবে আরও নিষ্ঠুর সত্যে। ভাষা হারিয়ে যাওয়া মানে পরিচয় হারিয়ে যাওয়া, সংস্কৃতি হারিয়ে যাওয়া; ভাষা বাঁচিয়ে রাখা মানে অতীতকে বাঁচানো এবং ভবিষ্যৎকে সংরক্ষণ। গবেষকরা দেখিয়েছেন, ভাষা বিলুপ্ত হওয়ার বিষয়টি প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণের ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। ভাষা ও প্রথাগত জ্ঞানের মধ্যে একটি মৌলিক সম্পর্ক বিদ্যমান যা জীব-বৈচিত্র্যের সঙ্গে সম্পর্কিত।

প্রকৃতি জগতের জন্য আদিবাসীদের রয়েছে শ্রেণী ও প্রথাগত বিস্তারিত পদ্ধতি, যা পরিবেশের বিষয়ে তাদের গভীর জ্ঞানের পরিচায়ক। এ পরিবেশজ্ঞান নিহিত থাকে আদিবাসী ভাষায় নাম, লোকায়ত ও মৌখিক প্রথাগত জ্ঞানে।

এ সবই হারিয়ে যাবে যদি ভাষা হারিয়ে যায় বা অন্য ভাষায় তা স্থানান্তরিত হয়। বিপন্ন প্রজাতির জীব-বৈচিত্র্য পুনরুদ্ধার ও সংরক্ষণ কাজের সাফল্যে আদিবাসী প্রথাগত জ্ঞান এবং শ্রেণীকরণের সূত্রাবলির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কথা স্বীকার করেছেন নৃতত্ত্ব জীববিজ্ঞানীরা। প্রথাগত জ্ঞান হারিয়ে গেলে মানুষ সব দিক থেকে দরিদ্র হয়ে পড়ে।

বর্তমান বিশ্বের অত্যাশ্চর্য প্রযুক্তির ভিত্তি নিহিত মানুষের জ্ঞান ও সৃষ্টিশীলতার মধ্যে। এ জ্ঞানের ভিত্তি ছিল স্থায়ী এবং মানবজাতি তার ইতিহাসের নব্বই ভাগ সময় অতিক্রম করেছে কথ্য ভাষায়। মৌখিক ভাষার ওপর হাজার হাজার বছর পার করে দেয়া মানুষের ভাষা, জ্ঞান ও তথ্য প্রবহমান ছিল।

স্মৃতিতে সংরক্ষিত ও মৌখিক তথ্যের ওপর ভিত্তি করে মনুষ্য জাতি মহাসাগর পরিক্রমণ করেছে, কম্পাস বা মানচিত্র ছাড়া তারকাপথ বা ঢেউয়ের গতি দেখে অদেখা, অজানা দ্বীপ আবিষ্কার করেছে, সেখানে পৌঁছেছে।

ভাষার লিখিত রূপ ছিল না মানুষের ধারণায়। এ জন্য হয়তোবা বহু ভাষায় বর্ণমালা সৃষ্টি হয়নি। হাওয়াইন ভাষার মতো শক্তিশালী ভাষার লিখিত রূপ মাত্র ৮টি ব্যঞ্জনবর্ণের ওপর প্রতিষ্ঠিত। এরকম পৃথিবীর আরও বহু ভাষা স্বল্পসংখ্যক বর্ণের ওপর চলছে।

বেশ কয়েকটি আদিবাসী জাতির ভাষা ছাড়াও বিশ্বের সর্বোচ্চ ব্যবহৃত অর্থাৎ সবচেয়ে বেশিসংখ্যক মানুষ কথা বলে এমন প্রথম ছয়টি ভাষার পাঁচটির সঙ্গেই আমার পরিচয় হয়েছে। সে অভিজ্ঞতা থেকে অনুভব করেছি ভাষার ব্যবহার, উচ্চারণ ও প্রয়োগের বৈচিত্র্যপূর্ণ রূপ।

মানবজাতির টিকে থাকার ক্ষেত্রে শুধু জেনেটিক বৈচিত্র্যই নয়, বরং জ্ঞানের বৈচিত্র্যের বিষয়টিও অনস্বীকার্য। ভাষা হারিয়ে যাওয়ার বিষয়টি আমাদের জ্ঞান-বিজ্ঞানের জন্য হুমকি হয়ে দেখা দেবে। অর্থনৈতিক সাম্রাজ্য কিছু লোকের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হলেও জ্ঞানের রাজ্যজুড়ে রয়েছে সেসব মানুষ, যারা পৃথিবীর মোট ভাষাগুলোর শতকরা আশি ভাগ ভাষায় কথা বলে।

কোনো ভাষা বা সংস্কৃতিরই ‘প্রতিভার’ ওপর একক আধিপত্য নেই এবং কেউ বলতে পারে না কোথা থেকে পরবর্তী মহৎ উদাহরণ বা চমকে দেয়ার মতো আবিষ্কার আসবে। যে রাষ্ট্রে বহুভাষার বিকাশ লাভ করার সুযোগ থাকে, সে রাষ্ট্রের সৃষ্টিশীল অর্থনৈতিক উন্নতি নিশ্চিত। বাস্তব কারিগরি প্রযুক্তির ক্ষেত্রে উদাহরণ উন্নত ভারত, যেখানে পাঁচশরও বেশি ভাষা প্রচলিত রয়েছে।

২.

ভাষা শুধু আত্মপরিচয়ের প্রকাশ নয়, কেন্দ্রীয় উপাদানও বটে। ভাষা ও সমাজ দৃঢ়ভাবে সম্পর্কিত। বিশ্বায়নের প্রভাব ছাড়াও শিক্ষাব্যবস্থায় ভাষার ব্যবহার না হওয়া অনেক ভাষা হারিয়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ। ভাষা অস্তিত্ব, মর্যাদা, ঐতিহ্য ও জীবনযাপনের একটি মৌলিক বিষয়। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের স্বার্থে ভাষা বাঁচিয়ে রাখতে হবে। আদিবাসী ভাষার সঙ্গে পরিবেশের একটা অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক থাকার কারণে তাদের ভাষা ও সংস্কৃতি রক্ষার জন্য পরিবেশের সংরক্ষণ প্রয়োজন।

পরিবেশের বিপর্যয় ঘটে এমন ধরনের উন্নয়ন কার্যক্রম গ্রহণ করা হলে তা আদিবাসীদের ভাষা ও সংস্কৃতির জন্য হুমকি ডেকে আনবে। ভাষা হারিয়ে গেলে আদিবাসীরা তাদের সংস্কৃতির সঙ্গে সঙ্গে তাদের পূর্বপুরুষের জ্ঞান ও জীবনযাপন পদ্ধতি হারাবে।

জীববৈচিত্র্য, পরিবেশ ইত্যাদির ওপর তাদের যে প্রথাগত জ্ঞান সেটা গ্রথিত আছে তাদের ভাষার মধ্যে। এটি জীববৈচিত্র্য রক্ষায় এবং জলবায়ুর পরিবর্তন রোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে? বস্তুত তাদের ভাষা সংরক্ষণের সঙ্গে পরিবেশ, প্রকৃতি সংরক্ষণের বিষয়টি যুক্ত। টেকসই উন্নয়ন, শান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও আদিবাসী ভাষার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।

জাতিসংঘের আদিবাসী ঘোষণাপত্রে আদিবাসীদের ভাষার অধিকারের কথা বলা হয়েছে। এতে আদিবাসীদের ভাষার ব্যবহার, পুনরুদ্ধার, উন্নয়ন এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেয়ার কথা বলা আছে। জাতিসংঘ গৃহীত আদিবাসী ঘোষণাপত্রের ১৩, ১৪ ও ৩১ অনুচ্ছেদে বলা আছে, আদিবাসীদের তাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য, ভাষা, সাহিত্য, অলিখিত প্রথা, লিখন পদ্ধতি পুনরুজ্জীবন, ব্যবহার, উন্নয়ন এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে হস্তান্তর, নিজস্ব নামকরণ, নিজস্ব ভাষায় শিক্ষাদানের জন্য তাদের সংস্কৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ শিক্ষণ ও পাঠদান পদ্ধতি অনুযায়ী শিক্ষাব্যবস্থা প্রচলন ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন এবং নিয়ন্ত্রণের, তাদের সাংস্কৃতিক কৃষ্টি ও ঐতিহ্য, মুখে মুখে প্রচলিত প্রথা, সাহিত্য, অভিনয়কলাসহ তাদের বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও সংস্কৃতি প্রদর্শন, চর্চা, সংরক্ষণ ও উন্নয়নের অধিকার রয়েছে।

জাতিসংঘের এ ঘোষণার কারণে এর সদস্য-রাষ্ট্রগুলোর ওপরও এর দায় বর্তায়। উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টির মাধ্যমে আদিবাসীদের জন্য নিজ ভাষাচর্চা ও প্রয়োগ এবং তাদের শিশুদের তাদের নিজেদের ভাষায় শিক্ষারব্যবস্থা করা সময়ের দাবি।

এ জন্য জাতীয়ভাবে নীতিমালার প্রয়োজন, যেটা সংখ্যালঘু জাতিগুলোর ভাষার স্বীকৃতিদান ও সংরক্ষণের ব্যবস্থা করবে; এমন সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টি করবে যা প্রতিটি ভাষার প্রতি সম্মান প্রদর্শনসহ নিজ নিজ ভাষাচর্চায় উৎসাহিত করবে এবং এ বৈচিত্র্যকে সম্পদ হিসেবে দেখবে। এ ছাড়াও ভাষা সংরক্ষণের গুরুত্ব বোঝানোর জন্য সচেতনতা সৃষ্টি, বিপন্ন ভাষাগুলোর বিষয়ে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের মাধ্যমে এগুলো চালু রাখার প্রক্রিয়া, মিডিয়ায় তথ্য ও যোগাযোগের ক্ষেত্রে ভাষাগুলোর ব্যবহারের ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন।

এ ছাড়াও জাতীয় শিক্ষানীতিতে বহু ভাষায় শিক্ষা প্রচলনের ব্যবস্থা করে সব বিদ্যালয়ের জন্য সমানুপাতিক হারে বরাদ্দের ব্যবস্থা, অনানুষ্ঠানিক শিক্ষার স্বীকৃতি দেয়া, যা মৌখিক বা প্রথাগত জ্ঞানের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে, ইত্যাদি বিষয় বিবেচনায় নেয়া প্রয়োজন।

আদিবাসীদের জন্য প্রাথমিক পর্যায়ে মাতৃভাষায় শিক্ষা এবং তাদের আকাঙ্ক্ষা পূরণ করে এ ধরনের বিষয় কারিকুলামে অন্তর্ভুক্ত করা এবং মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের জন্য শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন, যা শিশু শিক্ষার্থীদের ড্রপ-আউট কমাতে ব্যাপকভাবে কার্যকর হবে। এমন শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তন করা, যা মাতৃভাষার সহায়ক হিসেবে কাজ করবে। ভারতের মতো

‘জাতীয় জাতিগত সংখ্যালঘু ভাষা কমিশন’ গঠনের পদক্ষেপ নেয়ার কথা বিবেচনায় আনা যেতে পারে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় বহু ভাষাব্যবস্থা থাকা বাঞ্ছনীয়, নতুবা সব মানুষের প্রতি সমবিচার করা সম্ভব নয়।

গণতন্ত্র এবং বহু ভাষাভাষীর ব্যবস্থা পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। ভাষা শুধু পারস্পরিক যোগাযোগের মাধ্যম নয়, এটি মানুষের উত্তরাধিকার, ইতিহাস, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য প্রবহমান রাখার মাধ্যমও বটে। প্রতিটি জাতির ভাষার মূল্য ও অবদান রয়েছে সমগ্র মানবজাতির জন্য।

প্রতিটি ভাষা ইতিহাস, মূল্যবোধ, সাহিত্য, আত্মিক ও জ্ঞানের ভাণ্ডার, যা সময়ের পরিক্রমায় সমৃদ্ধ হয়েছে। একটি ভাষা বিলুপ্ত হলে তার সঙ্গে সংস্কৃতিও চলে যায়। ‘আন্তর্জাতিক আদিবাসী ভাষাবর্ষ ২০১৯’ বিপন্ন ভাষা পুনরুদ্ধার ও সংরক্ষণে একটি প্লাটফর্ম হিসেবে কাজ করতে পারে?


এই বিভাগের আরও সংবাদ