Menu

কবি কামিনী রায় ব্যক্তিগত জীবনের শোক যার কবিতায়

বাংলানিউজসিএ ডেস্ক :: ‘করিতে পারি না কাজ

সদা ভয় সদা লাজ

সংশয়ে সংকল্প সদা টলে

পাছে লোকে কিছু বলে।

আড়ালে আড়ালে থাকি

নীরবে আপনা ঢাকি,

সম্মুখে চরণ নাহি চলে

পাছে লোকে কিছু বলে।’

কবি কামিনী রায়ের ‘পাছে লোকে কিছু বলে’ কবিতাটি এখনো কথা, কাজে সর্বত্র মানুষের মুখে মুখে ঘুরে। এ কবিতার আবেদন থাকবে যুগ যুগ। অসাধারণ এক কবিতা।

কবি ও সমাজকর্মী কামিনী রায় একজন প্রথিতযশা বাঙালি কবি, সমাজকর্মী এবং নারীবাদী লেখিকা। তিনি তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের প্রথম মহিলা স্নাতক ডিগ্রিধারী ব্যক্তিত্ব। তিনি এক সময় ‘জনৈক বঙ্গমহিলা’ ছদ্মনামে লিখতেন।

\হকামিনী রায়ের জন্ম ১৮৬৪ খ্রিস্টাব্দের ১২ অক্টোবর পূর্ববঙ্গের (বর্তমান বাংলাদেশের) বাকেরগঞ্জের বাসন্ডা গ্রামে (বর্তমানে যা বরিশাল জেলার অংশ)। এক মধ্যবিত্ত শিক্ষিত বৈদ্য পরিবারে কামিনী সেনের জন্ম।

তার পিতা চন্ডীচরণ সেন একজন ব্রাহ্মণধর্মাবলম্বী, বিচারক ও ঐতিহাসিক লেখক ছিলেন। ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দে চন্ডীচরণ ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষা লাভ করেন। পরের বছর স্ত্রী-কন্যাও কলকাতায় তার কাছে ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষিত হন। তিনি ব্রাহ্ম সমাজের বিশিষ্ট নেতা ছিলেন। তার বোন যামিনী সেন লেডি ডাক্তার হিসেবে খ্যাতি লাভ করেছিলেন। তার পিতার ভাবধারা শিশুমনে যথেষ্ট প্রভাব ফেলে। বাড়িতে কোনো অতিথি এলে কামিনী রায়ের পিতার শেখানো শ্লোক শোনাতে হতো।

কন্যা কামিনী রায়ের প্রাথমিক শিক্ষার জন্য ১২ বৎসর বয়সে তাকে স্কুলে ভর্তি করে বোর্ডিং এ প্রেরণ করেন। তবে চার বছর বয়সে প্রথম লেখাপড়ার হাতেখড়ি হয় তার মায়ের কাছে। তিনি কলকাতার বেথুন ফিমেল স্কুল থেকে এন্ট্রান্স (১৮৮০), বেথুন কলেজ থেকে এফ এ (১৮৮৩) এবং সংস্কৃতে অনার্সসহ বিএ (১৮৮৬) পাস করেন।

স্নাতক ডিগ্রি অর্জনের পর ১৮৮৬ সালেই তিনি বেথুন কলেজের স্কুল বিভাগে শিক্ষয়িত্রীর পদে নিযুক্ত হন।

যে যুগে মেয়েদের শিক্ষা বিরল ঘটনা ছিল, সেই সময়ে কামিনী রায় নারীবাদে বিশ্বাসী ছিলেন। তার অনেক প্রবন্ধেও এর প্রতিফলন ঘটেছে। তিনি নারী শ্রম তদন্ত কমিশন (১৯২২-২৩) এর সদস্য ছিলেন।

\হশৈশবে তার পিতামহ তাকে কবিতা ও স্তোত্র আবৃত্তি করতে শেখাতেন। এভাবেই খুব কম বয়স থেকেই কামিনী রায় সাহিত্য রচনা করেন ও কবিত্ব-শক্তির স্ফুরণ ঘটান। তার মাও তাকে গোপনে বর্ণমালা শিক্ষা দিতেন। তিনি স্বল্প শিক্ষিতা ছিলেন। কারণ তখনকার যুগে হিন্দু পুরমহিলাগণের লেখাপডায় শিক্ষা লাভ করাকে একান্তই নিন্দনীয় ও গর্হিত কাজ হিসেবে বিবেচনা করা হতো।

কামিনী রায় মাত্র ৮ বছর বয়স থেকে কবিতা লিখতেন। রচিত কবিতাগুলোতে জীবনের সুখ-দুঃখ, আশা-আকাঙ্ক্ষা, আনন্দ- বেদনার সহজ-সরল ও সাবলীল প্রকাশ ঘটেছে। ১৮৮৯ খ্রিস্টাব্দে পনেরো বছর বয়সে তার প্রথম কাব্য প্রন্থ আলো ও ছায়া প্রকাশিত হয়। এ গ্রন্থটির ভূমিকা লিখেছিলেন হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু প্রথমে এতে গ্রন্থের লেখক হিসেবে কামিনী রায়ের নাম প্রকাশিত হয়নি। গ্রন্থটি প্রকাশিত হলে তার কবি খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। তার লেখা উলেস্নখযোগ্য কাব্যগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে –

\হআলো ও ছায়া (১৮৮৯) নির্মাল্য (১৮৯১) পৌরাণিকী (১৮৯৭) মাল্যও নির্মাল্য (১৯১৩) অশোক সঙ্গীত (সনেট সংগ্রহ, ১৯১৪) অম্বা (নাট্যকাব্য, ১৯১৫) দীপ ও ধূপ (১৯২৯) জীবন পথে (১৯৩০) একলব্য, দ্রোণ-ধৃষ্টদু্য ও শ্রাদ্ধিকী।

অমিত্রাক্ষর ছন্দে রচিত মহাশ্বেতা ও পুন্ডরীক তার দুটি প্রসিদ্ধ দীর্ঘ কবিতা। এ ছাড়াও ১৯০৫ সালে তিনি শিশুদের জন্য গুঞ্জন নামের কবিতা সংগ্রহ ও প্রবন্ধ গ্রন্থ বালিকা শিক্ষার আদর্শ রচনা করেন।

কামিনী রায় সব সময় অন্য সাহিত্যিকদের উৎসাহ দিতেন। ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি বরিশাল সফরের সময় কবি সুফিয়া কামালকে লেখালেখিতে মনোনিবেশ করতে বলেন।

তার কবিতা পড়ে বিমোহিত হন সিবিলিয়ান কেদারনাথ রায় এবং তাকে বিয়ে করেন। বিয়ের পর কবিতা লেখা ছেড়ে দিয়ে বলেছিলেন সংসারই আমার কবিতা। ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে কামিনী রায়ের স্বামীর অপঘাতে মৃতু্য হয়েছিল ও তার সন্তানরাও পর পর মারা যায়। স্বামী ও সন্তানদের হারিয়ে তিনি আবার কবিতা লেখা শুরু করেন। সেই শোক ও দুঃখ তার ব্যক্তিগত জীবনে ব্যাপক প্রভাব ফেলে, যা তার কবিতায় প্রকাশ পায়। তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও সংস্কৃত সাহিত্য দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। তারপরেও তার নিজস্ব একটা লেখার ঢং ছিল। তা তার রচনা পড়লেই বোঝা যায়।

১৯২৯ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক কামিনী রায়কে ‘জগত্তারিণী স্বর্ণপদক’ প্রদান করে সম্মানিত করেন। তিনি ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গীয় লিটারারি কনফারেন্সের সভাপতি হিসেবে নির্বাচিত হন। ১৯৩২-৩৩ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদেরও সহসভাপতি ছিলেন কামিনী রায়।

জীবনের শেষ ভাগে তিনি হাজারীবাগে বাস করেছেন। ২৭ সেপ্টেম্বর, ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দে তার জীবনাবসান ঘটে।

বাংলানিউজসিএ/ঢাকা/ ১১ অক্টোবর ২০১৯/ এমএম


Array