Menu

বায়াজীদ গালিব :: মেয়েদের বয়স ও ছেলেদের বেতন কত, তা নাকি জিজ্ঞেস করতে নেই। একজন কমিয়ে বলবে আরেকজন বাড়িয়ে। প্রবাদ আছে না! পুরুষ মানুষের আবার বয়স, মেয়েরা নাকি কুড়িতেই বুড়ি। এত বড় স্পর্ধা! উত্তর অ্যামেরিকায় মেয়েরা জীবন শুরু করেই চল্লিশে, তাহলে কুড়িতে বুড়ি হবে কেন? আসলে গ্রাম দেশের প্রবাদ তো, আগে মেয়েদের বাল্য বিবাহ হতো তাই কুড়ি বছরের মধ্যে কয়েক সন্তানের মা হয়ে যেতো, সে জন্যেই বলা হতো কুড়িতে বুড়ি। মাঘ মাসের বয়ান কি আর জ্যৈষ্ঠ মাসে খাটে? দিন বদলাচ্ছে না! বয়স নিয়ে কেন এত ভাবনা!
আমাদের উপমহাদেশে বিয়ের ব্যাপারের মেয়েদের বয়স ছেলেদের চেয়ে কম থাকে। আর সে কারনেই মেয়েরা আরও ছোট সেজে থাকতে চায়। ছেলেদের বয়স বেশি থাকার কারণ হল মানব প্রজাতিতে মেয়েদের তুলনায় ছেলেদের পরিণত হতে দুই থেকে তিন বছর বেশি সময় লাগে। এদের মধ্যে অনেক দেশে ডাক্তারি পরীক্ষায় প্রমাণিত বয়ঃস্বন্ধিকেই বিয়ের বয়স হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়।
ইন্টারনেটের যুগে যে কোন তথ্য খুবই সহজেই পাওয়া যায়। কিছু একটা হলেই বলা হয় গুগল করে দেখো। সে সুবাদে গুগলের বদৌলতে বিভিন্ন দেশের ছেলে ও মেয়েদের বিয়ের বয়সের একটা তথ্য পেয়ে গেলাম। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিয়ের বয়সের আইনি অনুমতি ছেলেদের জন্য সর্বনিম্ন ১৫ থেকে সর্বোচ্চ ২২ এবং মেয়েদের জন্য সর্বনিম্ন ১৪ থেকে সর্বোচ্চ ১৯। তবে সৌদি আরব ও ইয়েমেনে বিয়ের জন্য কোন বয়সসীমা নির্ধারিত নেই। এদের মধ্যে অনেক দেশে ডাক্তারি পরীক্ষায় প্রমাণিত বয়ঃস্বন্ধিকেই বিয়ের বয়স হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়। অধিকাংশ দেশেই বাবা-মায়ের অনুমতির প্রয়োজন হয়। তবে ইন্দোনেশিয়া জর্দানসহ বেশ কিছু দেশে বাবা-মায়ের অনুমতি নিয়ে নির্ধারিত বয়সের নিচেও বিয়ে করা যায়। বাংলাদেশে বিয়ের সর্বনিম্ন বয়স মেয়েদের জন্য ১৮ বছর এবং ছেলেদের জন্য ২১ বছর। ২০১৪ সালের ১৫ই সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ সরকারের সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে বাংলাদেশে বিয়ের বয়স ছেলেদের জন্য ১৮ এবং মেয়েদের জন্য ১৬ কে অনুমোদন দেয়ার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হলেও পরবর্তীতে তা বাতিল হয়। ২০১৬ সালের ২৫শে নভেম্বর বাংলাদেশ সরকার মেয়েদের জন্য বিশেষ ক্ষেত্রে (পিতামাতার সম্মতি এবং আদালতের অনুমতিক্রমে) ১৮ বছরের নিচে বিয়ের অনুমতিসহ বিয়ের বয়স পুনরায় ১৮ বছর নির্ধারণ করে।

তবে সে যাহোক, বয়স এমনই একটা ভাবনা যা ছোট বেলায় বাড়ানোর আকাংখা, আর বয়সকালে যত কমানো যায় ততই মানসিক শান্তি। ছোট বেলায় সবসময় ভাবতাম কবে লেখা পরা শেষ করে চাকরি বাকরি, বা ব্যাবসা বানিজ্য করে সংসার করবো। এর কারন সম্ভবত, ছোট্ট বয়সে বাবা মাকে দেখে সংসার করার ইচ্ছে জাগে সবার মনে। আর সে কারনেই পুতুল খেলা, পুতুলের বিয়ে এসব ছোট বেলার খেলার বিষয় হয়ে উঠে। পরবর্তীতে যখন স্কুল জীবনে প্রবেশ করা হয় তখন পুতুল খেলার ইচ্ছে ধীরে ধীরে শেষ হতে থেকে। লেখা পরস শেষ করে সংসারের জোয়াল যখন ঘারে পড়ে তখন আর সামনে বাড়তে ইচ্ছে হয় না। দিন যায় ভাল আসে খারাপ।
আমি তখন পাবনা রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুলে ভর্তি হয়েছি, (পরবর্তীতে ওটা ক্যাডেট কলেজ হয়ে যায়)। আমরাই ছিলাম ঐ স্কুলের প্রথম ব্যাচ। আমি সপ্তম শ্রেণীতে ভর্তি হলাম। ওই স্কুল শুরুই হয়েছিলো ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণী দিয়ে। যা হোক, আমাদের উপরের ক্লাসের একজন ভদ্রলোক ছিলেন তার নাম রফিকুল্লাহ। যিনি তিন বছর বয়স কমিয়ে অষ্টম শ্রেণীতে ভর্তি হয়েছিলেন। তখন থেকেই তিনি দাড়িগোঁফ কামাতেন, তাই বড় ভাইরা তাকে ‘ম্যান’ বলে ডাকতো। আর আমরা ডাকতাম ‘ম্যান ভাই’।

আমরা যখন এস এস সি পরীক্ষা দিব, প্রবেশ পত্রে দেখলাম আমাদের সবার বয়স কমানো হয়েছে ৬ মাস থেকে এক বছরের মত। সবাই খুব ক্ষিপ্ত হয়ে হেড ক্লার্কের কাছে গেলাম কারন ব্যখ্যা করার জন্য। তার ব্যাখ্যা শুনে সবার মেজাজ আরও সপ্তমে। বলে কি? এতে না কি সরকারি চাকুরীর বয়স সীমা বেশী থাকবে। একটা নির্দিষ্ট জন্ম মাস, অধিকাংশ ছেলেদের জন্মদিন হয়েছে এখন ১ জানুয়ারিতে। নিকুচি করি সরকারি চাকুরীর, আমার জন্ম মাস ও রাশিচক্র সম্পূর্ণ আলাদা হয়ে গেলো! আমাদের প্রায় সবারই এখন দুইটা জন্মদিন। একটা এস এস সি সার্টিফিকেট এর জন্মদিন আর একটা আসল জন্মদিন। কিন্তু কাগজে লেখা সার্টিফিকেটের জন্মদিন এতই শক্তিশালী যে আসল জন্মদিন আর কেউ বিশ্বাস করে না।
একটা সচরাচর ঘটনা প্রায় সবার জীবনেই আসে, যখন ছেলে বা মেয়ের বয়স চার/পাঁচ বছর হয়। আমার মেয়ের বয়স যখন পাঁচ বছর, তখন রবীন্দ্রনাথের মিনির মত অনর্গল কথা বলতো। এই সময় শিশুদের মনে নানা প্রশ্ন জাগে বলেই তারা হয়তো এত কথা বলে। আমার সাথে গল্প করতে করতে প্রায়ই সে বলতো, ‘আমি যখন ছোট ছিলাম’। বলে কি পুচকি! ওরও নাকি আবার ছেলেবলা ছিল।
বয়স সবাইকে ভাবিয়ে তোলে, স্রোতস্বিনী নদনদী যেমন প্রবল বেগে ধাবিত হয়, সময়ও ঠিক তেমন। তর তর করে বয়স বেড়েই চলছে। এই সময়ের মধ্যে কত ঘাটে যে থেমেছে তার কোন হিসেব নেই। বয়স বাড়া মানেই জীবনের পরিণতির দিকে এগিয়ে যাওয়া। বয়স বাড়তে থাকলে, আয়নায় যখন কিছু কিছু পাকা চুল দেখা যায়, তখন বয়সের চিন্তা আরও বেড়ে যায়।
পাকা চুলের একটা ঘটনা মনে পরে গেলো। বাংলাদেশে সাধারণত শীতকালে ব্যাডমিন্টন খেলা হতো। আমরাও খেলতাম কাঁঠালবাগানের সহপাঠী বন্ধুর বাসায়। ওর বড় ভাইও আমাদের সাথে খেলতেন। তাঁর খেলা অবশ্যই আমাদের জন্য বড় আশীর্বাদ ছিল, কারন ব্যাডমিন্টনের সবচেয়ে বড় ব্যয় ছিল কর্ক বা ফেদার। আর উনি এর ব্যয়ভার আনন্দের(?) সাথেই বহন করতেন, আমাদের কাজ ছিল শুধুই খেলে যাওয়া। যা হোক ওর বড় ভাইয়ের চুলদাড়ি পেকে গেলো অল্প বয়সেই। একদিনের ঘটনা। আমরা সবাই খেলছি এমন সময় তাঁর এক মামা এলেন বেড়াতে উনিও অনেক দিন ভাগ্নেদের দেখেন নাই। আমরা তখন খেলছিলাম। বড় ভাইয়ের পাকা চুলদাড়ি দেখে অবাক হয়ে জিগ্যেস করলেন, আরে ভাইগ্না! তুমি শাদা কলপ পেলে কোথায়! উনি খেলা বাদ দিয়ে বেশ কিছুক্ষণ দম মেরে বসে ছিলেন। হাসবেন না কাঁদবেন!
ছাত্র জীবনে সবচেয়ে সুখের দিন কেটেছে বিশ্ববিদ্যালয়ে। আমরা অপ্ল কিছুদিনের মধ্যেই বিভিন্ন বিভাগের কিছু সহপাঠী খুবই ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়ে গেলাম। যাকে বলে হাঁড়ির বন্ধু। আসলে আমরা এক হাঁড়িতেই খাওয়া দাওয়া করতাম। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই সবার নাম করন হয়ে গেলো। মুদাম, হুদাই, গুদ্রি, ম্যাজো, ধাইনো, উস্টুঙ্গা, বগা, চাচা, ভাম ইত্যাদি ইত্যাদি। বন্ধুদের মধ্যে চাচা ছিল খুবই ভাব গম্ভীর, সেকারণেই আমরা চাচা ডাকতাম। এতে চাচার মনে কোন দুঃখ ছিল কি না জানিনা। অবশ্য দুঃখ থাকলেও আমাদের কিছু যায় আসে না। চাচা কইছি তো কইছিই। ভদ্রলোকের এক কথা। ভানুর ভাষায় ‘জেন্টল ম্যান ওয়ান ওয়ার্ড’। চাচার বিয়ের পর বৌভাতে আমরা সবাই তাঁকে চাচা আর তাঁর বউকে চাচি ডাকতে লাগলাম। বিপত্তি দেখা দিলো। চাচি বেশ রাগান্বিত হয়ে চাচা ডাকার কারন জিগ্যেস করলো। আমরা বললাম চাচা তো আমাদের চেয়ে বয়সে অনেক বড় তাই চাচা ডাকি। পরিনতিতে চাচাকে অনেক দিন ভুগতে হয়েছিল। অন্যদিকে আমাদের সবার প্রিয় বন্ধু মুদাম বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুন জীবন থেকেই আমাদেরকে তাঁর নিজের সম্পর্কে বলত, আর কত, বয়স ত কম হোল না।

বন্ধু ভাম অনার্স পরীক্ষার পর আই টুয়েন্টি নিয়ে স্বপ্নের দেশ যুক্তরাষ্ট্রে পারি দিলো। ওখানে বসবাসের বন্দোবস্ত করতে বেশ কয়েক বছর কেটে গেলো। তারপর বাংলাদেশে এলো বিয়ে করতে। আমরা সবাই তখন বাবা হয়ে গেছি, কারো কারো ছেলেমেয়ের বয়স ছয় সাত বছর হয়ে গেছে। আমরা বিলুকে পেয়ে তো মহা খুশি। অনেকদিন পর বিয়ের আনন্দে সবার বয়স যেন কমে গেলো। আড্ডার ফাঁকে এক বন্ধু বলেই বসলো, দোস্ত এখন আর বিয়ে টিয়ে করিসনা। ভাম অবাক হয়ে বলল, কেন? বন্ধুটি বলল, দেখ সব কিছুরই একটা মেয়াদ বা এক্সপায়ারি ডেইট থাকে, আর কোন জিনিস যখন এক্সপায়ার হয়ে যায় তা হয়ে যায় বিষ বা পয়জন। সুতরাং তোকে যে বিয়ে করবে সে বেচারি বিষক্রিয়ায় মারাই যাবে, বিয়ে বাদ দে। ভাম তো মহা ক্ষ্যাপা। তখন আরেক বন্ধু, বলল চেতিস না দোস্ত। তুই ব্যাপারটা এ ভাবে চিন্তা কর। তুই বিয়ে করে বাচ্চা কাচ্চা নিলে, ওরা যখন একটু বড় হবে, তখন খেলাচ্ছলে তোর মানিব্যাগ নিয়ে দৌড় দিলে তোর আরেক জনের সাহায্য নিতে হবে, ‘ভাইসাব, পোলাডারে একটু ধইরা দেন না প্লিজ। সে যাই হোক ভাম তো নাছোড়বান্দা, বিয়ে সে করবেই। বিয়ের আগেরদিন লক্ষ্য করলো হুদাই নামক বন্ধুর চুল দাড়ি পেকে গেছে। একটু উদ্বিগ্ন হয়ে বলল, ওস্তাদ তুমি আমার বরযাত্রী তে যাইও না, শ্বশুর পক্ষ ভাবতে পারে জামাই বুইড়া।
আমার মামাতো ভাই বিয়ে করতে দেরি করছিলেন। তাই তাঁর ফুফু মানে আমার খালা তাকে বিয়ের জন্য পিড়াপিড়ি করতেন। বলতেন, ‘বয়স হয়ে যাচ্ছে, আর কবে বিয়ে করবি’? উনি বিয়ের কথা শুনতে শুনতে অতিষ্ঠ। একদিন বলেই বসলেন, ফুফু, আমার বন্ধুরা যারা বিয়ে করেছে, তারাই এখন বউ ফেরৎ দেওয়ার চিন্তা ভাবনা করছে, আমি আর নতুন করে বিয়ে করি কেমন করে!
আমার বিয়ের পর বুইড়া শব্দের সাথে বেশ পরিচিত হয়ে গেলাম। আমার স্ত্রীর সবচাইতে বড় ভাইকে ওরা বুইড়া ডাকে। এই রহস্যজনক ডাকের কারন আমি কখনো জিগ্যেস করি নাই। এর জন্য ওনার মনে কি নিজের অজান্তে কোন দুঃখ আছে? নাকি ছোট ভাই বোনের এই আদুরে ডাক উনি উপভোগ করেন? জানা হয় নাই।

সবাই বলে বয়স বাড়ে আমি বলি কমে রে। বয়স কমুক আর বাড়ুক সেটা বিষয় না। বিষয় হচ্ছে বয়স যখন স্থির হয়ে থাকে। বয়স বাড়লেও রবীন্দ্রনাথ শেষ বয়সেও যে সব প্রেমের গান আর কবিতা লিখেছেন তা পড়লে তো আর তাঁকে বুড়ো ভাবাই কঠিন হয়ে যায়। তাঁর গানে, গল্প, কবিতা আর উপন্যাসে তরুন হয়ে আছেন। জীবনকে এক যায়গায় স্থির রেখেছেন তাঁর গান, কবিতা আর গল্প উপন্যাসে। কবিদের শারীরিক বয়স বাড়লেও মানসিক ভাবে তারা সবসময়ই তরুণ। কিন্তু আমি একজনকে দেখেছি, তিনি অবশ্য কবি না। কিন্তু সেই মহিলা গর্বের সাথে তাঁর মানসিক বয়সকে এক যায়গায় আটকে রেখেছেন এখন পর্যন্ত। শারীরিক বয়স আটকানো যদিও সম্ভব হয় নাই। সেই ভদ্রমহিলার বয়স চল্লিশে গিয়ে আটকে গেলো। উনি প্রতি বছরই বলতেন, আর কত বয়স তো চল্লিশ হয়ে গেলো। এভাবে প্রায় দশ বারো বছর পার হয়ে গেলো, কিন্তু ভাবি চল্লিশের ঘর আর পার হতেই পারলেন না। যদিও চোখের কনে বা গলার ভাজ তিনি আটকাতে পারলেন না কিন্তু মানসিকভাবে চল্লিশেই আটকে রইলেন। প্রায় ছয়/সাত বছর আগে বাংলাদেশে বেড়াতে গিয়েছি। তখন তাঁর মেয়ের বিয়ের দিন তারিখ পাকা হয়েছে। ভাগ্যগুণে আমিও মেয়ের বিয়ের দাওয়াত পেলাম। বিয়ে বাড়িতে আমাদের এক বন্ধু অতি উৎসাহে ভাবিকে বলল, ‘আপনি মাত্র চল্লিশ বছর বয়সে শাশুড়ি হয়ে গেলেন’! সেদিন ভাবির অগ্নি দৃষ্টি আমাদের বন্ধুকে যে ভাবে দহন করেছিলো তা দেখে আমাদের আত্মারাম খাঁচা ছাড়া। বিয়ে বাড়ি বলে রক্ষা, না হলে একটা হেস্তনেস্ত হয়েই যেতো। শুনেছি এখন ওনার নাতি হয়েছে, এখন তাহলে কি বলা যাবে? ‘বাহ আপনি মাত্র চল্লিশ বছরেই নানি হয়ে গেলেন’?

তবে আমাদের বন্ধু নার্গিস তার বয়স সত্যি এক জায়গায় দাঁড় করিয়েছে। তার আগে নার্গিসের বর রাজি ভাইয়ের কথা বলতেই হয়। আমাদের সকলের প্রিয় একজন ব্যক্তিত্ব। কিছুদিন আগে তার অকাল মৃত্যু হয়েছে। এতো সুন্দর একজন মানুষের এত তাড়াতাড়ি না ফেরার দেশে চলে যাবেন ! ভাবতেই পারি না। রাজি ভাই আমাদের একজন খুব ভালো বন্ধুও ছিলেন। তার বাসায় আমরা প্রায়ই আড্ডা দিতে যেতাম তা তিনি খুবই পছন্দ করতেন। উনি খুবই হিউমারাস ছিলেন।প্রথম যখন তার বাসায় যাই, তার বাসার দরোজায় নাম ঝুলানো দেখেই বুঝেছিলাম যে তিনি অত্যন্ত একজন রসিক মানুষ। সেখানে লেখা ছিল নার্গিস রাজী। আমি বললাম আপনি তো আপনার নামটাও আগে লিখতে পারতেন। উত্তরে বলেছিলেন, তা লেখা যেত, কিন্তু আমি লক্ষ্য করে দেখেছি যে তোমাদের বন্ধু নার্গিস সবসময়ই রাজি, তাই ওভাবেই লিখেছি। নার্গিসের দুই মেয়ে বড় হতে হতে লম্বায় মা’কে ছাড়িয়ে গেলো, তিনজন একসাথে দাঁড়ালে মনে হতো না যে ওরা মা-মেয়ে। আমি একদিন প্রশংসার সুরেই জিজ্ঞেস করেছিলাম এতো সুন্দর ফিগার কি ভাবে মেইনটেইন করো ? তার উত্তর রাজী ভাই দিলেন, ‘ মেইনটেনেন্স কস্ট খুব হাই, আর সে জন্যই সম্ভব হচ্ছে’। ক্যালগেরিতে আমাদের সবার প্রিয় কাজী মাহফুজুল হক মিনু ভাই। মিনু ভাইকে আমি ক্যালগেরিতে আসার পর একই রকম দেখছি। বয়স জেনো এক জায়গায় আটকে রেখেছেন। তার স্ত্রী মুন্নি আপার বয়স বাড়ছে মানে বয়সের ছাপ পড়ছে তার চোখে মুখে। (মুন্নি আপা যদি এই লেখা পড়েন তাহলে আমার সর্বনাশ, তিনি তার স্নেহ থেকে আমাকে স্থায়ীভাবে বহিস্কার করবেন এটা আমি নিশ্চিত, কি আর করা যাবে তাই বলে তো আর পাবলিকের মুখ বন্ধ রাখা যাবে না ) কিন্তু মিনু ভাই একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছেন।কোনো এক অনুষ্ঠানে এ নিয়ে আমরা আলোচনা করছিলাম।তখন রূপক দা বললেন, ‘ বুঝলেন না ভাই, মিনু ভাই হচ্ছে ফর্মালিন দেওয়া, একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছেন’।
কোন ছেলেকে যদি কোন মেয়ে আঙ্কেল ডাকে তাতে কন এক অকারণে ছেলেটির মন খুবই খারাপ হয়ে যায়। কারন মেয়েদের চোখে সে একজন মুরুব্বী। আর যে মেয়েদের বয়স চল্লিশের কোঠায় তাকে আন্টি ডাকলে তো সব শেষ। বয়সের ব্যাপারে পুরুষ আর মহিলা এক। যেমন দুই বাঙ্গালী তিন দল করে। দুইজনের দুই দল, আবার দুইজনের এলাইন্সে আরেকটা দল। ঠিক পুরুষ মহিলা দুই দল, আবার বয়সের ক্ষেত্রে একজোট হয়ে তৃতীয় দল। আঙ্কেল আনটি সম্মন্ধন জনিত একটা ঘটনা মনে পরে গেলো। তখন আমি টরেন্টোতে বসবাস করি। সেই সময়ে একজন তরুণী আমাদের সবাইকে আঙ্কেল বলত। এটা খুবই স্বাভাবিক হলেও কারো কারো মনে দুঃখ ছিল। আঙ্কেলের মত বয়স হয়েছে এই ভেবে। আসলেই তো তাই, মেঘে মেঘে অনেক বেলা হয়ে গেছে। নতুন প্রজন্ম বড় হচ্ছে সেই সাথে আমাদের বুড়ো বানিয়ে দিচ্ছে। সে যাই হোক সবচেয়ে মজার ব্যাপার ছিল যে, সেই মেয়ে আমাদের এক বড় ভাই কে আঙ্কেল না ডেকে ভাইয়া ডাকতো। এতে সবাই ঈর্ষান্বিত হলেও বড় ভাই মহা আনন্দিত। তাঁর আনন্দ আর গদ গদ ভাব কেমন যেন প্রেম পর্যায়ের দিকে আগাচ্ছিল (অবশ্য এক তরফা, ছাত্র জীবনে আমরা বলতাম ওয়ান সাইডেড লাভ, এবং যারা এমন তাঁদের বলতাম OSLA এর সদস্য। OSLA মানে One Sided lover’s association)। আমাদের বড় ভাইয়ের ব্যাপারটাও অনেকটা তেমন। ব্যাপার কি? উনি আমাদের চেয়ে অন্তত পাঁচ বছরের বড়, তারপরও ওনাকে ভাইয়া আর আমাদের আঙ্কেল! বিষয়টা কেউ সহজভাবে নিতে পারছিল না। সবার মনেই কিছু না কিছু অভিমান বাস্পায়িত হয়ে উস্মায় পরিনত হচ্ছিল দিন দিন। এর একটা বিহিত করতেই হবে। সে বছরই এলো চরম সুযোগ। এখন যৌবন যার পিকনিকে যাবার সময় তার। অবশ্য শারীরিক ভাবে বুড়া হলেও মানসিক ভাবে যুবক। সেই পিকনিকে সবার উপস্থিতিতে এক বয়স্ক যুবক, সেই মেয়েটিকে একটু অভিমান ও উষ্মা মিশ্রিত কণ্ঠে জজ্ঞেস করল, ‘জসিম ভাইকে ভাইয়া ডাকো আর আমাদের কেন আঙ্কেল ডাকো? এটা কেমন কথা! উনি তো আমাদের চেয়ে বয়সে অনেক বড়। এই বিশেষ ডাকের কি বিশেষ কোন কারন আছে’? মেয়েটি মহা আনন্দের সাথে এর কারন ব্যখ্যা দিল, ‘আমরা দাদা- নানা কে সাধারণত ভাইয়া বলি, উনি তো আমার নানার মত তাই ভাইয়া ডাকি’।

বাংলানিউজসিএ/ঢাকা/১ অক্টোবর ২০১৯/এমএম


Array