বাংলানিউজসিএ ডেস্ক :: শিক্ষা মানুষের মৌলিক অধিকার। শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড। কিন্তু বিশ্বায়ন আর পুঁজিবাদী অর্থনীতির জাঁতাকলে নিষ্পেষিত ভোগবাদী অর্থনীতিতে বাংলাদেশে শিক্ষা বর্তমানে মৌলিক অধিকারবঞ্চিত হয়ে ধনিক শ্রেণির মৌলিক বিলাসী পণ্যে পরিণত হয়েছে।যারা শিক্ষা নিয়ে ব্যবসা করে এটি তাদের কাছে একটি আকর্ষণীয় পণ্য। মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির বিভিন্ন আকর্ষণীয় পণ্যের মতো বিভিন্ন নামে, নানা ধরনের লেবেল লাগিয়ে চটকদার বিজ্ঞাপন দিয়ে শিক্ষাকে বাজারজাত করা হচ্ছে।
আর হুজুগে বাঙালি রঙিন মোড়কে আকৃষ্ট হয়ে চকবাজারের ভেজাল রূপচর্চা ক্রিমের মতো শিক্ষা নামক পণ্য ক্রয় করে নানাভাবে প্রতারিত হচ্ছে।প্রাক-প্রাথমিক থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত চলছে শিক্ষা নিয়ে নানা ধরনের বাণিজ্য। এ বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত শিক্ষক, বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মালিক, গাইডবই বাজারজাতকারী বিভিন্ন প্রকাশনী ও বিভিন্ন কোচিং সেন্টারের মালিক।
এদের কাছে জিম্মি দেশের লাখ লাখ শিক্ষার্থী। সারা দেশে ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠেছে ব্যক্তিমালিকানাধীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। বাহারি নামের এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শুধু বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে পাঠদান করা হয়। উচ্চশিক্ষিত বেকারদের বেকারত্বের সুযোগ নিয়ে নামমাত্র বেতনে কতিপয় শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে তাদের মার্কেটিংয়ের কাজে ব্যবহার করে ছাত্র সংগ্রহ করে চলে এসব প্রতিষ্ঠান। আর ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে নানা প্রক্রিয়ায় বেতন ও ফি নিয়ে ব্যক্তিগতভাবে বাণিজ্য করে যাচ্ছে মালিক এবং সর্বনাশ করছে ছাত্রছাত্রীদের।
দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, দেশের শিক্ষার্থীরা মানুষ গড়ার কারিগর কিছু ‘মহান’ শিক্ষকের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে। আমাদের এ ‘মহান’ শিক্ষকরা কোমলমতি ছাত্রছাত্রীদের পরীক্ষায় কম নম্বর দেয়া, ফেল করানো এবং ব্যবহারিক পরীক্ষায় কম নম্বর দেয়ার ভয় দেখিয়ে তাদের কাছে প্রাইভেট পড়তে বাধ্য করে হাতিয়ে নিচ্ছে লাখ লাখ টাকা। এসব শিক্ষকের অবৈধ বাণিজ্যের কারণে শিক্ষা একটি বাণিজ্যিক পণ্যে পরিণত হয়েছে এবং শিক্ষা সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে; বিশেষ করে, বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদের ওপর মারাত্মক আর্থিক চাপ সৃষ্টি হচ্ছে। ফলে দরিদ্র মেধাবী শিক্ষার্থীরা বিজ্ঞান শিক্ষায় আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে।
কোচিং সেন্টারগুলো বর্তমানে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য একটি বিষফোঁড়ায় পরিণত হয়েছে। ছাত্রছাত্রীরা ক্লাসের চেয়ে কোচিংয়ে যেতে আগ্রহী বেশি; কারণ কোচিং সেন্টারগুলো ছাত্রছাত্রীদের নানা প্রলোভন দেখায়।তারা শিক্ষাকে সুপারশপের মতো নানাভাবে পণ্যের আকারে সাজিয়ে শিক্ষার্থীদের কাছে উপস্থাপন করে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো ক্লাসের পরিবেশকে আকর্ষণীয় করে তুলতে পারছে না। এ ছাড়া স্কুল-কলেজের অনেক শিক্ষক কোচিংয়ের সঙ্গে জড়িত; ফলে তাদের ভয়েও অনেকে কোচিংয়ে যেতে বাধ্য হয়।
পণ্য উৎপাদনকারী বিভিন্ন কোম্পানির মতো গাইড বাজারজাতকারী বহু প্রকাশনী এ দেশে গড়ে উঠেছে, যারা সব ধরনের নিষেধাজ্ঞাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে রীতিমতো বিজ্ঞাপন দিয়ে বাণিজ্য করে যাচ্ছে। বিভিন্ন কোম্পানির গাইড কিনতে অভিভাবকদের গলদঘর্ম অবস্থা।অনেক শিক্ষক ও প্রতিষ্ঠান অবৈধ এ গাইড কিনতে শিক্ষার্থীদের বাধ্য করছে। অনেক প্রতিষ্ঠান শিক্ষার্থীদের সরকার নির্ধারিত পাঠ্যবইবহির্ভূত বিভিন্ন প্রকাশনীর বই কিনতে বাধ্য করে নিজেরা কমিশন নেয়।
আর উচ্চশিক্ষা- এটা তো সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার ভেতর থাকছেই না; বিশেষ করে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এবং মেডিকেল কলেজগুলোর ব্যয় সাধারণ মানুষের নাগালের একদম বাইরে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অধিকাংশ ইউজিসির নিয়ম না মেনে ব্যবসা করে যাচ্ছে। অধিকাংশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নিজস্ব ক্যাম্পাসে না গিয়ে একটি বাড়ি অথবা কয়েকটি রুম ভাড়া নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাণিজ্যিক কার্যক্রম পরিচালনা করছে, যা উচ্চশিক্ষার জন্য অশনিসংকেত। এরা উচ্চ টিউশন ফি’র বিনিময়ে সনদ বিতরণ কোম্পানিতে পরিণত হয়েছে এবং শিক্ষাকে বাণিজ্যিক পণ্যে পরিণত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও শিক্ষাকে পণ্যে পরিণত করে সান্ধ্যকালীন কোর্সের আবরণে তা উচ্চমূল্যে বিক্রি করছে।
বাংলাদেশকে সোনার বাংলা হিসেবে গড়ে তুলতে তথা উন্নত দেশে পরিণত করতে মানসম্মত শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। শিক্ষাকে একটি মানসম্মত মানদণ্ডের ওপর প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। শিক্ষানীতিতে প্রাইভেট, কোচিং, গাইড নিষিদ্ধ হলেও কোনোভাবেই এদের লাগাম টেনে ধরা যাচ্ছে না। মনে রাখতে হবে, শিক্ষা কোনো বাণিজ্যিক বা বিক্রয়যোগ্য পণ্য নয়। শিক্ষাকে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখতে হবে। যে কোনো মূল্যে শিক্ষাব্যয় কমাতে হবে।
বাংলানিউজসিএ/ঢাকা/ ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৯/ এমএম