Menu

চিলের কান্না

বাংলানিউজসিএ ডেস্ক :: লম্বা একপায়ে দাঁড়িয়ে থাকা তালগাছটায় বসে একদিন চিলটা কী করুণ সুরেই কান্না করে। একটু থেমে থেমে। যেন রাজ্যের সব দুঃখ ওর বুকের ভেতর। তাই সে বৈশাখের কাঠফাটা দুপুরে যেখানে সবাই খুব ক্লান্ত হয়ে জিরোয় সে মনের বেদনা প্রকাশ করে বিলাপ করে।

একদিন চিলটার ছেলে-মেয়ে সবই ছিল। এখন সে একা, ঘর নেই, বাড়ি নেই, সংসার নেই, কিছুই নেই তার। একসময় বউ-সংসার সুখ-আনন্দই না ছিল তার সংসারে। ছোট ছেলেটার কথা মনে হলে নিজের বেঁচে থাকতে মন চায় না। সে ছিল মা-বাবা, ভাই-বোনের চোখের মণি। তাদের কথা কানে খুব বাজে চিলটার।

তার ছোট ছেলের বয়স যখন দু’মাস তখন কী আবদারই না করেছিল বাবার কাছে। নদীর মাছ খাবে। তাও আবার চাপিলা মাছ। সেই মাছ জোগাড় করার জন্য চিলকে নদীর ওপর দিয়ে কতই না উড়তে হয়েছে। কতবার নদীর মধ্যে ছোঁ মারতে হয়েছে। তারপর শেষে যখন খুব ক্লান্ত হয়ে একটা চাপিলা মাছ ধরল তখন চিলের সে কী আনন্দ। সমস্ত ক্লান্তি যেন মুছে গেল সন্তানের আনন্দে। আসলে বাবা-মায়ের সমস্ত দুঃখ মুছে যায় সন্তানের মুখে যখন হাসি ফোটে। মন ভরে যায় আনন্দে।

আজ এই খরায় চারদিকে একটু বৃষ্টির ছিটেফোঁটাও নেই, এমনকি আকাশে এক ফালি মেঘও কোথাও জমতে দেখা যায় না। এ অবস্থায় চিলকে এভাবে রোদে রোদে বাইরে ঘুরতে দেখলে চিল বউ কী রাগই না করত তার সাথে। ছেলে-মেয়েরাও বাবাকে সাবধানে চলতে বলত। যাতে শরীর খারাপ না করে, কোনো অসুখ-বিসুখ না হয়। আর এখন শত অনিয়ম করে বেড়ালেও কেউ কোনো কিছু বলার নেই। এসব ভাবতে ভাবতে চিলটা মনমরা হয়ে উঠল। দুচোখ গড়িয়ে পানি পড়তে লাগল চিলের। না বুঝে কী ভুলই না করেছিল সেদিন সে।

আগের দিন থেকেই আকাশটা একটু একটু ঘোলাটে ছিল। সকাল হতে না হতেই আষাঢ়ের মেঘ থেকে ঝমঝম করে বৃষ্টি পড়ছিল। বাইরে বের হওয়ার কোনো জো নেই। এদিকে বাসায় ছেলেমেয়েরা ক্ষুধায় অস্থির হয়ে উঠেছে। ছোট ছেলেটি তো কান্নাই জুড়ে দিয়েছে। ছেলে-মেয়েদের জন্য সে দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল। কোত্থেকে খাবার জোগাড় করা যায়। আর বৃষ্টিও তো থামছে না।

ঘণ্টাখানেক পর বৃষ্টি পড়া আস্তে আস্তে একটু কমে আসল। বৃষ্টির ফোঁটা যখন একটু ছোট হয়ে ঝিরঝির করে পড়তে শুরু করল, তখন চিল ভাবল নাহ, আর ঘরে বসে থাকা যায় না। এখন বের হতে হয়। বাসা থেকে একটু দূরে মাঠের পাশে একটা কড়ই গাছের ডালে গিয়ে বসল চিলটা। আর খুব কড়া নজর রাখছে নিচের ক্ষেতের আইলের মাঝখানে দিয়ে যেখান দিয়ে পানি যাচ্ছে সেখানটায়। বৃষ্টির দিনে এসব জায়গা দিয়ে মাছ আসা যাওয়া করে। ঐখানে বসে বসে সে আরো ভাবল, এমন বৃষ্টির দিনে ছেলে-মেয়েদের মুখে একটু ভালো খাবার তুলে দিলে মন্দ হয় না। তারা খুব মজা করে খাবে। এই ভেবে চিলটা উড়ে যেয়ে কুঁড়েঘরের পাশে ছোট ঝোপের মাঝে যেখানে আম গাছটি আছে, সেই গাছের ডালে চুপটি করে ওঁৎ পেতে বসে রইল খুব সতর্ক চোখে।

সাতটি ফুটফুটে বাচ্চা নিয়ে কুটকুট শব্দ করে এক মুরগি ঐ ঝোপের কাছ দিয়ে যাচ্ছিল। তাই দেখে চিল খুব চঞ্চল হয়ে উঠল। হঠাৎ করে মুরগির খুব কাছ থেকে একটি বাচ্চা চোখের পলকে ছোঁ মেরে নিয়ে উড়ে গেল। সে সময় মুরগিটা বুক ফাটিয়ে চিৎকার করে উঠেছিল একটি সন্তান হারিয়ে। তার জন্য অন্য বাচ্চারাও ভাইকে হারিয়ে মায়ের সাথে চিউঁ চিউঁ করে কেঁদেছিল। আর চিলের বাসায় সেদিন সে কী আনন্দ। তার ছেলেমেয়েরা কী খুশি মাংস খাবে বলে। চিল নিজের সন্তানের খুশিতে সেদিন নিজেও খুব আনন্দিত হয়েছিল।

কিন্তু সেদিন জানত না চিলের জন্য সামনে মুরগি দুঃখের চেয়ে আরও বেশি কষ্টের দিন আসছে। চিলের বাচ্চারাও একটু বড় হয়ে উঠেছে। গায়ে সোনালি লোম ওঠা শুরু করেছে। তারা এখন খুব মজার মজার কথা বলতে শিখেছে। দুষ্টও হয়ে উঠেছে একটু একটু। বাবা-মা তাদের নিয়ে খুব মজা করে সারাক্ষণ।

বেশ কিছুদিন ধরে খুব গরম পড়েছে। কাঠফাটা রোদে চারদিকে যেন চৌচির হয়ে যাওয়ার উপক্রম। বাচ্চারা এই গরমে থাকতে চায় না। কিন্তু এখনো তারা উড়তে শিখেনি, তাই যে কোনো সময় পড়ে যাওয়ার ভয়। নিচে পড়লে আর রক্ষে নেই। নির্ঘাৎ মৃত্যু। তাই বাইরে যাওয়ার সময় বাবা-মা বাসা থেকে বের হওয়ার জন্য বারণ করে যেত।

অতিরিক্ত গরমের চোটে মা চিলটা সেদিন বাচ্চাদের খুব কাছেই ছিল। মাঝে মাঝে ডানা দিয়ে তাদের বাতাস করছিল। হঠাৎ দেখা গেল খুব কাছেই ডালের মতো একটা কী যেন নড়ে উঠেছে এবং হা করে জিভ বের করে তাদের বাসায় এসে এক নিঃশ্বাসে চিলের বাচ্চাদের গিলে ফেলল কিছু বোঝার আগেই। তখন মা-চিলটা চিৎকার করে কাছেই উড়ছিল। কিন্তু তার করার কিছুই ছিল না।

একটু পরে ক্লান্ত হয়ে নখে ঠোঁটে করে কিছু মাছ ধরে নিয়ে এলো তার বাচ্চাদের জন্য। কিন্তু তার আগেই সব শেষ। বাসার এক পাশে তার বউ বুক ফাটিয়ে চিৎকার করে উড়তে লাগল। বাসার কাছে এসে অজগর সাপ দেখে তার বুঝতে বাকি রইল না। এতদিনের সাধের সংসার এক পলকে শেষ হয়ে গেল। তার পা-ঠোঁট থেকে সমস্ত মাছ আপনা আপনি নিচে পড়ে গেল। তার সমস্ত শরীর অবশ হয়ে এলো। চিলবউ চিৎকার করতে করতে সে-ই যে উধাও হলো তাকে আর খুঁজে পাওয়া গেল না। চিল কাঁদতে কাঁদতে তার বাসার কাছ দিয়ে উড়ে বেড়াচ্ছে আর সেই মুহূর্তে সেই মুরগির চিৎকার তার কানে বাজছে। সে মুরগির বুক থেকে তার সন্তান ছোঁ মেরে এনেছিল আর তার জন্যেই বুঝি মা-মুরগির অভিশাপে তার সাজানো সংসার চিরতরে শেষ হয়ে গেল। আসলে অন্যের ক্ষতি করলে নিজেরও ক্ষতি হয়। সেই থেকেই চিল রোদে ডানা মেলে আজও করুণ সুরে কেঁদে কেঁদে বেড়ায়।

বাংলানিউজসিএ/ঢাকা/ ০৯ সেপ্টেম্বর ২০১৯/ এমএম


Array