Menu

আহমাদ মাযহার

বিশ্বব্যাপী পুস্তক প্রকাশনা ব্যবসায় যে বই-নির্মাণের সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে তাকে আমলে নিয়ে বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে যে এর প্রয়োগ বাঞ্ছনীয় সে বোধই জন্মের পঞ্চাশ বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পরও বাংলাদেশে উল্লেখযোগ্য মাত্রায় গড়ে ওঠেনি। এর কারণ বাংলাদেশে নীতি মেনে ব্যবসায় পরিচালনার সংস্কৃতি অনুসারী সাধারণ ব্যবসায়ী সমাজের গড়ে না-ওঠা।

সাদামাঠা চোখে দেখলে মহিউদ্দিন আহমদ বাংলাদেশের একজন অগ্রগণ্য পুস্তক-ব্যবসায়ী! পুস্তক-প্রকাশনা সংস্কৃতির বাস্তবতা অনুসারে বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনা করলে তিনি ছিলেন উচ্চ মানের বইয়ের নির্মাতা-প্রকাশক। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে বুর্জোয়া নীতি অনুসারী পুঁজি-সংস্কৃতি বিকাশ লাভ করেনি বলে ব্যবসাকর্মকে এখনো যতটা অর্থকরী কাজ হিসেবে বিবেচনা করা হয় ততটা এর বাইরের আরো অন্য গভীর যে সামাজিক ভূমিকা থাকে তা ভাবা হয় না। পুস্তক-প্রকাশনা আর দশটা অর্থকরী ব্যবসায়ের চেয়ে একটু আলাদা যে একেবারেই ভাবা হয় না তা নয়, কিন্তু তা সত্ত্বেও ব্যবসাকর্ম মানেই যেহেতু আমাদের সমাজে দ্বিতীয় সারির কাজ মনে করা হয় সেহেতু পুস্তক-প্রকাশনা কর্ম যে একটি গভীর মননশীল সাংস্কৃতিকতার কাজও তা খুব একটা আমলে নেয়া হয় না। বাংলাদেশের মতো অপরিশীলিত বুর্জোয়া-সংস্কৃতির দেশ বলেই এমনটা হয়ে চলেছে। দু-একটা ব্যতিক্রম থাকলেও এখনো পুস্তক-প্রকাশকের যোগ্যতা বা অবদান বিচার করা হয় অনেকটা তাঁর বেশিসংখ্যায় বিক্রয়যোগ্য বই প্রকাশের সক্ষমতা দিয়ে, তাঁর অর্থোপার্জন সাফল্য দিয়ে।

পুস্তক-প্রকাশনা ব্যবসা বলতে যেন প্রকাশিত বই পাঠকের কাছে পৌঁছাক আর না পৌঁছাক টাকা প্রকাশকের ঘরে এলেই হলো। বিশ্বব্যাপী পুস্তক প্রকাশনা ব্যবসায় যে বই-নির্মাণের সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে তাকে আমলে নিয়ে বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে যে এর প্রয়োগ বাঞ্ছনীয় সে বোধই জন্মের পঞ্চাশ বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পরও বাংলাদেশে উল্লেখযোগ্য মাত্রায় গড়ে ওঠেনি। এর কারণ বাংলাদেশে নীতি মেনে ব্যবসায় পরিচালনার সংস্কৃতি অনুসারী সাধারণ ব্যবসায়ী সমাজের গড়ে না-ওঠা। মহিউদ্দিন আহমদ ব্যবসায় করেছেন নীতি ও সংস্কৃতি মেনে। অন্তত মোটা দাগে কয়েকটি বিষয় তিনি মেনে চলেছেন সবসময়। যেমন,

১. আইনত অননুমোদিত কোনো বই প্রকাশ না করা।
২. লেখকের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক চুক্তি ছাড়া বই প্রকাশ না করা।
৩. বইয়ের টেক্সটের যথাযথ পরিচর্যার জন্য সর্বোচ্চ দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেয়া!
৪. বিজ্ঞানসম্মত হিসাব সংরক্ষণ করা।
৫. লেখক-সম্পাদককে চুক্তি অনুসারে প্রাপ্য বুঝিয়ে দেয়া!

পুস্তক-প্রকাশনা খাতে এই সবগুলো নীতি ও রীতি মেনে চলার অনুশীলন করেন এমন প্রকাশক এখনো বিরল। উপর্যুক্ত শর্তগুলো মানার ব্যাপারে নানা শঠতার পরিচয় দিয়ে লাভ করতে চাওয়ার চেষ্টাই বাংলাদেশের পুস্তক-প্রকাশকেরা সাধারণত করে থাকেন। অন্য যারা ভালো প্রকাশক আছেন তাঁরা তাঁর মতো বৌদ্ধিক, পেশাদারী ও রুচিগত পারঙ্গমতা দেখাতে পারেননি। বরং মনে হয়েছে, যোগ্যতা নেই বিবেচনায় অধিকাংশ প্রকাশকই রুচিগত অনুশীলনের তেমন চেষ্টাই করেননি।

মহিউদ্দিন আহমদের জীবনবৃত্ত সম্পন্ন হওয়ার তিন বছর পার হয়েছে। বইয়ের জগতে তাঁর অভাব আমরা প্রতিনিয়ত অনুভব করি! কারণ আমাদের পুস্তক প্রকাশনা জগতে তাঁর মাত্রার বৌদ্ধিকতা সম্পন্ন মানুষ যেমন নেই তেমনি নেই তাঁর মতো বাস্তব বোধ সম্পন্ন মানুষও। ব্যবসা হিসেবে পুস্তক-প্রকাশনা এমন একটি কাজ যার একটি বৌদ্ধিক নির্দেশনা যেমন থাকবে তেমনি থাকবে তা বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় মাধ্যম সন্ধানের ক্ষমতা; তাঁর জনসংযোগের বৈশিষ্ট্যও হতে হবে একইসঙ্গে বৌদ্ধিক, কারিগরি ও সাধারণ! যেমন একজন পুস্তক-প্রকাশকের কেবল বিশেষ বিষয়ে জ্ঞানী হলেই চলবে না, তাঁর থাকতে হবে এমন সাধারণ ও কাণ্ডজ্ঞান যা তাঁকে অজানা বিষয়ে জ্ঞানের যথার্থতার কাছে পৌঁছে দেবে যাতে বইটি তার বিষয়ের প্রতি সুবিচার করতে পারে; প্রকাশকের থাকতে হবে সেই যোগ্যতা যাতে প্রকাশিতব্য বইয়ের সম্ভাব্য পাঠকের কাছে একদিকে বইয়ের খবরটি তিনি পৌঁছে দিতে পারেন অন্যদিকে কীভাবে তা পাঠকের কাছে পৌঁছাবে তাঁকে অনুসন্ধান করতে হয় সে পথও! তাঁর ছিল এই সকল ক্ষেত্রে অর্জিত সহজ পারঙ্গমতা।

মহিউদ্দিন আহমদ যখন বাংলাদেশে পুস্তক-প্রকাশনা শুরু করেন তখনো মুদ্রণ-ব্যবস্থার বাস্তবতায় বইয়ের ন্যূনতম মুদ্রণসংখ্যা ছিল সাড়ে বারোশো। একসঙ্গে ন্যূনতমসংখ্যায় মুদ্রণ না করলে কপিপ্রতি মুদ্রণব্যয় বেশি পড়ে যেত বলে ঐ মুদ্রণসংখ্যা বিবেচিত ছিল ন্যূনতম। এতে গুদামে মুদ্রিত ফর্মাগুলো গুছিয়ে সংরক্ষণ করতে হতো। বই বিক্রি না হলে বছরের পর বছর গুদামে মুদ্রিত ফর্মা সংরক্ষণ হয়ে পড়ত ব্যয়বহুল। বইয়ের হরফ-সংস্থাপন, প্রুফ সংশোধন, অলংকরণ ও বইসজ্জার দীর্ঘকালের অনুশীলিত প্রক্রিয়া। বই সরবরাহ-ব্যবস্থাও ছিল পুরোনো ধারার। সারা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের বইয়ের দোকানের প্রতিনিধিরা বাংলাবাজারে এসে বই সংগ্রহ করে নিয়ে যেতেন। আর ছিল ডাকব্যবস্থার মাধ্যমে ভিপিপি যোগে এজেন্সিগুলোতে চাহিদামাফিক বই পাঠানো! প্রায় স্থবির পুস্তক-প্রকাশনা জগতের প্রায় একমাত্র চাঞ্চল্য ছিল চিত্তরঞ্জন সাহার মুক্তধারা। মহিউদ্দিন আহমদ যখন নিজে পুস্তক-প্রকাশনায় আসেন তখন অনুভব করেছিলেন, সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রে জরুরি হয়ে উঠবে মননগত ও জ্ঞানগত নির্দেশনা। পুস্তক-প্রকাশনা ব্যবসার মধ্য দিয়ে তিনি গঠমান রাষ্ট্রের নির্ভরযোগ্য এসবের উত্স হয়ে উঠবেন। সেজন্যই তিনি প্রথমেই গুরুত্ব দিলেন মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের প্রতি! তাঁর উদ্যোগেই মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন দিকের ইতিহাস রচনার অনেকগুলো আকরগ্রন্থ প্রকাশিত হয়! অন্যান্য যেসব ক্ষেত্রের বই প্রকাশ তাঁর পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনায় প্রকাশিত হয়েছে তাতে সহজেই অনুভব করা যায় তাঁর মননশীলতার সামর্থ্য ছিল যে কোনো উচ্চমানের জনপরিসর বুদ্ধিজীবীর সমপর্যায়ের।

মেধাবী ছাত্র মহিউদ্দিন আহমদ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা ছেড়ে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেসে যোগ দিয়ে সেখান থেকে আত্মীকরণ করেছিলেন বই-নির্মাণের উন্নত সংস্কৃতি। তিনি যখন পুস্তক প্রকাশনা শুরু করেন তখনই এর মান নিয়ে ছিলেন সচেতন। বাণিজ্যিকতার অজুহাতে বইয়ের ভাষার সৌষম্য, হরফ-সংস্থাপনের নির্ভুলতা, সমাজে বইয়ের বিষয়গত তাত্পর্যের গভীরতা, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্বের রুচিগত মান সম্পর্কে দায়িত্বশীলতা নিয়ে তিনি কখনো আপস করেননি! প্রকাশনা মানের ব্যাপারে তাঁর দায়িত্বশীলতাকে অনেকে উন্নাসিকতা মনে করলেও তিনি ছিলেন তাঁর এই দৃষ্টিভঙ্গিতে অনড়!

বিগত বছরগুলোতে পুস্তক-প্রকাশনা খাতের পরিসর অনেক বড় হয়েছে। সরকারি-বেসরকারি নানা সুবিধা বিবেচনা করে অনেক প্রকাশক যেনতেন প্রকারে বই প্রকাশ করে কোনো রকমে সরবরাহ করে সাফল্য লাভ করেছেন। কিন্তু মহিউদ্দিন আহমদ তাঁর নীতিগত মৌল অবস্থান অনুশীলন থেকে সরেননি।

মহিউদ্দিন আহমদ যে কেবল একাকীই ব্যবসায় করে বড় হতে চেষ্টা করেছেন তা নয়; এই মাধ্যমের সবাইকে নিয়েই এগিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। বাংলাদেশের জন্য একটা জাতীয় গ্রন্থনীতি থাকা যে জরুরি তা ব্যক্তিগতভাবে তিনি অনুভব করে চুপচাপ বসে থাকেননি। সবাইকে সঙ্গে নিয়েই তিনি নিজের মেধার সর্বোচ্চ প্রয়োগে একটি জাতীয় গ্রন্থনীতি প্রণয়নও করেছিলেন। গ্রন্থনীতিটি বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে গৃহীত হওয়া সত্ত্বেও তা বাস্তবায়নের কোনো উদ্যোগ পরবর্তী কোনো সরকারের কোনো মহলের মধ্যে দেখা যায়নি। বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, এই নীতি বাস্তবায়ন করতে গেলে কায়েমি স্বার্থবাদীদের স্বেচ্ছাচারিতা অনেক কঠিন হয়ে পড়বে।

তিনি যে কারো সঙ্গেই কথা বলতেন; যার সঙ্গেই আলোচনা হতো বা ভাব বিনিময় হতো সে জন খুব সাধারণ স্তরের কেউ হোক কিংবা উচ্চস্তরের এতে তাঁর কোনো অসুবিধে হতো না। তাঁর চিন্তা যেমন স্বচ্ছ ছিল তেমনি ছিল পরিচ্ছন্ন! ফলে সাধারণ ব্যবসায়ীসুলভ কপটতা করার প্রয়োজন পড়েনি তাঁর! লক্ষ করেছি, আমাদের অন্য অগ্রগণ্য পুস্তক-প্রকাশকেরা অনেকেই তাঁকে সমীহ করতেন ঠিকই, তাঁর প্রকাশনা-সংস্কৃতি অনুসরণ করা তাঁদের পক্ষে অবাস্তবও মনে হতো! এ থেকেও বোঝা যায় পুস্তক-প্রকাশক হিসাবে কতটা স্রোতের বিরুদ্ধের মানুষ ছিলেন তিনি! জীবনব্যাপী কর্মতৎপরতা দিয়ে পুস্তক-প্রকাশনার যে উঁচু মানদণ্ড ও দৃষ্টান্ত তিনি রেখে গিয়েছেন তা নিয়মিত পর্যালোচনা করলেও আমরা উপকৃত হব!

প্রবাস বাংলা ভয়েস /ঢাকা/ ২৯ জুলাই ২০২৪ /এমএম