Menu

প্রবাস বাংলা ভয়েস ডেস্ক :: খাদ্য নিরাপত্তার কথা নিয়ে এখন দুনিয়া সরগরম। চাষবাস করেন না এমন সাহেবরা অথবা সাধারণ কেরানিরাও নিজের পাতের খাবার জোগান অথবা জোগাড় হওয়া খাবার নিরাপদ কিনা- সেসব নিয়ে খুব চিন্তিত, খুব উদ্বিগ্ন! চিন্তিত আমাদের নয়া অর্থমন্ত্রীও। খাদ্য নিরাপত্তা ও কৃষি উৎপাদনের গুরুত্ব বোঝাতে তিনি বাজেট বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে উদ্ধৃত করে বলেছেন- খাদ্যের জন্য অন্যের ওপর নির্ভর করলে চলবে না। আমাদের নিজেদের প্রয়োজনীয় খাদ্য আমাদেরই উৎপাদন করতে হবে। কৃষকদের বাঁচাতে হবে, উৎপাদন বাড়াতে হবে, তা না হলে বাংলাকে বাঁচাতে পারবেন না।

রাষ্ট্রের নীতি-নির্ধারকরা যদি কৃষকদের জন্য বিবেচনা না করেন, তবে কৃষকের কী দায় পড়েছে আমাদের সবার পাত ভরাতে?

বাজেট অধিবেশনে তিনশ আসনের সংসদে কমছে কম ১৯৯ জন সিআইপি-ভিআইপি ব্যবসায়ী এমপি উপস্থিত ছিলেন। ব্যক্তিগত কর ফাইলে রেয়াতধারী কিছু মৎস্যজীবী এমপিও ছিলেন; কিন্তু কৃষক প্রতিনিধি কোনো এমপি ছিল বলে খুঁজে পাওয়া যায়নি। সেটাই অবশ্য স্বাভাবিক, নিম্নবর্গের হেলেচাষা কৃষকের আবার কিসের ভাষা, কিসের বক্তব্য! যাই হোক, আগামী এক বছরের জন্য পরিকল্পিত পথনকশা যে বাজেট সেটা নিয়ে আলোচনা হবে সেটাই তো স্বাভাবিক। রীতিমাফিক বাজেট পর্যালোচনা সপ্তাখানেক ধরে চলছে। কত লোকে কথা বলছে সভা সমিতি মঞ্চে, তুমুল তর্কবিতর্ক চলছে কি করে মূল্যস্ফীতি রুখে দেয়া যায়? কি করে রাজস্ব আয় বাড়বে? কৃষিতে ব্যপক ভর্তুকির ফলে বাম্পার ফলনের খুব আশা করা হচ্ছে। নামি-দামি মানুষের সংবাদ সম্মেলন ও রাশভারি আলোচনা সভাগুলোতে খালি কৃষকদের বয়ানই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

কৃষক ও কৃষি খাতের কথা বাজেটে কতটুকু এলো?

আগামী অর্থবছরে কৃষি বিষয়ক ৫টি মন্ত্রণালয়ের (১. কৃষি, ২. মৎস ও পশু সম্পদ, ৩. পরিবেশ বন ও জলবায়ু পরিবর্তন, ৪. ভূমি ও ৫. পানিসম্পদ) জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৪৭,৩৩২ কোটি টাকা; যা মোট বাজেটের ৫.৯০ শতাংশ। কৃষি খাতের বাজেট নিয়ে বাগাড়ম্বর করে বলা হচ্ছে যে, চলতি বছরে বরাদ্দ ছিল ৫.৭৪ শতাংশ; কিন্তু আগামী বছরের জন্য তা বাড়িয়ে ৫.৯০ শতাংশ ধরা হয়েছে (শতাংশের হিসাব ধরে) কিন্তু প্রকৃত হিসাব হলো, চলতি বছরের কৃষি বরাদ্দের পরিমাণ ৪৩,৭০৩ কোটি টাকাকে এ বছরের ১৫ শতাংশ মূল্যস্ফীতি দিয়ে সমন্বয় করলে কৃষি বরাদ্দের শুভংকরের ফাঁকিটা বোঝা যায় যে, বরাদ্দের পরিমাণ আসলে কমেছে।

আবার, কৃষি খাতের ৫টি মন্ত্রণালয়ের মধ্যে কৃষি ও কৃষকের সাথে সরাসরি সম্পর্কিত দুইটি মন্ত্রণালয়; কৃষি মন্ত্রণালয় ও মৎস্য-পশুসম্পদ মন্ত্রণালয়, যাদের জন্য বাজেট বরাদ্দ রাখা হয়েছে যথাক্রমে ২৭,২১৪ কোটি টাকা ও ৪,২৮৮ কোটি টাকা। চলতি বছরের বাজেটে এই খাতে দুই মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ ধরা হয়েছিল যথাক্রমে- ২৫,১১৮ কোটি টাকা ও ৪,২৪০ কোটি টাকা। অর্থাৎ মোট বাজেটের আকার বৃদ্ধি ও মূল্যস্ফীতি সমন্বয়ের তুলনায় এ খাতে বাজেটের প্রকৃত বরাদ্দ মোটেই বাড়েনি বরং হিসাববিজ্ঞানের ‘ক্লারিক্যাল উইন্ডো ড্রেসিং’ করা হয়েছে মাত্র!

অর্থমন্ত্রীর বাগাড়ম্বর বনাম কৃষি খাতের হিস্যা কমে যাওয়া

বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী বলেছেন, কৃষিজাত পণ্য আমদানি বিকল্প তৈরির মাধ্যমে কৃষিভিত্তিক শিল্পের বিকাশ ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা সম্ভব। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ এখনো কৃষিপ্রধান দেশ এবং কৃষিই আমাদের অগ্রাধিকার প্রাপ্ত খাত। ফলে কৃষি খাতের উন্নয়নে প্রধান উপকরণগুলো বিশেষ করে সার, বীজ, কীটনাশক ইত্যাদি আমদানিতে শূন্য শুল্কহার অব্যাহত থাকবে।
এসব মুখরোচক কথা বলেই তিনি প্রস্তাবিত ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে কৃষি খাতে ভর্তুকি বাবদ ১৭,২৬১ কোটি টাকার প্রস্তাব করেন; যা চলতি বছরের বাজেটে প্রস্তাব করা হয়েছিলো ১৭,৫৩৩ কোটি টাকা। বাস্তবে কৃষি খাতের ভর্তুকি বাবদ খরচ হয়েছে আরও প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা বেশি। মূলত আমদানিকৃত সার, কীটনাশক ও কম্বাইন্ড হারভেস্টার মেশিন ভর্তুকিমুল্যে কৃষকের কাছে সরবারাহ করতেই এই ভর্তুকি খাত থেকে খরচ হয়েছে। অর্থাৎ, মুখে যতই মিঠেবাত থাকুক বাস্তবে চলতি বছরের তুলনায় কৃষি খাতের ভর্তুকি বাবদ কম বরাদ্দ রাখা হচ্ছে। শুধু তাই নয়, দিনের পর দিন বাজেটে কৃষি খাতের হিস্যা কমছে। এক যুগ ধরে জাতীয় বাজেটের আকার দ্রুত বাড়ছে, সে তুলনায় কৃষি খাতে বাজেট বাড়ছে না। আওয়ামী লীগ সরকারের দেওয়া ২০১১-১২ অর্থবছরের মোট বাজেটে কৃষি বাজেটের হিস্যা ছিল ১০.৬৫ শতাংশ। আর এই ২০২৪-২৫ অর্থবছরে তা নেমে এসেছে ৫.৯০ শতাংশে। একইভাবে কৃষি ভর্তুকির হিস্যা নেমে এসেছে ৬.৪ থেকে ২.৩ শতাংশে। এটার দায় কি আইএমএফের ওপরে চাপানো হবে? আইএমএফ অর্থ ছাড় করার শর্ত হিসেবে বাজেট ভর্তুকি কমানোর চাপ দিলে শুধু কৃষি খাতের কথা মনে হয়?

বাজেটে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য মোট ভর্তুকি বরাদ্দ ১ লাখ ৮ হাজার ২৪০ কোটি টাকা, এর মধ্যে বিদ্যুৎ খাত পাবে ৪০ হাজার কোটি টাকা, যা মোট বরাদ্দের ৩৭ শতাংশ। উল্লেখ্য দাতা সংস্থাগুলোর বারংবার চাপ সত্ত্বেও গত দুই অর্থবছরেই বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি ছিল ৪০ হাজার কোটি টাকা। গত বছর সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) এক সমীক্ষায় দেখা যায়, ভর্তুকির বেশির ভাগ অর্থ বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর ক্যাপাসিটি চার্জ মেটাতে ব্যয় করা হয়। এ খাতের বিশেষজ্ঞরা গত কয়েক বছর ধরেই বলছেন যে, বিদ্যুৎ খাতের ক্যাপাসিটি চার্জ ও আমদানি শুল্কের ছাড় নিয়ে রয়েছে ভীষণ অস্বচ্ছতা ও স্বজনপ্রীতি এবং এ খাতের ব্যপস্থাপনা নিয়ে প্রশ্ন যাতে না তোলা যায় সেজন্য দায়মুক্তি আইন করে জবাবদিহিতা বন্ধ রাখা হয়েছে। গত বছরের জানুয়ারি থেকে সরকার বেশ কয়েকবার বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর পরও বাজেটে এই বড় অংকের ভর্তুকি রাখায় এর উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।

তাহলে কৃষি খাতের বরাদ্দ কিংবা ভর্তুকি দিতে এতো কার্পণ্য কেন? এই অর্থ তো তবু শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের অর্থনীতিতেই থাকছে, সরাসরি কৃষি উপকরণের দাম কমাতে সাহায্য করছে। জ্বালানি খাতের ভর্তুকি বাদ দিয়ে অথবা কমিয়ে একই পরিমাণ বরাদ্দ কৃষি খাতে দিয়ে যা যা করা যেত-

ধানের লাভজনক দাম পেতে সরাসরি কৃষককে সহায়তা:

সরকারি প্রণোদনা এবং অন্যান্য কৃষি পরিষেবা দ্রুত পৌঁছে দেওয়ার জন্য ২ কোটি ২৭ লাখ ৫৩ হাজার ৩২১টি কৃষক পরিবারকে কৃষিকার্ড দেবার চলমান ‘প্রোগ্রাম অন অ্যাগ্রিকালচার অ্যান্ড রুরাল ট্রান্সফরমেশন ফর নিউট্রিশন এন্ট্রাপ্রেনারশিপ অ্যান্ড রেসিলিয়েন্স ইন বাংলাদেশ (পার্টনার) প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ ও গতি বাড়ানো যেত। কৃষিকার্ড দিয়ে লেনদেন করে প্রকৃত কৃষকের হাত থেকে সরাসরি ধান সংগ্রহ ও সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা সম্ভব। সরকারি গুদাম ও সাইলোর ধারণক্ষমতা বাড়াতে বাজেট বরাদ্দ দেওয়া যেত। অন্তর্বর্তীকালীন হিসাবে বেসরকারি গুদাম ও চাতাল ভাড়া করা আরও বেশি সহজ। ধানের কাঙ্ক্ষিত আদ্রতা রক্ষা, চিটা ধান বাছাই ও সঠিক মান সংরক্ষণের দায়িত্ব কৃষকের কাঁধে রেখেই জমাকৃত ধানকে নিরাপত্তা জামানত হিসেবে ধরে রপ্তানিমুখী গার্মেন্ট শিল্পের মতো করে এগ্রিকালচারাল ক্যাশ ক্রেডিট বা ট্রাস্ট রিসিপ্ট ধরনের স্বল্পমেয়াদি ঋণ দিয়ে ধানের মৌসুমে কৃষককে নগদ অর্থ সরবরাহের ব্যবস্থা করা যেতো। যাতে করে কৃষক সার বীজ ও অন্যান্য জরুরি ঋণ শোধ করতে কৃষককে পানির দামে ধান বিক্রি করতে বাধ্য হতে না হয়। সারা দেশব্যাপী ব্যাংক ও ক্ষুদ্রঋণ দানকারী প্রতিষ্ঠান গুলোকে অনায়াসে এ খাতের সেবা দানকারী সংস্থা হিসেবে কাজে লাগানো সেতে পারে। এরজন্য দরকার হতো সরকারি ইন্টারভেনশন ও বাজেট বরাদ্দ। কত টাকা লাগত? গত বছর দেশে সব জাতের ধানের উৎপাদন রেকর্ড পরিমাণ প্রায় ৪ কোটি টনে পৌঁছায়।
ধরা যাক, কৃষক পরিবারগুলোর সারা বছরের খোরাকি ও নগদ অর্থের জন্য জরুরি প্রয়োজনে বিক্রয় বাদে মোট এক-চতুর্থাংশ অর্থাৎ ১ কোটি টন ধান ভালো দাম পাবার আশায় সরকারি ব্যবস্থাপনায় সংরক্ষণ করে নগদ অর্থ সহায়তা পেল। মণপ্রতি পাঁচশ টাকা করে ধরলে মোট ১ কোটি টনের জন্য সরকারের বিনিয়োগ করতে হবে ১৩,৭৫০ কোটি টাকা; যা কিনা ঋণের মেয়াদ শেষে ফেরত আসত। আবর্তনশীল একটা তহবিল তৈরি করে কৃষকদের এই সুবিধা দেওয়া কি অসম্ভব, যেখানে গত কয়েক বছর ধরে বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোকে ৪০,০০০ কোটি টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ দেওয়া হচ্ছে?

কৃষিগোলা বা ফসল সংরক্ষণাগারের অভাব:

ধরা যাক মোটামুটি সম্পন্ন কৃষক কাঁচা ধান কিংবা নতুন আলু কিংবা নতুন ওঠা পেঁয়াজ ভালো দামের আশায় মৌসুমের শুরুতেই বিক্রি করতে চায় না, তাহলে সে এসব ফসল রাখবে কোথায়? ভূমিহীন ও প্রান্তিক কৃষকদের খানা জরিপ বিশ্লেষণ করে ড. মাহবুব ও আবদুল বায়েসের ২০০৮ সালে অনুসন্ধান অনুযায়ী ফলনের ১২% থেকে ২২% পর্যন্ত সংরক্ষণ করার সামর্থ্য আছে। আবার বিআইডিএস ২০১৯ সালে এক গবেষণায় প্রকাশ করে যে, দেশে নিবন্ধিত চালমিল ও চাতাল আছে প্রায় ২০,০০০ অনিবন্ধিত আরও বেশি। কিন্তু দেশে সারা বছরে যত চাল কেনাবেচা হয়, এককভাবে তার সবচেয়ে বড় অংশ এখন ৫০টি বড় চালকল প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণ করে। ঐ গবেষণায়া আরও বলা হয়েছিল, বড় ৫০টি অটো রাইস মিলের প্রতিটি প্রতিদিন প্রায় ১৫০০ টন চাল উৎপাদন করে। মূলত তাদের নিজস্ব গুদামে থাকা ধান ভাঙিয়ে তারা ওই চাল উৎপাদন করে থাকে। প্রভাবশালী চালকলগুলো দেশের কয়েকটি জেলা যেমন কুষ্টিয়া, নওগাঁ, বগুড়া ও দিনাজপুরে অবস্থিত। একই এলাকায় এত প্রভাবশালী চালকল গড়ে ওঠায় তারা সহজেই বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ধান কিনে ওই সব জেলার চালকল মালিকেরা গুদামজাত করেন। তাদের জন্য অবারিত ঋণ মঞ্জুরি নিয়ে বসে আছে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো। এর বিপরীতে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক পরিবারের প্রয়োজন অনুযায়ী ঘরই নেই অধিকাংশ কৃষকের আবার কৃষিগোলা কোথায় পাবে? গ্রামে গ্রামে ছড়ানো ছোট চাতাল ও ম্যনুয়াল হাস্কিং মিল বন্ধ হয়ে গেছে পুঁজির স্বাভাবিক নিয়মেই। কোটি কোটি টাকার অটোমিল বসেছে। বড় কর্পোরট পুঁজি ছোট পুঁজির বিনিয়োগগুলোকে খেয়ে ফেলেছে, বাজারে অসম বিন্যাস তৈরি হয়েছে। লাখ লাখ কৃষকের বিপরীতে শখানেক অটোমিল কোল্ড স্টোরেজ মজুতদারদের সিন্ডিকেট।

কৃষকের ফসলের সংরক্ষণ করার সক্ষমতা বৃদ্ধি কৃষককে ফসলের লাভজনক দাম দেবার জন্য অন্যতম একটা উপায়। ধান আলু পেঁয়াজের মতো অর্থকরী কৌশলগত ফসলের জেলাগত বিন্যাস বিবেচনায় নিয়ে ইউনিয়ন পর্যায়ে পর্যাপ্ত কৃষিগোলা স্থাপন, ছোট মাঝারি চাতাল মিল ও কোল্ডস্টোরেজ মালিকদের ঋণ প্রণোদনা, বিদ্যুৎবিলে ভর্তুকি দিয়ে গ্রামে গ্রামে কৃষিগোলা ছড়িয়ে দেওয়া দরকার। কৃষকরা প্রকৃত উপযোগিতা পেলে কৃষিগোলার জন্য ভাড়া দিতেও কার্পণ্য করবে না। কাঁচা ফসল পানির দামে বিক্রি করা ও দূর-দূর বাজারে পরিবহণ খরচের চেয়ে ওই খরচ কম হবে নিশ্চয়ই। তাছাড়া গুটিকয়েক চেনাচেনা বাজার সিন্ডিকেটের কবল থেকেও কৃষি বাজারটা বাঁচত।
ধরা যাক, ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরের বাজেটে বার্ষিক উন্নয়ন বরাদ্দ থেকে এই কৃষি অবকাঠামো খাতে ভর্তুকি দিতে লাগলো ১০,০০০ কোটি টাকা যা জ্বালানি খাতের ভর্তুকির মাত্র ২৫ শতাংশ, কিন্তু কৃষিপণ্যের লাভজনক দাম নিশ্চিত করতে বছরের পর বছর ধরে কাজে আসবে।

সার বীজ কীটনাশক কেনার জন্য সরাসরি ভর্তুকি:

বাংলাদেশের কৃষি খাতের প্রায় পুরোটাই সার-বীজ-কীটনাশকনির্ভর উচ্চ ফলনশীল কৃষির অংশ। কৃষি উৎপদনের এসব প্রাথমিক উপাদানের বাজার দেশি-বিদেশি কোম্পানির সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রিত, কৃষক সেখানে নিতান্তই বলির পাঁঠা মাত্র। অথচ এক্ষেত্রে সুবিবেচনাপ্রসূত বাজেট বরাদ্দ বিরাট ভূমিকা পালন করতে পারে। কৃষিকার্ড দিয়ে সরাসরি ভর্তুকি খুবই দক্ষভাবে দেওয়া সম্ভব। ব্যাংক এশিয়া এবং ইউএসএইড সম্মিলিতভাবে কয়েকবছর আগে ‘এ-কার্ড’ নামক একটি প্রকল্পের মাধ্যমে কৃষক ও সার-বীজ-কীটনাশক বিক্রেতাদের নিয়ে বেশ বড় আকারে পাইলটিং করে প্রমাণ দেখিয়েছিল যে, এ দেশের কৃষক ও গ্রামের দোকানদার-ডিলাররা স্মার্টকার্ড ও মোবাইল অ্যাপস ব্যবহার করে ক্যাশবিহীন ও ঘুসবিহীন দক্ষ লেনদেন করতে কতটা দক্ষ ও আগ্রহী। সরকারি প্রণোদনা ও নীতি সহায়তা পেলে ব্যাংকগুলোই হতে পারে এ খাতের ভর্তুকি বা ঋণ সহায়তার অর্থের সংস্থান ও মার্কেট প্লেয়ার। এ খাতে বাজেট ঘোষণার ক্ষেত্রে কোনো বরাদ্দ রাখা ছাড়াই শুধু ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য নির্দেশনা ও নীতি সহায়তা থাকলেই চলত।

রেমালে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের আপৎকালীন বরাদ্দ:

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় কর্তৃক ঘূর্ণিঝড় রেমালের ক্ষয়ক্ষতির হিসাব অনুযায়ী রেমালের আঘাতে লন্ডভন্ড হয়ে গেছে উপকূলের ২০ জেলার ৬২ উপজেলার ৪১৯টি ইউনিয়ন। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৩৭ লাখ ৫৮ হাজার ৯৬ জন মানুষ। সম্পূর্ণভাবে বিধ্বস্ত হয়েছে ৩৫ হাজার ৪৮৩টি ঘরবাড়ি। আংশিক বিধ্বস্ত হয়েছে এক লাখ ১৪ হাজার ৯৯২ বাড়িঘর। শুধু প্রাথমিক বিদ্যালয় বিধ্বস্ত হয়েছে ১১৬৩টি। প্রায় ৯৬ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ভেঙে গ্রামের পর গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। ২০ জেলায় মোট ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে কমবেশি প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকা।

সিডর, আইলা বা আম্পানের চেয়ে রেমালের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বেশি। ২০২০ সালে আঘাত হানা আম্পানে মৎস্য খাতে ক্ষতি হয়েছিল ৮৫ কোটি ৮ লাখ টাকা। রেমালে এই খাতে প্রাথমিক ক্ষতি ২১৭ কোটি ২৯ লাখ টাকা। কৃষি খাতে আম্পানে ১৭ হাজার ৪৫৫ হেক্টর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, যার আর্থিক মূল্য ছিল ১০০ কোটি টাকার কম। রেমালে ১৮ হাজার ২০৯ হেক্টর ফসলি জমি সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যার আর্থিক মূল্য আম্পানের ক্ষতির চেয়ে অনেক বেশি হবে বলে জানিয়েছেন কৃষি বিভাগের কর্মকর্তারা। খুলনা ও সাতক্ষীরায় প্লাবিত হয়ে গেছে চিংড়ি, কাঁকড়া, মাছের পোনার খামার। আর বাগেরহাটের চিংড়ি ও কাঁকড়ার ঘের পানিতে ভেসে গেছে। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ক্ষুদ্র চাষিরা।

এতবড় একটা দুর্যোগের এক সপ্তাহ পর যে বাজেট ঘোষণা করা হলো সেখানে উপদ্রুত ২০টি জেলার ক্ষতিগ্রস্ত জনগণের জন্য কোনো বিশেষ বরাদ্দ না থাকা ভীষণ অসংবেদনশীলতার প্রমাণ। সাইক্লোন উপদ্রুত উপকূলীয় জেলাগুলোর চাষিদের জন্য রাষ্ট্রের কোষাগার থেকে ৭০০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া কি খুব অসম্ভব ছিল? যেখানে কথিত আছে যে, কতগুলো অতিধনী ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর বসিয়ে রাখা বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর জন্য ক্যাপাসিটি চার্জ হিসেবে এ বছরেও ৪০,০০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে।

একটা কথা স্মরণে রাখা উচিত যে, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার-২০২৪ এর বিশেষ অগ্রাধিকার তালিকায় কৃষিকে বেশ গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা হয়েছিল। ইশতেহারের অগ্রাধিকার তালিকায় চার নম্বর পয়েন্ট ছিল- ‘লাভজনক কৃষির লক্ষ্যে সমন্বিত কৃষি ব্যবস্থা, যান্ত্রিকীকরণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণে বিনিয়োগ বৃদ্ধি।’
লোক ভোলানো অঙ্গীকার হোক অথবা কৃষি খাতের প্রতি প্রকৃত অঙ্গীকারই হোক- ফসল ফলানো কৃষকের প্রতি রাষ্ট্রের কৃতজ্ঞতা ও মর্যাদা দেওয়ার অঙ্গীকারটাই সবচেয়ে বেশি দরকার। রাষ্ট্রের নীতি-নির্ধারকরা যদি কৃষকদের জন্য বিবেচনা না করেন, তবে কৃষকের কী দায় পড়েছে আমাদের সবার পাত ভরাতে? কৃষকদের কেন মাথার ঘাম পায়ে ফেলে ফলানো সোনার ফসল আড়তদার মুৎসুদ্দি ফড়িয়াদের কাছে পানির দরে ছেড়ে দিতে হবে শুধু?

আলিমুল কবীর

ব্যাংকার ও কৃষি অর্থনীতির বিশ্লেষক

ইমেইল: alimulkbr@gmail.com

প্রবাস বাংলা ভয়েস /ঢাকা/ ২৬ জুন ২০২৪ /এমএম