আহসান রাজীব বুলবুল, প্রধান সম্পাদক, প্রবাস বাংলা ভয়েস :: ক্যানাডার টরন্টো শহরের স্থানীয় একটি হোটেলে কানাডা প্রবাসী লেখক মোস্তফা আকন্দ ও নেসার আহমেদ প্রনীত ফারাক গ্রন্থটির মোড়ক উম্মোচন করেন অন্টারিওর প্রভেন্সিয়াল পার্লামেন্টের বিরোধীদলীয় উপনেতা বাংলাদেশী বংশোদ্ভুত এমপিপি ডলি বেগম। সন্ধ্যা ছ’টায় শুরু হয়ে রাত সাড়ে আটটায় শেষ হওয়া- আড়াই ঘন্টার আলোচনা অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন জনপ্রিয় গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব ও কানাডা প্রবাসী আসমা আহমেদ।
ডলি বেগম তার সংক্ষিপ্ত বক্তৃতায় বলেন, টরন্টোতে বাংলাদেশীদের মধ্যে প্যারিন্টং একটি জটিল সমস্যা হয়ে দাড়িয়েছে। ফারাক বইটির লেখকদের আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনি। তারা কমিউনিটির জন্য নিরবে কাজ করে যাচ্ছেন। টরন্টোতে বাঙালী যুবকদের আত্নহত্যা বিষয়ে লেখকদ্বয় গবেষণা করেছেন কয়েক বছর আগে। খুব ভালো কাজ ছিলে সেটা। অনেকেই বাচ্চাদের সাথে তাদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব নিয়ে আমার কাছে আসেন। তাদেরকে আমি তেমন একটা সাহয্য করতে পারিনা কারন প্যারেন্টিং একটা ইস্যু। সম্পুর্ন বাংলায় লিখিত ফারাক বইটি টরোন্টা বাঙালী কমি্উনিটির প্যারেন্টসদের প্যারেন্টিং সমস্যা সমাধানে ব্যাপক ভূমিকা রাখবে বলে আশা করি। কমিউনিটির সবাইকে বইটি পড়া উচিত।
ফারাক গ্রন্থটির ওপর আলোচনায় অংশ নিয়ে বহুল পঠিত বাংলাদেশের জনপ্রিয় দৈনিক প্রথম আলোর প্রাক্তন সাংবাদিক ও টরন্টো ভিত্ত্বিক অনলাইন পত্রিকা নতুন দেশের সম্পাদক শওগাত আলী সাগর বলেন, ফারাক গ্রন্থটি লেখকদ্বয়ের প্যারেন্টিং বিষয়ের ওপর লিখিত একটি গবেষনামুলক গ্রন্থ যেখানে আমাদের প্যারেন্টিং এর চ্যালেন্জগুলোকে গল্পের ঢংয়ে সন্নিবেশিত করা হয়েছে। গল্পগুলো সুখপাঠ্য। পড়তে পড়তে মনে হবে আমি এই শহরেরই কোন গল্পের মধ্যে ঢুকে যাচ্ছি আর মানসিক স্বাস্থ্য ও প্যারেন্টিং বিষয়ে শিখছি। এই শিক্ষনটা আমাদের ও আমাদের সন্তানদের মধ্যকার দূরত্ব কমাতে সাহায্য করবে।
টরন্টো প্রবাসী কবি, গল্পকার ও টরন্টো ডিস্ট্রিক্ট স্কুল বোর্ড এর স্পেশাল নিডস্ শিশুদের শিক্ষিকা সঙ্গীতা ইয়াসমিন বইটির ওপর আলোচনা করতে গিয়ে বলেন, শুধু সন্তান জন্ম দিলেই বাবা-মা হওয়া যায়না। বাবা-মা হতে গেলেও কিছু দক্ষতা ও প্রশিক্ষণ থাকা দরকার হয়। “ফারাক” অনেকটা গবেষণাধর্মী তথ্য সম্বলিত এবং বাস্তব ঘটনার প্রতিচ্ছবি নিয়ে রচিত গ্রন্থ। সেসব ঘটনা বিশ্লেষণ করলেই আমাদের মত হাজারো বাবা-মা অন্তত নিজেদেরকে প্রশ্ন করতে শিখবেন। এই গ্রন্থ পাঠে যদি নিজে থেকেই আমরা কিছু শিক্ষন নিতে পারি সেটা আমাদের সবার জন্য মঙ্গল। না-ও যদি পারি, তবুও আমরা আমাদের মুঁদিত চক্ষুকে মুক্ত করতে পারি! সুস্থ থাক জগতের সব সন্তান। সুখি হোক পরিবার। ঘুচে যাক সব দূরত্ব! যেখানে আছে ‘ফারাক’।
টরন্টোর বিশিষ্ট আইনজীবী ব্যারিস্টার জাকির হোসেন বলেন, কোন বই যে এভাবে লেখা যায়, আমি কখনো দেখিনি। বইটি প্যারেন্টিং এর ওপর লিখিত বই। কিন্তু লেখকদ্বয় গল্প বলেছেন আর প্যারেন্টিং শিখিয়েছেন। শেষে প্যারেন্টিং এর ওপর একাডেমিক আলোচনাও করেছেন। বইটি পড়া শুরু করলে আপনি শেষ না করে ছাড়তে পারবেন না। কমিউনিটির মানুষদের বইটি পড়া উচিৎ। টরন্টোর বিশিষ্ট চিকিৎসক ডাঃ নিলান্জনা দত্ত বলেন, মোস্তফা আকন্দর লেখা আমার খুবই ভালো লাগে। তিনি আমাদের সমাজের সমস্যাগুলোকে এমন সুন্দরভাবে তার লেখা গল্পে তুলে ধরেন যে, মনেই হয়না এটা কোন তথ্যবহুল আলোচনা। আর বইটির সহ-লেখক নেসার আহমেদের প্রফেশনাল লেবেল অনেক উঁচু। ফারাক বইটি সবাইকে পড়ার আহবান করছি।
অন্টারিওর গুয়েলফ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ডঃ মাহতাব শাওন বলেন, ফারাক নামটাই একটা সার্থক নাম। আপনারা বইটি পড়লেই বুঝতে পারবেন যে কেন এই নামটি রাখা হয়েছে? বইটির পটভুমি আমার জানা। যে গবেষণা লেখকদ্বয়কে বই লিখতে উৎসাহ যুগিয়েছে সেই গবেষণাটির সঙ্গে আমার সম্পৃক্ততা ছিল। কয়েক বছর আগের টরন্টোর বাঙালী তরুনদের আত্নহত্যার কারন অনুসন্ধানের গবেষণার মুল ফলাফল ছিল মা-বাবার সাথে সন্তানের যোগাযোগের অভাব’ বা প্যারেন্টিং ইস্যু। এ বিষয়টি কখনো আমাদের কমিউনিটিতে এড্রেস করা হয়নি। তিনি সবাইকে বইটির অষ্টম অধ্যায়টি ভালোভোবে পড়ার অনুরাধ করেন। তিনি আরো বলেন, আর বইটিতে উল্লেখিত লেখা গল্পগুলো আমাদেরই জীবনের গল্প।
আমরা বাংলাদেশি ক্যানাডিয়ান ফেসবুক গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা ও সমাজসেবা মুলক কাজের উদ্যোক্তা ড্যানিয়েল হাকিম (ড্যান ড্যান), সবাইকে ফারাক বইটি পড়তে অনুরোধ করেন। তিনি উল্লেখ করেন যে, সময় পরিবর্তনের সাথে সাথে আমাদের প্যারেন্টিং স্টাইল চেন্জ হয়নি। বাবা-মা ও সন্তানদের মধ্যে সম্পর্ক এর ফারাক তৈরীতে এটাই ভূমিকা রাখছে। বইটা আমাদের মধ্যে বিদ্যমান সেই দূরত্ব বা গ্যাপ পুরনে সহায়তা করতে পারে।
প্রথম আলোর প্রাক্তন সাংবাদিক ও কানাডা প্রবাসী লেখক সুব্রত নন্দী বলেন, আমরা আগে জানতামই না যে প্যারেন্টিং বলে একটি বিষয় আছে। যাদের ক্ষতি হয়ে গেছে তাদেরতো গেছেই। আর আামাদের যাদের এখনো সুযোগ আছে, তারা যদি গুড প্যারেন্টিং করতে পারি তাহলে আমাদের বাচ্চাদের ক্ষতি হবেনা। আমি মনে করি, সবাইকে বাচ্চাদেরকে সময় দিতে হবে। আমাদেরকে চাপিয়ে দেয়ার মানসিকতা পরিহার করতে হবে। মোস্তফা আকন্দ খুবই ভালো লেখেন। টরন্টোতে বাঙালীদের মধ্যে যে কয়জন ভালো লেখেন, মোস্তফা আকন্দ তাদের অন্যতম। টরন্টোর বিশিষ্ট সমাজকর্মী মোস্তফা কামাল বলেন, বাবা মা হিসেবে আমাদের চিন্তার জায়গায় পরিবর্তন আনতে হবে। তারা যেভাবে চায় সে মোতাবেক সহায়তা করতে হবে। তাহলেই দূরত্ব কমবে।
টরন্টো ভিত্ত্বিক অলাভজন দাতব্য সংস্থা বেঙ্গলী ইনফরমশেন এন্ড এমপ্লয়মেন্ট সার্ভীস (বিআইইএস) এর নির্বাহী পরিচালক ইমাম উদ্দিন বলেন, ফারাক বইটিতে যে বিষয়গুলো তুলে আনা হয়েছে তার গুরুত্ব অপরিসীম। আমরা যত টাকা পয়সার মালিকই হইনা কেন, বাচ্চারা যদি ঠিকমত বেড়ে না ওঠে তাহলে সব সম্পদ অর্জন বৃথা হয়ে যাবে। নিজের সন্তানদেরকে লালনপালন করতে গিয়ে তিনি কী কী চ্যালেন্জের সমুখীন হয়েছেন, এবং তা তিনি কীভাবে মোকাবেলা করেছেন- তার বিবরন তুলে ধরেন।
টরন্টোর বিশিষ্ট সমাজকর্মী বদিউজ্জামান মুকুল বলেন, “এলিফ্যান্ট ইন দ্য রুম-এখন আমাদের ঘরের মধ্যে হাতি। এটাকে আর গুরুত্বহীনভাবার অবকাশ নেই। সন্তানরা বাবা-মাকে হত্যা করছে। কেন? একটু ভাবুন। যে স্টাইলে সন্তান লালন-পালন করছেন ঠিক আছে তো ? আপনি বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে সমস্যায় থাকলে ফারাক বইটি আপনাকে সহায়তা করতে পারে। কারন বইটির গল্পগুলো খুবই বাস্তব এবং আমার প্রফেশনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।”
বিমান বাংলাদেশের প্রাক্তন ট্রেনিং ম্যানেজার, লেখিকা ও টরন্টোর নারী উদ্যোক্তা সাবিনা শারমিন বলেন, ”ফারাক হতে পারে কারো কারো জন্য জীবন রক্ষাকারী হাতিয়ার। আপনি আপনার ঘরের মধ্যে কোন দানবকে বড় করে তুলছেন নাতো? ঢাকার ঔশি মেয়েটি কেন তার বাবামাকে হত্যা করল? মুল কারন প্যারেন্টিং। তার বাবা-মা তাকে কীভাবে মানুষ করেছেন। তাকে কতটুকু সময় দিয়েছেন? তা নিয়ে কী আমরা ভেবেছি? ফারাক কেন সৃষ্টি হল? অনেক প্রশ্ন। নিজেকে প্রশ্ন করুন।”
টরন্টো ডিস্ট্রিক্ট স্কুল বোর্ড এর শিক্ষক ডঃ ফখরুদ্দীন, লেবানিজ-আমেরিকান কবি ও দার্শনিক কাহলিল জিবরানের একটি কবিতার উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, “তোমাদের সন্তানেরা তোমাদের নয়। তারা সময়ের সন্তান। তারা তোমাদের মাধ্যমে পৃথিবীতে এসেছে। তোমরা তোমাদের সন্তানদের নিজের সম্পত্ত্বি মনে করিও না। …” অর্থাৎ সন্তান হলেই যে সব কিছু তাদের ওপর চাপিয়ে দিতে হবে তাদের মতামতের কোন দাম দেয়া যাবেনা-এটা ঠিক নয়। তারা ছোট হতে পারে কিন্তু তারাও সব বোঝে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
অন্টারিওর নিবন্ধিত সমাজকল্যান কর্মী ও উপন্যাসিক জাকারিয়া মুইনুদ্দিন বলেন, আমাদের বাচতে হলে জানতে হবে, অনুশীলন করতে হবে। মেন্টাল হেল্থ খুব গুরুত্বপুর্ন বিষয়। প্যারেন্টিং আমাদের শিখতে হবে। ফারাক প্যারেন্টিং শিখতে সহায়তা করবে নিশ্চয়ই।
বইটির সহ-লেখক নেসার আহমেদ উপস্থিত অতিথিদের প্রশ্নের উত্তরে বলেন, ফারাক বইটি সময়পোযোগি বই। বইটি গল্প সমৃদ্ধ হলেও সবগুলো গল্পই সত্য ঘটনার ওপর ভিত্তি করে লেখা। সময়ের সাথে সাথে আমাদের নিজেদের প্যারেন্টিং স্টাইলে পরিবর্তন আনতেই হবে। বইটি আমাদের সেই পরিবর্তন আনতে সহায়কের ভূমিকা পালন করবে।
মোস্তফা আকন্দ বইটির ওপর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে বলেন, আমরা সবাই আমাদের বাচ্চাদের উজ্জ্বল ভবিষ্যত চাই। কিন্তু নতুন দেশ নতুন সময়ের চাহিদারে সাথে তাল মিলিয়ে আমরা নিজেরা নিজেদের পরিবর্তন করতে ইস্ততঃবোধ করি। ফলে আমাদের সাথে আমাদের সন্তানদের ফারাক তৈরী হয়। নতুন দেশের রীতিনীতি ও সংস্কৃতির সাথে নিজেদের খাপ খাওয়াতে না পারলে আমরা পিছিয়ে পড়ব। বিদেশী সংস্কৃতি ও আমাদের সংস্কৃতির চাপে আমাদের বাচ্চারা স্যান্ডউিইচ বেবি হিসেবে বেড়ে উঠবে অথবা হারিয়ে যাবে। আমাদেরকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে আমরা কী করবো। কারন বাচ্চাদের দোষ দিয়ে লাভ নেই। বইটি বাবা-মায়েদের প্যারেন্টিং চ্যালেন্জ মোকাবেলায় সহায়ক হবে সন্দেহ নেই।
আলোচনা অনুষ্ঠানে আরো মতামত ব্যক্ত করেন, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টর এডভোকেট ও কানাডা প্রবাসী আক্তার মোসাম্মাৎ, ক্যানবাংলা টেলিভিশনের কর্নধর ডঃ মোঃ হুমায়ন কবির চৌধুরী, পিল ডিষ্ট্রিক্ট স্কুল বোর্ড এর সিনিয়র শিক্ষক এমডি হাসান তারিক, বিশিষ্ট নারী উদ্যোক্তা সেলিমা আহমেদ, বিশিষ্ট আবাসন ব্যবসায়ী নাসিমা পারভীন ও মেফিল্ড হাইস্কুলের নবম শ্রেনীর ছাত্রী মেহরীন মুস্তারী প্রমূখ।
প্রবাস বাংলা ভয়েস /ঢাকা/ ০৪ মার্চ ২০২৪ /এমএম