Menu

প্রবাস বাংলা ভয়েস ডেস্ক ::‌ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সুপ্রাচীন গুরুদাস কলেজের সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের উদ্দেশে ‘বর্তমান সময়ে গণমাধ্যমে সাংবাদিকতার প্রকৃতি’ বিষয়ে কথা বলতে হয়েছে আমাকে। বিভাগের প্রধান অধ্যাপক অরুনিমা মুখার্জির আমন্ত্রণ খানিকটা কাকতালীয় হলেও শেষ পর্যন্ত সময়টা মন্দ কাটেনি। বিশেষ করে আলোচনাটি প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে, যখন ছাত্রছাত্রীরা সমকালীন সাংবাদিকতার নানা বিষয় নিয়ে প্রশ্ন-উত্তর পর্বে যুক্ত হয়। ভালো লাগে এ ভেবে যে, সাংবাদিকতার শিক্ষার্থীরাও সমকালীন সাংবাদিকতার ভালো-মন্দ নিয়ে ভাবে। বর্তমান নিবন্ধটি সেদিনের আলোচনারই একটি সংক্ষিপ্তসার।

আমার বিশ্বাস, সাংবাদিকতার প্রকৃতি নিয়ে আলোচনার আগে প্রথমে গণমাধ্যম বিষয়টি খোলাসা হওয়া দরকার। কারণ, বর্তমান সময়ে গণমাধ্যম বহুবিধ কাজ করে। তারা একদিকে জনজীবনের প্রাত্যহিক ঘটনাবলি ‘ইনফর্ম’ করে, একইসঙ্গে গণমানুষকে ‘এজুকেট’ করে, এবং ‘এন্টারটেইনমেন্ট’ করে, ‘এডভারটাইজ’ করে এবং ‘প্রোপাগান্ডা’ করে। শুধু এই নয়, কিছু কিছু গণমাধ্যম পরিকল্পিতভাবে ‘ফেক নিউজ’ বা ভুয়া খবর প্রচার করে বলেও অভিযোগ কম নেই! এ রকম অভিযোগ পুরোটাই অস্বীকার করা যাবে বলে আমার মনে হয় না।

সবাই স্বীকার করবেন, বর্তমান বিশ্বে গণমাধ্যমের প্রভাব বেড়েছে। ব্যাপকতার এ স্বরূপ সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বহুগুণ সম্প্রসারিত হয়েছে, সব দেশে-সব অঞ্চলে। একমাত্র কমিউনিস্ট ও রাজতন্ত্রীয় রাষ্ট্রব্যবস্থা ছাড়া সারা বিশ্বেই এ সম্প্রসারণ ঘটেছে। বলতেই হবে, ব্যাপক এ সম্প্রসারণ নিঃসন্দেহে মুক্ত সাংবাদিকতার পথে ইতিবাচক পদক্ষেপ, তথ্যপ্রযুক্তির বিস্ময়কর বিস্তারে যা সম্ভব হয়েছে।

তবে আগেকার এবং বর্তমান সময়ের সাংবাদিকতার মধ্যে বিস্তর ফারাক লক্ষ করার আছে। আগে যেখানে প্রিন্ট মিডিয়াই ছিল মূল বাহন, আজ সেখানে সর্বাধুনিক তথ্যপ্রযুক্তি এসে তার পরিধি বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। এসেছে স্যাটেলাইট টেলিভিশন। বিশের শতকে আমাদের উপমহাদেশীয় দেশগুলোতে টেলিভিশন সাংবাদিকতার তেমন প্রসার ঘটেনি। সে সময়ে সাংবাদিকতা বা গণমাধ্যম ছিল নিতান্তই প্রিন্ট বা ছাপাখানানির্ভর। আমরা যদি ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়ের কথা ভাবি, তখন ভারত ও পাকিস্তানের সাংবাদিকতা ছিল আক্ষরিক অর্থেই প্রিন্টনির্ভর। টেলিভিশন যদিও চালু হয়েছে, কিন্তু তা মোটেও বিস্তার লাভ করেনি।

স্মরণ করা যেতে পারে, প্রথম পরীক্ষামূলক সম্প্রচার শুরুর পর ভারতে টেলিভিশনের প্রথম দৈনিক সম্প্রচার শুরু হয় ১৯৬৫ সালে। পূর্ব পাকিস্তান বা বর্তমান বাংলাদেশের প্রথম টেলিভিশন সম্প্রচার শুরু হয় ১৯৬৪ সালের ২৫ ডিসেম্বর। তখনকার সম্প্রচার ছিল খুবই সীমিত আকারের এবং ছিল সম্পূর্ণভাবে সরকারের নিয়ন্ত্রণে। এরপর ১৯৯৬ সালে আসে প্রথম স্যাটেলাইট টেলিভিশন-যাত্রা শুরু করে এটিএন বাংলা। তবে বেসরকারি খাতে টেরিসট্রিয়াল টিভি হিসাবে প্রথম সম্প্রচার শুরু করে একুশে টেলিভিশন ২০০০ সালে। বলা বাহুল্য, একুশে টিভি বাংলাদেশের সাংবাদিকতার নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে। এরপর দেশে দ্রুত স্যাটেলাইট টেলিভিশনের বিকাশ ঘটে এবং গণমাধ্যমের পরিধি বিস্তারে নতুন যুগের সূচনা হয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের ছাত্র থাকাকালীন মুক্তিযুদ্ধে আমার অংশগ্রহণ করার সুযোগ ঘটে। যুদ্ধ কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি যুদ্ধকালীন সাংবাদিকতার সঙ্গেও যুক্ত থাকতে হয় আমাকে রণাঙ্গন থেকে। সে কারণে তখনকার সাংবাদিকতার, বিশেষ করে ভারতীয় এবং বাংলাদেশের সাংবাদিকতার বিষয়াদি কম-বেশি জানার সুযোগ ঘটে। বাস্তবতার স্বার্থেই স্বীকার করতে হবে, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ভারতের জাতীয় ও আঞ্চলিক সংবাদপত্রের ভূমিকা ছিল অসামান্য, যা বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ।

আমরা সবাই জানি, তথ্যপ্রযুক্তির বিস্ময়কর প্রসারে সাংবাদিকতার পরিধি আজ ব্যাপক ও বিস্ময়করভাবে সম্প্রসারিত। তবে অনেকে এ-ও বলে থাকেন, এ সম্প্রসারণ কেবলই বহিরাঙ্গের-অন্তরের বা আত্মার নয়। সে কারণে অধুনা সাংবাদিকতার ‘কমিটমেন্ট’ নিয়েও অনেক ক্ষেত্রে প্রশ্ন ওঠে। অনস্বীকার্য, গণমাধ্যমে স্পিড, কালার, কনটেন্ট ইত্যাদির ব্যাপক বিস্তৃতি ঘটেছে। টিভির অনুষ্ঠান ‘লাইভ’ হচ্ছে। মোবাইল ফোন, আইপ্যাডের স্ক্রিনে সবকিছুই এখন হাতের নাগালে। বিশ্বের সব প্রান্ত থেকে সব দেশের সংবাদপত্র এখন নিমিষে পাঠ করা যায়। সব ভাষার, সব চরিত্রের, সব সংবাদপত্র এখন আন্তর্জাতিক; গণমাধ্যম আজ কেবল দেশীয় বা আঞ্চলিক নয়, থাকার সুযোগও নেই। ইত্যাদি কারণে অনেকে ভয় পান ‘অনলাইনের’ এ পরামক্রমশালী যুগে প্রিন্ট বা ছাপা কাগজের সংবাদপত্র কোথায় নাকি হারিয়ে যায়! হারিয়েছেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে; কিন্তু প্রিন্টের যে স্বাদগন্ধ, আবেদন আছে তাকে অস্বীকার করা যাবে বলে আমার মনে হয় না। এবং আমার দৃঢ় বিশ্বাস, প্রিন্ট থাকবে এবং নিজের মর্যাদাতেই থাকবে; যেমনি ইলেকট্রনিক পুস্তকের ব্যাপক প্রসারের পরও বই ছুঁয়ে দেখার আনন্দ কমেনি।

তবে বলতেই হবে, অধুনা সাংবাদিকতার বেশকিছু সংকট বা সীমাবদ্ধতা আছে, যা হরহামেশাই লক্ষ করা যায়। অনেকেই অভিযোগ করেন, সাংবাদিকতার যতটা অঙ্গের রূপে বেড়েছে, ততটা অন্তরের রূপে বাড়েনি। ঘাটতি পড়েছে ‘কমিটমেন্টে’ও। আরও দুর্ভাগ্য, কিছু কিছু ক্ষেত্রে সাংবাদিকতা ‘এডভারটাইজমেন্ট’ এবং ‘প্রোপাগান্ডা’ হয়েছে, বাণিজ্যই মুখ্য হয়েছে। এসব অভিযোগ যদি আমলে নেই, যা না নেওয়ার কারণও নেই, তাহলে বর্তমান সাংবাদিকতার কতিপয় বড় প্রতিবন্ধক নিশ্চয়ই চিহ্নিত করা যায় এবং উচিতও।এখন দেখার চেষ্টা করি কী কী প্রতিবন্ধকতা বা প্রতিপক্ষ আছে অধুনা সাংবাদিকতার। এ চিহ্নিতকরণ জরুরি এবং সে লক্ষ্যে যদি কাজ করা যায়, তাহলে সাংবাদিকতার গা থেকে কালো চিহ্নগুলো মুছে তাকে আরও ঝকঝকে করা সম্ভব।

আমার বিশ্বাস, আগেকার দিনের মতো মুক্ত বা স্বাধীন সংবাদপত্রের প্রতিপক্ষ কেবল স্বৈরাচারী সরকার বা রাষ্ট্রশক্তি নয়। বিশ্ব পরিবেশ বা পরিস্থিতি বদলেছে। বিশ্ব বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই গণতান্ত্রিক হয়েছে; কিন্তু গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রেও নানাবিধ গোষ্ঠী বা রাজনৈতিক স্বার্থে চতুর আইনের প্রতিবন্ধকতা আছে, যা স্বাধীন সাংবাদিকতার সহায়ক নয়। এর বাইরেও আছে আরও বহুবিধ প্রতিপক্ষ। যেমন ক. বড় পুঁজির আধিপত্য; খ. বাণিজ্যকরণের আধিপত্য; গ. অসহিষ্ণু দল ও স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর আধিপত্য; ঘ. ধর্মীয় উগ্রবাদের আধিপত্য; ঙ. সংবাদকর্মীদের দলীয় দৃষ্টিভঙ্গির নেতিবাচক প্রভাব; চ. জনস্বার্থ বিবেচনা বা ‘কমিটমেন্টের’ ঘাটতি ইত্যাদি। এরপরও কিছু প্রতিবন্ধক নিশ্চয়ই আছে, যা সাংবাদিকতার মর্যাদা ক্ষুণ্ন করে। যেমন সম্পাদকীয় প্রতিষ্ঠানের অবমূল্যায়ন, সংবাদকর্মীদের প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি ও প্রশিক্ষণের অভাব-এসব।

এরপরও বলতে হবে, বর্তমান যুগে সাংবাদিকতার প্রভাব ও প্রসার যেমন বেড়েছে, তেমনি বেড়েছে সংকটও। সাংবাদিকতা নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ পেশা, এ পেশা মহত্ত্বের দাবিদার। তবে জানা এবং মানা দুটোই প্রয়োজন, এ পেশা সংবাদকর্মীদের জন্য কেবলই চাকরি নয়, কিংবা সংবাদশিল্পের মালিকদের জন্য কেবলই ব্যবসা নয়। এর অন্যথা ঘটে বলে সাংবাদিকতা মর্যাদা হারায়। আমার বিশ্বাস, সাংবাদিকতার মান আরও বাড়বে, যদি চিহ্নিত সংকটগুলো দূর করার চেষ্টা করা হয়।

হারুন হাবীব : মুক্তিযোদ্ধা, লেখক ও সাংবাদিক

প্রবাস বাংলা ভয়েস /ঢাকা/ ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ /এমএম

 


এই বিভাগের আরও সংবাদ