প্রবাস বাংলা ভয়েস ডেস্ক :: তুষার পাত আমাকে খুব প্রভাবান্বিত করে। শো শো হিম প্রবাহের সাথে অঝোরে ঝরছিলো তুষার। এমন দৃশ্যে আমার সবসময় অকারণে মন খারাপ হয়। জানালার ধারে বসে ক্যালগেরির এ বছরের প্রথম তুষারপাত দেখছিলাম আর জীবনের দেখা প্রথম তুষারপাত জাপানের কথা ভাবছিলাম। এমন সময় চিন্তার চ্ছেদ ঘটিয়ে মুঠো ফোন বেজে উঠলো কর্কশ শব্দে। আমার মেঝো বোন ডলি আপা ফোন করেছেন টরন্টো থেকে। বেশ কয়েকদিন তার সাথে কথা হয় নি। অলস ভঙ্গিতে খুশি মনে ফোন কানে ধরতেই তাঁর কাছ থেকে দুঃসংবাদ শুনে গভীর শোকাহত হলাম। সৈয়দ আবুল হোসেন আর নেই। আমাদের পরিবারের সেই সফল ব্যক্তিত্ব সাবেক সংসদ সদস্য ও যোগাযোগ মন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন চলে গেলেন না ফেরার দেশে, (ইন্নালিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলিহে রাজেউন)।
আজ আমার স্মৃতিতে বারবার ভেসে উঠছে। তাঁর বাসায় তেমন কোনো যাতায়াত না থাকলেও যোগাযোগ ছিল। তবে যতটুকু মেলামেশার সৌভাগ্য হয়েছিলো সেই মধুর স্মৃতিই রয়ে যাবে আমার অন্তরে। সৈয়দ আবুল হোসেন ছিলেন আমাদের সকল কাজিনদের প্রিয় ভগ্নিপতি। তাঁর স্ত্রী খাজা নার্গিস আমার মামাতো বোন। তাঁকে আমরা কুন্তী আপা বলেই ডাকি। মনে পরে আমার বিয়ের সময় তাঁকে নিমন্ত্রণ করতে গিয়েছিলাম তাঁর ঢাকার ইন্দিরা রোডের বাড়িতে। আমার বিয়ের কার্ড হাতে নিয়ে সবটাই সময় নিয়ে পড়লেন এবং হাসিমুখে বললেন তোমার ভাগ্য খুব ভালো। আমি বললাম, কেন ? উনি কথা বলতেন মুখে মৃদু হাসি মেখে। সেই হাসি মুখে বললেন, আমার নতুন গাড়ি মিৎসইউবিসি গ্যালেন্ট এসে গেছে ওটাই হবে বরের গাড়ি। আমি তাঁর এমন উদারতায় ও আন্তরিকতায় খুবই অবাক এবং আনন্দিত হয়েছিলাম। আমি তাঁর কাছে গাড়ির আর্জি নিয়ে যাই নি। গিয়েছিলাম বিয়ের নিমন্ত্রণ করতে। বিবাহের মঞ্চে তিনি প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত আমার পাশে বসে ছিলেন। আজ পুরাতন সিডি বের করে ধুলো ঝেড়ে আমার বিবাহের ভিডিও দেখছিলাম। সেদিন তার হাসি মুখে অতিথি আপ্যায়ন ও আন্তরিকতার অভাব দেখি নাই। এমন দৃশ্য দেখতে দেখতে নিজের অজান্তেই চোখ ঝাপসা হয়ে যায়।
তাঁর শ্যালক খাজা গোলাম মেহেদী শুধু আমার ভাইই নয়, আমার বিশেষ বন্ধুও। মেহেদীর আন্তরিক উৎসাহে ও আয়োজনে আমরা কাজিনরা শীতকালে সৈয়দ সাহেবের ঢাকার ইন্দিরা রোডের বাড়িতে ব্যাডমিন্টন খেলতাম। সেও আশির দশকের শেষে অথবা নব্বই দশকের শুরুর কথা। সে সময় সৈয়দ সাহেবের বাসায় বেশ বড় টেলিভিশন ছিলো আর সেই সুবাদে আমরা ওয়ার্ল্ড কাপ ক্রিকেট দেখেছিলাম। সেই সব স্মৃতি এখন অতীত স্মৃতি-বিধুর।
আমি ক্যানাডায় বসবাস শুরু করলে তাঁর সাথে যোগাযোগ কমে যায়। এর অনেকদিন পর তাঁর গুলশানের বাসায় গিয়েছিলাম আমার মেয়ের বিয়ের নিমন্ত্রণ করতে। আমি হেসে বলেছিলাম, এবার কিন্তু গাড়ি লাগবে না দুলাভাই, মেয়ের বিয়ে বর যাত্রীর ঝামেলা নেই। তিনি আমার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকালেন। বললেন, বলো কি সেদিন না তোমার বিয়ের বরযাত্রী গেলাম এর মধ্যেই তোমার মেয়ের বিয়ে হচ্ছে। আমি মাথা নাড়তেই তিনি দীর্ঘশাস ফেলে বললেন, দিন কি ভাবে চলে যায়। এখন সে কথা ভাবছি, দিন ঠিকই চলে যায় কিন্ত স্মৃতি থেকেই যায়। তাঁর সেদিনের সেই দীর্ঘশাস আমাকে যেন সংক্রামিত করলো, নিজের অজান্তেই বেরিয়ে এলো এক দীর্ঘশ্বাস।
কাছ থেকে দেখা সৈয়দ সাহেবে ছিলেন অতি সাধারণের মাঝে একজন অসাধারণ মানুষ। তাঁর মনে কখনোই অহংকার দেখি নাই। যে কোনো অবস্থাতেই তার সাথে যোগাযোগ করতে পারতাম, এটি ছিল তাঁর বৈশিষ্ট্য। সৈয়দ আবুল হোসেন, একজন সফল ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ ও সমাজসেবক। এমন বিরল ব্যক্তিত্ব খুঁজে পাওয়া দুস্কর। তিনি রেখে গেছেন তার অগণিত শুভাকাঙ্খী ও আত্মীয় পরিজন। তিনি কালকিনি-মাদারীপুরের বাসিন্দাদের কাছে জনপ্রিয়তার শীর্ষে। তাঁর সমাজ সেবার স্বাক্ষর রেখেছেন শিক্ষা ক্ষেত্রে। তিনি নিজস্ব অর্থায়নে প্রতিষ্ঠা করেছেন ছয়টি কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ। আরো প্রতিষ্ঠা করেছেন ৫৮ টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়। তিনি একজন আলোকিত মানুষ হিসেবে আলোকিত করেছেন তার অঞ্চলসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল। তাঁর মহৎ কর্মকান্ডের স্বীকৃতি হিসেবে পেয়েছেন অনেক জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কার ও সম্মাননা। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য পুরস্কার, ভারতের বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক বিদ্যাসাগর পুরস্কার, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় স্বাধীনতা পুরস্কার, আচার্য প্রফুল চন্দ্র রায় পুরস্কার, বঙ্গবন্ধু জাতীয় পুরস্কার, শহীদ সোহরাওয়ার্দী পুরস্কার, যুগশ্রেষ্ঠ শিক্ষা-উদ্যোক্তা এবং মিলিনিয়াম অফ দ্যা অনার স্বর্ণপদক পুরুস্কার সহ তিনি মোট বাইশটি পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন। শিক্ষার প্রতি এমন একজন অনুরাগী মানুষের অকাল প্রয়াণ দেশের অপূরণীয় ক্ষতি।
মানুষ চলে যায়, রেখে যায় তাঁর মহৎ কর্ম, আর সেই সৎ কর্মই রয়ে যায় রেখে যাওয়া মানুষের মাঝে স্মৃতি অম্লান হয়ে। সৈয়দ সাহেবের সদা হাস্যোজ্জ্বল মুখটি আর দেখতে পাবো না। তারপরও সেই হাসিমাখা মুখ রয়ে যাবে আমার স্মৃতির মনিকোঠায়। তাঁর অমলিন হাসি মলিন হয় নি বরং লক্ষ লক্ষ মানুষের মুখে হাসি ফুটিয়ে তিনি চির নিদ্রায় শায়িত হয়েছেন ।সৈয়দ আবুল হোসেনের আত্মার শান্তি ও মাগফেরাত কামনা করি। মহান রাব্বুল আলামিন তাঁকে বেহেশত নসিব করুন। আমিন
বায়েজিদ গালিব,
রম্য লেখক
ক্যালগেরি, ক্যানাডা।
প্রবাস বাংলা ভয়েস /ঢাকা/ ২৮ অক্টোবর ২০২৩ /এমএম