প্রবাস বাংলা ভয়েস ডেস্ক :: যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক উদ্যোগের অংশ হিসাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন সৌদি আরব সফরকালে সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান চলমান ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংঘাত বন্ধের উপায় খুঁজে বের করার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। তবে সংঘাত বন্ধে সৌদি যুবরাজ যে আহ্বান জানিয়েছেন, তা এ সংকটের স্থায়ী কোনো সমাধান দেবে না। এটি বর্তমান সংঘাত অবসানের জন্য নতুন একটি উদ্যোগ হতে পারে মাত্র; সংঘাতের মূল তাতে উৎপাটিত হবে না। আর মূল উৎপাটিত না হলে ৭৫ বছর ধরে ফিলিস্তিনিদের ওপর অন্যায়-অবিচারের যে মহিরুহ চারা থেকে ধীরে ধীরে বড় হয়ে বিশাল শক্তি অর্জন করেছে, তাকে কেটে ফেলা যাবে না। সাময়িক যুদ্ধবিরতি হলেও ভবিষ্যতে আবারও সংঘাত হবে। তাই টেকসই সমাধানের জন্য একটি বড় ধরনের রাজনৈতিক পদক্ষেপ নিতে হবে। এর জন্য সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর সদর্থক রাজনৈতিক অভিপ্রায় থাকতে হবে।
গত ৭ অক্টোবর শুরু হওয়া হামাস ও ইসরাইলের পালটাপালটি হামলায় অসংখ্য জীবনহানি ও আহত হওয়ার ঘটনা ঘটছে। হামাসের তুলনায় ইসরাইল শক্তিশালী বলে তার আঘাত নির্মম ও আন্তর্জাতিক আইনবিরোধী। স্বভাবতই গাজায় ক্ষতি হয়েছে অনেক বেশি। ইসরাইল হামাসকে মোকাবিলা করার নামে নিরস্ত্র ও বেসামরিক মানুষজনকে নিশানা করে টন টন বোমা ফেলার পাশাপাশি পানি, বিদ্যুৎ, খাদ্যদ্রব্য ও ওষুধসহ চিকিৎসা সরঞ্জাম পাঠানোর ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। হাসপাতালে বোমা ফেলে শত শত মানুষ হত্যা করে ইসরাইল যুদ্ধ অপরাধ করছে। উত্তর গাজা থেকে বেসামরিক মানুষজনকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে দক্ষিণ দিকে সরে যেতে নির্দেশ দিয়ে সময়সীমা শেষ হওয়ার আগেই ৭০ জন বেসামরিক-নিরীহ মানুষকে বোমা ফেলে হত্যা করেছে। হামাসের সঙ্গে ইসরাইলের সামরিক সংঘাত আগেও কয়েকবার সংঘটিত হয়েছিল। জায়নবাদীরা তখনো ফিলিস্তিনিদের ওপর নির্মম আঘাত হেনেছে। প্রতিবারই আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপে দুই পক্ষ তাদের অস্ত্র সংবরণ করেছে।
ফিলিস্তিন সমস্যা শুরুর পর থেকে গত ৭৫ বছরের ইতিহাস স্মরণ করলে দেখা যায়, ফিলিস্তিনি জনগণ বরাবরই বঞ্চনার শিকার হয়েছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কখনোই তাদের প্রতি ন্যায়সংগত অবস্থান গ্রহণ করেনি। অটোমান নিয়ন্ত্রণ শেষে লিগ অব নেশন্সের ম্যান্ডেট নিয়ে ব্রিটেন যখন অন্যান্য আরব ভূখণ্ডসহ ফিলিস্তিন শাসন শুরু করেছিল, তখন ইহুদিদের প্রতি সহানুভূতিশীল ও পক্ষপাতমূলক আচরণ করা হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে জাতিসংঘ এ সমস্যা সমাধানের নামে ফিলিস্তিনকে ভাগ করে এ ভূখণ্ডের বেশির ভাগ অংশ ইহুদি বসতি স্থাপনকারীদের জন্য বরাদ্দ দেয়। অথচ ইহুদি জনসংখ্যা তখন আরব ফিলিস্তিনিদের থেকে কম ছিল। সেই সময় প্রতিবেশী আরবরাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে সদ্য গঠিত ইসরাইলের যুদ্ধে ইহুদি বাহিনী ফিলিস্তিনের জন্য বরাদ্দকৃত ভূখণ্ডের অনেকটা দখল করে নেয়। অখণ্ড ফিলিস্তিনের ২৬,৩২৩ বর্গকিলোমিটার ভূমির ২০,৮৫০ বর্গকিলোমিটারই ইসরাইলের দখলে চলে যায়। ১৯৬৭ সালের আরব-ইসরাইল যুদ্ধের সময় ফিলিস্তিনের অবশিষ্ট অংশও দখল করে নেয় ইসরাইল।
ফিলিস্তিনি জনগণের প্রতি প্রতিবেশী আরবরাষ্ট্রগুলোর ক্ষমতাসীন সরকারগুলোর আচরণও সব সময় ভারসাম্য ও বন্ধুত্বপূর্ণ ছিল না। যদি হতো তাহলে ১৯৪৮ সালের যুদ্ধে আরবদের সম্মিলিত বাহিনীর আক্রমণে ইসরাইলের মৃত্যুঘণ্টা বাজত। কিন্তু বিলাসী, গণবিরোধী ও পারিবারিক শাসনের ঐতিহ্যসমৃদ্ধ আরব নেতারা ফিলিস্তিনের প্রতি মৌখিক সমর্থনই দিয়েছেন বেশি; কার্যকর সাহায্য দিয়েছেন কম। পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে ইসরাইলের বন্ধুত্ব ফিলিস্তিনিদের পক্ষে আরবদের ঐক্যবদ্ধ অবস্থান গ্রহণে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। অথচ শুরু থেকেই ফিলিস্তিনিরা নিজেদের বৃহৎ আরব জাতির অংশ হিসাবে একটা আরব সমাধানের অপেক্ষায় ছিল। একসময় তরুণ ফিলিস্তিনিরা আরবদের সমর্থনের সঙ্গে নিজেদের শক্তির ওপর নির্ভর করে তাদের মুক্তির লড়াই শুরু করে। তাদের সশস্ত্র প্রতিরোধ শুরু হয়েছিল আন্তর্জাতিক অবজ্ঞার প্রত্যুত্তর দিতে। তখন ইসরাইলি স্বার্থের ওপর ফিলিস্তিনি বিভিন্ন গোষ্ঠী যেসব গেরিলা হামলা চালাত, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য বিমান হাইজ্যাক, সীমান্তে সশস্ত্র হামলা, অলিম্পিক গেমসে ইসরাইলি ক্রীড়াবিদদের ওপর সহিংস হামলা ইত্যাদি। এ সময় ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ গোষ্ঠীগুলো অসাম্প্রদায়িক ও সাম্যবাদী চেতনা ধারণ করত। তাদের প্রতি সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের রাজনৈতিক, কূটনৈতিক ও বস্তুগত সমর্থন শক্তি জুগিয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইল ফিলিস্তিন নেতৃত্বকে সন্ত্রাসবাদী আখ্যায়িত করে তাদের সঙ্গে কোনো ধরনের আলোচনার বিরোধী ছিল। বলা দরকার, সে সময় হামাস বা ইসলামি জিহাদের মতো ধর্মীয় উগ্রবাদী কোনো রাজনৈতিক গোষ্ঠীর আবির্ভাব হয়নি। পরে নানা কারণে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির পরিবর্তনের কারণে অসাম্প্রদায়িক প্রতিরোধ ক্রমান্বয়ে দুর্বল হয়ে গেলে ধর্মীয় উগ্রবাদীরা নিজেদের সংগঠিত করে তোলে।
অসলোতে গোপন আলোচনার ফলে ১৯৯৩ সালে ফিলিস্তিন ও ইসরাইলের মধ্যে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ায় দুই পক্ষের মধ্যে শান্তির এক প্রক্রিয়া শুরু হবে বলে আশা করা হয়েছিল। পিএলও চেয়ারম্যান ইয়াসির আরাফাত ফিলিস্তিন স্বশাসন কর্তৃপক্ষের প্রেসিডেন্ট হিসাবে নিজ দেশে ফিরে এসে শাসনভার গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু শুরু থেকেই শান্তি প্রক্রিয়া হোঁচট খেতে থাকে। শান্তির প্রতি প্রধান চ্যালেঞ্জ ছিল ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে গড়ে তোলা অবৈধ ইহুদি বসতিগুলো। সেগুলো অপসারণের পরিবর্তে ক্রমাগত ফিলিস্তিনের ভূমি দখল করে নতুন নতুন বসতি গড়ে তুলে ফিলিস্তিনিদের কোণঠাসা করে ফেলা হচ্ছিল। ২০০৬ সালে ফিলিস্তিন আইনসভার নির্বাচনে ৪৪.৪৫ শতাংশ ভোট পেয়ে হামাস ১৩২ আসনের মধ্যে ৭৪টিতে বিজয়ী হয়েছিল। কিন্তু হামাস সরকার গঠন করেও নির্বিঘ্নে কাজ করতে পারেনি। ওই বছর জুনে ইসরাইলি এক সৈন্যকে অপহরণ করা হলে ইসরাইল গাজা ও পশ্চিম তীরে একের পর এক আক্রমণ করে বিভিন্ন বেসামরিক অবকাঠামো ধ্বংস করে। সেই সঙ্গে মন্ত্রিসভা ও আইনসভার কয়েকজন সদস্যকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। অন্যদিকে হামাসের সঙ্গে ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের দল ফাতাহ দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েছিল। তবে হামাস গাজার ওপর তার নিয়ন্ত্রণ সংহত করে তোলে। পাশ্চাত্যপন্থি আব্বাস ও আপসহীন হামাসের মধ্যে দ্বন্দ্বের ফলে ইসরাইল ফিলিস্তিনি স্বার্থবিরোধী পদক্ষেপ নিতে উৎসাহিত হয়েছিল।
ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ যোদ্ধারা প্রথমদিকে ইসরাইল রাষ্ট্রকে মেনে না নিয়ে একটি ‘ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক’ ফিলিস্তিন গড়ার প্রতি দৃঢ় অবস্থান নিয়েছিল। কিন্তু ১৯৭৭ সালে তাদের অবস্থানে পরিবর্তনের সূচনা হয়। তারা ইসরাইলের পাশে পশ্চিম তীর ও গাজা ভূখণ্ড নিয়ে একটি ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের জন্য আগ্রহ প্রকাশ করে। ওই বছর নির্বাচিত যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জেমস কার্টার এরূপ রাষ্ট্র গঠনের ধারণাকে সমর্থন দিয়েছিলেন। কোনো কোনো সময় ‘দ্বি-রাষ্ট্র’ গঠন নিয়ে বিভিন্ন মার্কিন সরকার আগ্রহ দেখিয়েছে। ইসরাইলের দিক থেকেও স্থায়ী শান্তির জন্য বিষয়টি নিয়ে আগ্রহের ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। কিন্তু ইসরাইলে চরম ডানপন্থি রাজনৈতিক শক্তি, যাদের মধ্যে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু অগ্রগণ্য, ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে একমাত্র অস্ত্রের ভাষায় কথা বলার পক্ষপাতী।
আরব রাষ্ট্রগুলো ইসরাইলকে মেনে না নেওয়ার অবস্থান থেকে সরে এসে দেশটিকে স্বীকৃতি দিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য করার নীতি গ্রহণ করেছে। সত্তরের দশকে মিসর প্রথমে ইসরাইলের সঙ্গে শান্তি স্থাপন করে তার অবস্থান পবিবর্তন করে। নব্বইয়ের দশকে জর্ডান ইসরাইলের সঙ্গে শান্তিচুক্তি করে। রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক দিক থেকে মিসরের অবস্থান পরিবর্তনের তাৎপর্য ছিল সবচেয়ে বেশি। আরবদের ভেতর ক্রমান্বয়ে ইসরাইলের প্রতি নরমপন্থা গ্রহণের সংখ্যা বাড়তে থাকে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সময় ‘আব্রাহাম অ্যাকর্ড’ স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে উপসাগরীয় রাষ্ট্র সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বাহরাইন ইসরাইলকে স্বীকৃতি দিয়ে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার দিকে এগিয়ে যায়। এরপর মরক্কো ও সুদান একই পদক্ষেপ নেয়। সৌদি আরবও একই পথে হাঁটছে বলে মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে।
গাজা থেকে হামাসের ইসরাইলে আক্রমণ করার কারণ নিয়ে কয়েকটা ব্যাখ্যা প্রকাশিত হয়েছে। হামাসের অবস্থান ইসরাইলের সঙ্গে আরবদের সম্পর্ক স্বাভাবিক করার বিরোধী। বস্তুত আরব রাষ্ট্রগুলো এভাবে ইসরাইলকে স্বীকৃতি দেওয়ার মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রটির বৈধতা যেমন দিচ্ছে, অন্যদিকে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের সম্ভাবনাকে নস্যাৎ করে দিচ্ছে। ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে ইতোমধ্যে স্বাক্ষরিত শান্তিচুক্তি ইসরাইল ভঙ্গ করেছে। অবৈধ বসতি স্থাপন করে ফিলিস্তিনিদের বসবাসের স্থান ক্রমাগত সংকুচিত করে চলেছে। অবৈধ বসতি স্থাপনকারী ও ইহুদি সৈন্যদের হাতে প্রতিনিয়ত নিরস্ত্র ফিলিস্তিনিরা নিহত হচ্ছে। পবিত্র মসজিদ আল আকসায় প্রবেশ করে ইহুদি উগ্রবাদীরা ফিলিস্তিনিদের উসকানি দিয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে আরবদের সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের নীতি ইসরাইলের ফ্যাসিবাদী নীতিকে বৈধতা দিচ্ছে বলে মনে করা যেতে পারে। একই সঙ্গে তা ফিলিস্তিনিদের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতার পদক্ষেপ বলে ফিলিস্তিনি নেতৃত্ব মনে করে।
তাই এবার হামাস যা করছে, তাকে ফিলিস্তিনিদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার পদক্ষেপ বলে বিবেচনা করা উচিত। তারা জানে যে তারা ইসরাইলের বর্বরতার বিরুদ্ধে বেশিদিন টিকতে পারবে না। অনেকে তাদের এ কাজকে হঠকারী বলতে পারে। তবে ফিলিস্তিন সমস্যার টেকসই সমাধান ছাড়া তাদের সামনে আর কোনো পথ খোলা নেই। তাই অন্যান্যবারের মতো কূটনৈতিক উদ্যোগ নিয়ে একটি সাময়িক যুদ্ধবিরতি কোনো সমাধান আনবে বলে মনে হয় না। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত হবে মূলে গিয়ে সমাধান বের করে নিয়ে আসা। এর জন্য দরকার হবে জাতিসংঘের নেতৃত্বে পাশ্চাত্য দেশগুলোর সাহসী ও পক্ষপাতবিহীন রাজনৈতিক উদ্যোগ গ্রহণ, যাকে চীন ও রাশিয়া সমর্থন দেবে।
ড. আকমল হোসেন : অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
প্রবাস বাংলা ভয়েস /ঢাকা/ ২১ অক্টোবর ২০২৩ /এমএম